ক্ষমতার অপচর্চাই কি ক্ষমতার বিড়ম্বনা নয়? - দৈনিকশিক্ষা

ক্ষমতার অপচর্চাই কি ক্ষমতার বিড়ম্বনা নয়?

ড. সুলতান মাহমুদ রানা |

গত ৪ জানুয়ারি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) ছাত্রী আফসানা আহমেদ ছাত্রলীগের মিছিলে যোগ দেওয়ার নির্দেশ মানেনি বিধায় ছাত্রলীগ নেতারা তাকে হল থেকে বের করে দেন। পরে ওই ছাত্রীর সাহসী প্রতিবাদ আমাদের সাহসী করেছে। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে প্রতিবাদের ভাষা। ছাত্র অবস্থায় (২০০১-০৬) দেখেছি, ছাত্রশিবির সাধারণ শিক্ষার্থীদের ইয়ানত (চাঁদা) দিতে বাধ্য করত। মিছিল করতে বাধ্য করত। কোনো শিক্ষার্থী প্রতিবাদ জানালে তাকে হল ছাড়তে বাধ্য করা হতো। অবশ্য অনেকেই হল ছাড়ত, তবু ছাত্রশিবিরকে ইয়ানত দিত না। কিন্তু দৃষ্টান্তমূলক প্রতিবাদ জানাতে খুব কমই দেখা গেছে। চারদলীয় জোট সরকারের সময় ছাত্রশিবিরের মিছিলে না যাওয়া কিংবা ইয়ানত না দেওয়ায় যাদের হল ছাড়তে হয়েছিল, তাদের কেউই এমন দৃষ্টান্ত স্থাপনযোগ্য প্রতিবাদ করেনি অথবা করতে পারেনি, যেমনটি আফসানা করেছে। তবে যারা ওই সময় (২০০১-০৬) সরাসরি প্রতিবাদ জানিয়েছিল তারা বিজয়ী হতে পারেনি। কারণ পরিস্থিতি ভিন্নরূপ ধারণ করত। কিন্তু বর্তমান সময়ের সম্ভাবনার ক্ষেত্রটি হলো প্রতিবাদ জানিয়ে বিজয়ী হওয়ার। আফসানা প্রতিবাদ জানিয়ে বিজয়ী হয়েছে।

সাধারণত পিতৃ সংগঠন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকলে ছাত্রসংগঠনগুলো আধিপত্য বিস্তারের নামে নিজেদের হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। ইদানীং যেহেতু ছাত্রসংগঠনগুলো নির্বাচনের ভিত্তিতে নেতৃত্ব নির্ধারিত হয় না, সেহেতু সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভালোমন্দ বিচার কিংবা ছাত্রনেতাদের উত্তম চরিত্র প্রকাশের প্রয়োজন পড়ে না। এমনকি তাঁরা এটাও চিন্তা করেন না যে তাঁদের পিতৃ সংগঠনগুলোর ক্ষমতায় আসতে সাধারণ জনগণের ভোটের মুখোমুখি হতে হয়। এ কারণে অনবরত সাধারণ শিক্ষার্থীরা হয়রানির শিকার হয় ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠন কর্তৃক। তারা কখনোই আমলে নেয় না যে একজন সাধারণ শিক্ষার্থীকে হয়রানি করার অর্থ হচ্ছে তার পরিবার তথা মা-বাবা ও আত্মীয়-স্বজনকে হয়রানি করা। স্বাভাবিকভাবেই এসব ক্ষেত্রে পরিবারের দুঃখ-কষ্টের প্রভাব পড়ে জাতীয় নির্বাচনের ওপর। একটি সাধারণ পরিবারের সন্তান বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে লাঞ্ছিত কিংবা হয়রানির শিকার হলে ওই পরিবারের সদস্যদের ভোট প্রদানের মাপকাঠি ভিন্নভাবে প্রভাবিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়।

গত বছর আমার ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ’ শিরোনামের গবেষণায় কত শতাংশ শিক্ষার্থী প্রত্যক্ষভাবে ছাত্ররাজনীতি করে—এমন একটি মাঠ জরিপে ৫ থেকে ৭ শতাংশ শিক্ষার্থী প্রত্যক্ষভাবে ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকার পরিসংখ্যান পাওয়া যায়। আর বাকি ৯৩ থেকে ৯৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর মধ্যে খুব অল্পসংখ্যক পরোক্ষভাবে ছাত্ররাজনীতিতে যুক্ত এবং বেশির ভাগই ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নয়—এই পরিসংখ্যানটি পাওয়া যায়। আবার ছাত্ররাজনীতিকে ঘৃণা করে এমন পরিসংখ্যানও উল্লেখযোগ্য। গবেষণায় দেখা গেছে, বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই ছাত্রসংসদ নির্বাচন চায়। মূলত ছাত্রসংসদ নির্বাচনের মাধ্যমেই তারা তাদের নেতৃত্ব নির্বাচন করতে চায়। নেতৃত্ব নির্বাচনের বর্তমান প্রচলিত পদ্ধতিকে তারা পছন্দ করে না।

সংগত কারণেই বর্তমান অবস্থায় ছাত্রসংসদ নির্বাচন হলে সাধারণ শিক্ষার্থী, যারা ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে মোটেও যুক্ত নয়, তারা তাদের সুচিন্তিত মতামত দিয়ে নেতৃত্ব নির্বাচন করতে পারবে। এমনকি আজকে যারা অস্ত্রের রাজনীতি করেন কিংবা কোনো শিক্ষার্থীকে অন্যায়ভাবে মিছিলে যেতে বাধ্য করেন অথবা চাঁদা দিতে বাধ্য করেন, তাঁরা নিশ্চয়ই ভোটে হেরে যাওয়ার ভয়ে এমন আচরণ থেকে বিরত থাকবেন।

‘শিক্ষা শান্তি প্রগতি’ ছাত্রলীগের মূলনীতি, অথচ বর্তমানে ছাত্রলীগ দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে খুব বেশি ইতিবাচক জায়গা করতে পারছে না। অনেক ক্ষেত্রে ছাত্রলীগ যথেষ্ট ইতিবাচক ভূমিকা পালন করলেও কিছু নেতিবাচক কার্যক্রম পর্যাপ্তসংখ্যক ইতিবাচক ভূমিকাকে ম্লান করে দিচ্ছে। যেসব ছাত্রলীগকর্মী অন্যায় ও অসংগতিমূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে, তাদের দল থেকে বহিষ্কারসহ নানা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা সত্ত্বেও নেতিবাচক কার্যক্রমগুলো বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। বেশ কিছু কারণে অনেকের কাছেই বর্তমানে ছাত্ররাজনীতি এক আতঙ্কের নামে পরিণত হয়েছে।

এখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে, তাই ছাত্রলীগ বাড়াবাড়ি করছে। আবার যখন বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় ছিল তখন ছাত্রদল এবং ছাত্রশিবির বাড়াবাড়ি করেছে। অর্থাৎ যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে সেই দলের অঙ্গ সংগঠন কিংবা ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন নিজেদের আধিপত্য খাটাতে গিয়ে সাধারণের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন করতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করে না। এতে যে তাদের মূল দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হয় সেটি তারা মোটেও বিবেচনায় আনতে চায় না কিংবা আনে না।

অনেক দিন থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে ছাত্রসংসদ নির্বাচন হচ্ছে না। এরশাদের সামরিক শাসনামলেও ডাকসু, চাকসু, রাকসুসহ সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংসদ নির্বাচন নিয়মিত হয়েছে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি হয়েছে। অথচ গণতান্ত্রিক সরকারগুলোর শাসনামলে ছাত্রসংসদ নির্বাচন হয়নি দীর্ঘ সময় থেকে।

আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মূল ফ্যাক্টর হবে দেশের ছাত্র ও তরুণ ভোটাররা। নবম সংসদ নির্বাচন থেকে এ পর্যন্ত ভোটার তালিকায় যুক্ত হওয়া দুই কোটি ৩৫ লাখের বেশি তরুণ ভোটারের হাতেই আগামী দিনের ক্ষমতার চাবি বলে মনে করা যায়। বিশেষ করে যারা নতুন ভোটার হয়েছে, তাদের বেশির ভাগই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থী কিংবা সদ্য পাস করা শিক্ষার্থী।

বিগত বিভিন্ন সংসদ নির্বাচনের ভোটের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, দশম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এক কোটি ২৩ লাখ ৫৭ হাজার ৩৭৮ ভোট পেয়েছিল (বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ১৫৩ আসন ছাড়া)। জাতীয় পার্টি পেয়েছিল ১১ লাখ ৯৯ হাজার ৭২৭ ভোট। আর নবম সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ পেয়েছিল তিন কোটি ৩৬ লাখ ৩৪ হাজার ৬২৯ ভোট। আর বিএনপি পেয়েছিল দুই কোটি ২৭ লাখ ৫৭ হাজার ১০০ ভোট। আর অষ্টম সংসদ নির্বাচনে বিএনপি পেয়েছিল দুই কোটি ২৮ লাখ ৩৩ হাজার ৯৭৮ ভোট। আর আওয়ামী লীগ পেয়েছিল দুই কোটি ২৩ লাখ ৬৫ হাজার ৫১৬ ভোট। সে হিসাবে নবম থেকে এ পর্যন্ত ভোটার তালিকায় যুক্ত হওয়া দুই কোটি ৩৫ লাখ ১২ হাজার ৯৯৭ জন তরুণ ভোটার ক্ষমতায় যাওয়ার ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করবে। এই পরিসংখ্যান থেকেও পরিষ্কার ধারণা করা যেতে পারে, ছাত্রসংগঠনগুলোর বাড়াবাড়ি কিংবা অসংগতিপূর্ণ কার্যক্রম ভোটের রাজনীতিতে কতটা প্রভাব ফেলতে পারে। কাজেই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া সচেতন শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ বাংলাদেশের রাজনীতি কিংবা ক্ষমতার চাবিকাঠির মূল নিয়ন্ত্রকে পরিণত হতে পারে। যে দলই ক্ষমতায় থাকুক আর আসুক তাদের ছাত্রসংগঠনগুলোর আধিপত্যের দম্ভ সহনীয় এবং ইতিবাচক মাত্রায় থাকা উচিত। কারণ ক্ষমতার অপচর্চাই ক্ষমতার বিড়ম্বনায় পরিণত হতে পারে।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

 

সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ

ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0035088062286377