গ্রন্থগত বিদ্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলেন না তারেক শামসুর রেহমান - দৈনিকশিক্ষা

গ্রন্থগত বিদ্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলেন না তারেক শামসুর রেহমান

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমান না ফেরার দেশে চলে গেছেন। তার এই চলে যাওয়া আমাদের জন্য অত্যন্ত বেদনার। তিনি আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন সহকর্মী ছিলেন। তার সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি, যা আমাকে তার কথা নিরন্তর মনে করিয়ে দেয়। ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দের আমি এই বিভাগে যোগদান করি। ওই সময়ে বিভাগের সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. আতাউর রহমান খান। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই এই বিভাগ থেকে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী পড়াশোনা শেষ করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। ফলে সময়ের আবর্তনে এ বিভাগ একটি ঐতিহ্যবাহী বিভাগ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। ড. তারেক শামসুর রেহমান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগে অধ্যাপনা করতেন। বুধবার (২১ এপ্রিল) দেশ রুপান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও জানা যায়, তিনি ২০০২ খ্রিষ্টাব্দের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। তার যোগদানের কিছুদিন পরই তিনি সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং অব্যবহিত পরেই বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সম্মানিত সদস্য হিসেবে মনোনীত হন। ড. তারেকের পরপরই অভিজ্ঞ শিক্ষক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রিধারী অধ্যাপক ড. আতাউর রহমান খান ইতিহাস বিভাগ থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে যোগদান করেন, ম্যানচেস্টার থেকে এমএ সম্পন্ন করে সাহাব এনাম খান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকারী নুসরাত জাহান বিভাগে যোগ দেন। এভাবে নতুন শিক্ষকদের আগমনের ফলে আমাদের বিভাগের কলেবর বৃদ্ধি পেতে থাকে। তাদের পাঠদানের ফলে আমাদের বিভাগের শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের পরিধির উন্নতি হতে থাকে।

ড. তারেক শামসুর রেহমান ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। তিনি অনেক বই লিখেছেন, যা শিক্ষার্থীদের আন্তর্জাতিক বিষয়াবলির অধ্যয়নের জন্য অন্যতম পাঠ্য ছিল। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে ইরাকযুদ্ধ-পরবর্তী আন্তর্জাতিক রাজনীতি, গণতন্ত্রের শত্রু-মিত্র, নয়া বিশ্বব্যবস্থা ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি, বিশ্ব রাজনীতির চালচিত্র, উপ-আঞ্চলিক জোট, ট্রানজিট ইস্যু ও গ্যাস রপ্তানি প্রসঙ্গ, বাংলাদেশ : রাষ্ট্র ও রাজনীতি, বাংলাদেশ : রাজনীতির ২৫ বছর, বাংলাদেশ : রাজনীতির চার দশক, গঙ্গার পানি চুক্তি : প্রেক্ষিত ও সম্ভাবনা, সোভিয়েত-বাংলাদেশ সম্পর্ক, বিশ্ব রাজনীতির ১০০ বছর ইত্যাদি। পাশাপাশি তিনি নিয়মিত পত্রিকায় কলাম লিখতেন এবং টকশোতে অংশ নিতেন, যা থেকে জাতি অনেক উপকৃত হয়।

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রবাদ ‘গ্রন্থগত বিদ্যা আর পর হস্তে ধন, নহে বিদ্যা, নহে ধন হলে প্রয়োজন’। ড. তারেক শামসুর রেহমান গ্রন্থগত বিদ্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলেন না। তার জ্ঞানের পরিধি ছিল সম্প্রসারিত, তার লিখিত বই, কলাম এবং টকশোর মাধ্যমে সেই জ্ঞানের আলো ছড়িয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, আমরা যে জ্ঞান অর্জন করি তা যদি বিলিয়ে না দিই তাহলে সে জ্ঞান অর্জন করে লাভ কী? অবশ্যই জ্ঞান বিতরণ করতে হবে, মানুষকে জানাতে হবে, যা ড. তারেক শামসুর রেহমান সারাটা জীবন নিরলসভাবে করে গেছেন।

ড. তারেক শামসুর রেহমান অবসরে যাওয়ার আগে আমাদের বিভাগের একের সঙ্গে অপরের চমৎকার সম্পর্ক বিরাজমান ছিল, সে সময়ে বিভাগের মধ্যে আন্তঃসম্পর্কের যথেষ্ট উন্নতি হয়েছিল, যা আজও বিদ্যমান রয়েছে। ড. তারেক শামসুর রেহমানের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। অবসরে যাওয়ার আগে স্যার মাঝেমধ্যেই বিভাগে আসতেন এবং আমার সঙ্গে আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করতেন। কোনো কোনো ব্যাপারে ওনার সঙ্গে আমার দ্বিমত হলেও আমরা দুজনেই যুক্তিসহ ব্যাখ্যা প্রদানের চেষ্টা করতাম এবং দুজনে একটা উপসংহারে পৌঁছাতাম। তিনি অবসরে যাওয়ার পরে পিএইচডি গবেষকদের আমার তত্ত্বাবধানে নেওয়ার অনুরোধ করেন। আমি একটি শর্তে রাজি হই যে, স্যার যুগ্ম তত্ত্বাবধায়ক থাকবেন, এ শর্তেই আমি তার অধীন গবেষকদের তত্ত্বাবধায়ক হওয়ার সম্মতি প্রকাশ করি। তিনি খুবই আলাপী ছিলেন, বিশেষ করে, আমার সঙ্গে তার অনেক সুখ-দুঃখের গল্প হতো। স্ত্রী ও একমাত্র মেয়ে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসের কারণে মাঝেমধ্যে পরিবারের কাছে যুক্তরাষ্ট্রে যেতেন। সেখানে মেয়েকে নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন সে গল্প দেশে এসে আমাকে বলতেন। মেয়েকে নিয়ে খুব গর্বিত ছিলেন এবং মেয়ের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করতেন। মেয়েকে যেমন ভালোবাসতেন, আবার দেশকে ভালোবেসে বারবার দেশে ফিরে আসতেন।

তিনি সোভিয়েত-বাংলাদেশ সম্পর্ক ১৯৭২-৭৫ শিরোনামে জার্মানির একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। আমি নিজেও বাংলাদেশ-সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্ক ১৯৮০-১৯৯০ শিরোনামে এমফিল ডিগ্রি অর্জন করেছি। ওই সময় আমার এমফিল গবেষণার তত্ত্বাবধায়ক অধ্যাপক ড. তাইবুল হাসান খানের পরামর্শ মোতাবেক সরকার ও রাজনীতি বিভাগে ড. তারেকের কাছে পরামর্শের জন্য যেতাম। ওই সময় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ইউরোপিয়ান ডেস্কের মহাপরিচালক ছিলেন ড. ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী, তিনি নিজেও অস্ট্রেলিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ওপর পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি পরবর্তীকালে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা হয়েছিলেন। আমার এমফিল গবেষণার সুবিধার্থে তার সঙ্গে স্যার আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। যার ফলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এমফিল গবেষণার কাজে অবাধ যাতায়াত করতে পেরেছিলাম এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে অনেক মূল্যবান তথ্য পেয়েছিলাম। যা আমার গবেষণাকে অনেক সমৃদ্ধ করেছে।

স্যার মৃত্যুর আগে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, বমিও করেছিলেন। একই রকম ঘটনা ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে আমাদের বিভাগে ক্লাস নেওয়ার সময় হয়েছিল। সেবার হঠাৎ তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, আমি তাৎক্ষণিকভাবে তাকে এনাম মেডিকেলে নিয়ে যাই, পথিমধ্যে স্যার বেশ কয়েকবার গাড়ির মধ্যে বমি করেছিলেন। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের ঘটনার সঙ্গে তার মৃত্যুবরণ করা রাতের ভয়াল ঘটনার মিল খুঁজে পাই। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের ঘটনার পরে যুক্তরাষ্ট্রে উন্নত চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসকরা তাকে বলেছিলেন, হাসপাতালে নিতে দেরি হয়ে গেলে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারত, এমনকি জীবননাশের সম্ভাবনাও ছিল। ফলে তিনি আমার প্রতি অনেক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

ড. তারেক শামসুর রেহমান সুদীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে অনেক ছাত্রছাত্রীর মধ্যে জ্ঞানের আলো ছড়িয়েছেন। তিনি তাদের হৃদয়ে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

লেখক : ড. মো. আবদুল্লাহ হেল কাফী, সভাপতি, অ্যালামনাই অব আইআর ও সাবেক চেয়ারম্যান, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ - dainik shiksha আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0070509910583496