গবেষণায় চৌর্যবৃত্তি বন্ধে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা উচিত - দৈনিকশিক্ষা

গবেষণায় চৌর্যবৃত্তি বন্ধে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা উচিত

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সময় উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার গুরুত্ব অপরিসীম। অন্যান্য দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ঠিকে থাকতে চাইলে উন্নত ও মানসম্মত গবেষণার কোনো বিকল্প নেই। তাই সরকার, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এ বিষয়ে নজর দেওয়া জরুরি।

জ্ঞানভিত্তিক সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে, টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত ও অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে তথ্য-প্রযুক্তি ও পেশাগত দক্ষতাসম্পন্ন গবেষকের চাহিদা অনেক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। মঙ্গলবার (১৯ এপ্রিল) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত উপসম্পাদকীয়তে এ তথ্য জানা যায়।

উপসম্পাদকীয়তে আরও জানা যায়, এ ক্ষেত্রে ডক্টরাল গবেষণাকে গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ পিএইচডি ডিগ্রি করতে গেলে গবেষককে গবেষণার জ্ঞানের গভীরতার পাশাপাশি তার বাস্তব প্রয়োগের দক্ষতা অর্জন করতে হয়। অর্থাৎ পিএইচডি গবেষকরা সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে অনেক বেশি অবদান রাখতে পারেন। উন্নত দেশগুলো অন্যান্য দেশের শিক্ষার্থী ও গবেষকদের গবেষণার জন্য বৃত্তি দিয়ে থাকে। কারণ একটি গবেষণার আউটপুট দেশের অর্থনীতিতে চাঞ্চল্যকর ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে। ফলে পিএইচডি ডিগ্রির মানে কোনো কম্প্রোমাইজ করা যাবে না।  
পিএইচডি বা সমমানের গবেষণার ক্ষেত্রে উন্নত দেশ বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও চিকিৎসাবিজ্ঞানে বেশি অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে চিকিৎসা ও বিজ্ঞান বিষয়ে গবেষণা কম হয়ে থাকে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁর অনেক ভাষণে চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষণার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তিনি যথার্থই বলেছেন।

বাংলাদেশেও সংখ্যাতাত্ত্বিক বিচারে পিএইচডি গবেষকের সংখ্যা বাড়ছে। তবে গুণগত মান কি সেই হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তা নিয়ে শিক্ষাবিদদের মনে প্রশ্ন রয়েছে। কারণ অনেক অধ্যাপক নিজের পিএইচডি নেই, কিন্তু তিনি নিজেই পিএইচডি ডিগ্রি দিয়ে যাচ্ছেন। যদিও তিনি যে পিএইচডি ডিগ্রি গবেষকের সুপারভাইজার হতে পারবেন না, এ রকম কোনো আইন নেই।

জার্মান তথ্য সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান স্ট্যাটিস্টার তথ্য মতে, ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষে যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে পিএইচডি বা সমমানের ডিগ্রি দেওয়া হয় এক লাখ ৮৭ হাজার ৫৬৮টি। এর মধ্যে ৮২ হাজার ৮৯৫টি ডক্টরেট ডিগ্রিই দেওয়া হয়েছে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিষয়ে গবেষণার জন্য, যা দেশটিতে ওই শিক্ষাবর্ষে দেওয়া মোট পিএইচডি ডিগ্রির ৪৪ শতাংশ। আর অন্যান্য বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি দিচ্ছে ৫৬ শতাংশ। এ থেকে বোঝা যায়, ওই সব দেশ বিজ্ঞান শিক্ষা ও গবেষণায় বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। একই প্রবণতা লক্ষ করা যায় যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। তবে আমাদের দেশে ভিন্ন চিত্র দেখা যাচ্ছে।

পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে উল্লেখ করা হয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১০-১১ থেকে ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে মোট ৭৫৩ জনকে পিএইচডি ডিগ্রি দেওয়া হয়। এর মধ্যে কলা অনুষদ থেকে ডিগ্রি দেওয়া হয় ২৮৮ জনকে, যা ৩৮ শতাংশ এবং অনুষদভিত্তিক সর্বোচ্চ। সেই হিসাবে বিজ্ঞান বিষয়ে গবেষণার সংখ্যা কম। অর্থাৎ  পিএইচডি গবেষণায় কলা ও সামাজিক বিজ্ঞানের বিষয়ে বেশি ডিগ্রি দেওয়া হয়।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের একজন অধ্যাপক পত্রিকান্তরে বলেছেন, বিজ্ঞান কিংবা প্রকৌশলের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোয় পিএইচডি ডিগ্রি কম থাকার কারণ আর্থিক। বিজ্ঞান ও প্রকৌশলের শিক্ষকরা অর্থ উপার্জনের জন্য বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন চাকরি করে থাকেন। ফলে তাঁদের হাতে সময় কম। আর অন্যদিকে কলা অনুষদের শিক্ষকদের এই সুযোগ কম থাকায় পিএইচডি শিক্ষার্থী নেন, যাতে সেখান থেকে কিছুটা অর্থ আয় করা যায়। তাঁর মতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডির যে পরিসংখ্যান, এটা নিছক সংখ্যা ছাড়া আর কিছু নয়। মান বিবেচনায় এর বেশির ভাগ পিএইচডির কাতারেই পড়ে না। এগুলো গবেষণা নয়, নামের আগে ‘ড.’ বসানোর উপায়। গুণগত মান বৃদ্ধির জন্য শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি করা জরুরি। কারণ অন্যান্য দেশের চেয়ে আমাদের শিক্ষকদের বেতন-ভাতা অনেক কম। কারণ ভারতে একজন অধ্যাপক বেতন পান মাসিক প্রায় দুই লাখ ৫০ হাজার টাকা। একজন গবেষক মাসিক ফেলোশিপ পান ৫০ হাজার টাকা।

কিন্তু আমাদের দেশে পিএইচডি গবেষণার মাধ্যমে যে প্রভাব ও সাফল্য অর্থনীতিতে আসার কথা, সেটি দৃশ্যমান নয়। কারণ গবেষণাগুলো আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হওয়ার সংখ্যা কম। আবার অনেকেই অন্যের লেখা নকল করে ডিগ্রি নিচ্ছেন। আবার এই ধরনের চৌর্যবৃত্তি করে অনেকেই পার পেয়ে যাচ্ছেন, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। তাই গবেষণার মান বৃদ্ধিতে কিছু বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। যেমন—চৌর্যবৃত্তি ঠেকাতে প্ল্যাজিয়ারিজম সফটওয়্যার দিয়ে গবেষণা প্রবন্ধ চেক করাতে হবে। অন্যের লেখা হুবহু নকল করে লেখা যাবে না। অন্যের লেখা ভিন্নভাবে লিখলে তা সম্পূর্ণ থিসিসে ১০ বা ১৫ শতাংশের বেশি হতে পারবে না। পিএইচডি ডিগ্রি পেতে হলে কমপক্ষে তিনটি প্রকাশনা ভালো মানের জার্নালে, যেমন—এসসিআই ইনডেক্স, ইএসসিআই বা স্কপুয়াক্স ইনডেক্সধারী জার্নালে থাকতে হবে। এ ছাড়া পিএইচডি ডিগ্রির জন্য কোর্স ওয়ার্ক বাধ্যতামূলক রাখা উচিত, যা ১৮ থেকে ৩৬ ক্রেডিট পর্যন্ত হতে পারে। আরো কিছু বেশি বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া দরকার, যেমন—পিএইচডি ডিগ্রির সুপারভাইজার শিক্ষক গবেষণা প্রবন্ধ কোনো শিক্ষকের কাছে যাবে, সেটা তিনি জানতে পারবেন না। এতে গোপনীয়তা বজায় থাকবে। পিএইচডি ডিগ্রির সময় তিনটি নিরপেক্ষ পরীক্ষক কমিটি কর্তৃক প্রপোজাল ডিফেন্স, প্রি-ডিফেন্স ও চূড়ান্ত ডিফেন্স বাস্তবায়ন করা উচিত। প্রত্যেক পর্যায়ে মিনিমাম মার্ক পেয়ে পাস করতে হবে। যেখানে পিএইচডি ডিগ্রি সুপারভাইজার শিক্ষক কোনো বোর্ডের সদস্য হতে পারবেন না। তিনি শুধু সুপারভাইজ করবেন। তাহলে গবেষণার গুণগত মান বাড়বে বলে মনে করি।       

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক শিক্ষক শুধু বাণিজ্যিক ও ব্যক্তিগত সুবিধার উদ্দেশ্যে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের পিএইচডির তত্ত্বাবধায়ক হচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এটি মোটেও সুখকর নয়।

শীর্ষস্থানীয় নানা পেশার কর্মকর্তারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি নেওয়ার জন্য ছুটছেন। গবেষণায় চৌর্যবৃত্তি বন্ধে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা উচিত প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ের। যাঁদের পিএইচডি ডিগ্রি করা দরকার, তাঁরাই যেন এই ডিগ্রি করেন। নামের পাশে শুধু ‘ড.’ লেখার জন্য পিএইচডি ডিগ্রি না দেওয়া হয়, সে বিষয়ে সরকারের পলিসি থাকা প্রয়োজন।   

লেখক : মো. শফিকুল ইসলাম, সাবেক সভাপতি, শিক্ষক সমিতি, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ

ফল জালিয়াতি: পদে রেখেই সচিবের বিরুদ্ধে তদন্ত - dainik shiksha ফল জালিয়াতি: পদে রেখেই সচিবের বিরুদ্ধে তদন্ত শিক্ষক-কর্মচারী বদলি নীতিমালার কর্মশালা কাল - dainik shiksha শিক্ষক-কর্মচারী বদলি নীতিমালার কর্মশালা কাল দুবাইয়ে বন্যায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা - dainik shiksha দুবাইয়ে বন্যায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি - dainik shiksha ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি ৯৬ হাজার ৭৩৬ শিক্ষক নিয়োগ, আবেদন করবেন যেভাবে - dainik shiksha ৯৬ হাজার ৭৩৬ শিক্ষক নিয়োগ, আবেদন করবেন যেভাবে ফিলিস্তিনকে সমর্থনের ‘অভিযোগে’ সেরা ছাত্রীর বক্তৃতা বাতিল - dainik shiksha ফিলিস্তিনকে সমর্থনের ‘অভিযোগে’ সেরা ছাত্রীর বক্তৃতা বাতিল মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা হতে পারে জানুয়ারিতে - dainik shiksha মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা হতে পারে জানুয়ারিতে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0072460174560547