সময় পেয়েও বাড়ানো হয়নি টিকাকেন্দ্রের সংখ্যা। হুট করেই আবার পাল্টানো হচ্ছে কেন্দ্র্র। নেই সঠিক পরিকল্পনা। হিমশিম খেয়ে কমানো হচ্ছে প্রতিদিনের টিকা দেওয়ার টার্গেট শিক্ষার্থীর সংখ্যা। নেই প্রচারের ব্যবস্থাও। আর এভাবেই চট্টগ্রামে শিক্ষার্থীদের টিকা দেওয়া নিয়ে তৈরি হয়েছে হযবরল অবস্থা। এমন অব্যবস্থাপনা ও অপরিকল্পিত সিদ্ধান্তের কারণে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের। গতিহীন ক্যাম্পেইনে টিকা নিতে গিয়ে প্রতিনিয়ত ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে তাদের। এমন পরিস্থিতির কারণে সিভিল সার্জন দোষ চাপাচ্ছেন সিটি করপোরেশন ও শিক্ষা বিভাগের ওপর। তবে ভিন্ন কথা বলছে শিক্ষা প্রশাসন।
হুহু করে করোনার সংক্রমণ বাড়ছে চট্টগ্রামেও। এক ডোজ টিকা ছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সশরীরে ক্লাস করতে পারবে না ১২ থেকে ১৮ বছর বয়সী শিক্ষার্থীরা, সরকারের পক্ষ থেকে এমন নির্দেশনা এলেও এখনও টিকার আওতায় আসেনি ছয় লাখের বেশি শিক্ষার্থী। প্রায় দুই মাস আগে চট্টগ্রামে শিক্ষার্থীদের টিকা কার্যক্রম শুরু হলেও মাত্র ৮ শতাংশ শিক্ষার্থী এসেছে টিকার আওতায়।
চট্টগ্রাম জেলা শিক্ষা অফিসের তথ্যমতে, মহানগর ও উপজেলায় ১২ থেকে ১৮ বছর বয়সী শিক্ষার্থীর সংখ্যা আট লাখ ৬৪ হাজার ৭২। যাদের মধ্যে মহানগরীতেই রয়েছে দুই লাখ ৭০ হাজার ৮৯৮ জন। পাঁচ লাখ ৯৩ হাজার ১৭৪ জন শিক্ষার্থী রয়েছে উপজেলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে। এর মধ্যে বিদ্যালয় শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছয় লাখ ৪০ হাজার ২৩৮, কলেজ শিক্ষার্থীর সংখ্যা এক লাখ ১০ হাজার ৬১২ এবং মাদ্রাসা শিক্ষার্থীর সংখ্যা এক লাখ ১৩ হাজার ২২৩। মহানগরের মধ্যে সর্বোচ্চ ৭৯ হাজার ৩৯৫ জন শিক্ষার্থী রয়েছে পাঁচলাইশ থানা এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৭১ হাজার ১৩৬ জন শিক্ষার্থী রয়েছে বায়েজিদ থানা এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। এ ছাড়া কোতোয়ালি থানা এলাকায় ৫৭ হাজার ৭০৮, কর্ণফুলীতে ৪২ হাজার ৩৪৭ এবং পাঁচলাইশ থানা এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে রয়েছে ২০ হাজার ৩১২ জন শিক্ষার্থী। উপজেলার মধ্যে সর্বোচ্চ ৬৩ হাজার ৬৫৬ জন শিক্ষার্থী রয়েছে পটিয়ার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয়। এ ছাড়া বাঁশখালীর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৬৩ হাজার ১৮০, হাটহাজারীতে ৬২ হাজার ২২৩, মিরসরাইয়ে ৫৬ হাজার ১২২, ফটিকছড়িতে ৫১ হাজার ৬১, সাতকানিয়ায় ৪৬ হাজার ৩৯৯ এবং লোহাগাড়া উপজেলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সবচেয়ে বেশি ৩৭ হাজার ৭৭৪ জন শিক্ষার্থী রয়েছে।
এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের টিকাদান কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে গত বছরের ১৫ নভেম্বর থেকে চট্টগ্রামে শুরু হয় টিকাদান কার্যক্রম। হঠাৎ করোনার চোখ রাঙানিতে গত ৯ জানুয়ারি টিকা ছাড়া কোনো শিক্ষার্থী ক্লাসে প্রবেশ করতে পারবে না বলে আদেশ দেয় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। এর মাঝখানে প্রায় দু'মাস চলে গেলেও দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি টিকা কার্যক্রমে। চট্টগ্রামে এ পর্যন্ত যেসব শিক্ষার্থীকে টিকার আওতায় আনা হয়েছে, এর বেশিরভাগই আবার সরকারি প্রতিষ্ঠানের। এখনও অধিকাংশ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা রয়ে গেছে টিকার বাইরে। মহানগরের পাশাপাশি উপজেলা পর্যায়েও কাঙ্ক্ষিত সংখ্যক শিক্ষার্থীকে আনা যায়নি টিকার আওতায়। দু'মাস আগে একসঙ্গে ছয়টি কেন্দ্রে টিকা কার্যক্রম শুরুর কথা বললেও সেটিও দেখেনি আলোর মুখ।
গত ১০ জানুয়ারি থেকে মহানগরে স্কুলের বাইরে গিয়ে তিনটি কমিউনিটি সেন্টারে বিশেষ ক্যাম্পেইন শুরু করে প্রশাসন। তবে কেন্দ্রের তুলনায় টিকাপ্রত্যাশী শিক্ষার্থীর সংখ্যা বহুগুণ বেশি হওয়ায় কার্যক্রম চালাতে দিশেহারা হয়ে যান দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা। এ কারণে বিশেষ ক্যাম্পেইন শুরুর দু'দিনের মাথায় জরুরি বৈঠক করে নতুন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয় জেলা প্রশাসন, সিভিল সার্জন কার্যালয় ও জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে এরই মধ্যে বাতিল করা হয় নতুন একটি কেন্দ্রে টিকা প্রয়োগের সিদ্ধান্তও। বিশেষ এ ক্যাম্পেইনে প্রতিদিন ২৫ হাজার শিক্ষার্থীকে টিকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু টিকাপ্রত্যাশীদের বাড়তি চাপ সামাল দিতে সেটি কমিয়ে এখন ১৭ হাজারে আনা হয়েছে। সরেজমিন কয়েকটি কেন্দ্র ঘুরে টিকা পেতে শিক্ষার্থীদের দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষায় থাকতে দেখা যায়। বাড়তি চাপের কারণে প্রতিটি কেন্দ্রের সামনের সড়কজুড়ে সৃষ্টি হচ্ছে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের জটলা। যে কারণে তৈরি হচ্ছে তীব্র্র যানজটের; ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে নগরবাসীকেও।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. মো. ইলিয়াছ চৌধুরী বলেন, 'এটি মূলত চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ও শিক্ষা বিভাগের কাজ। এতদিনেও শিক্ষা বিভাগ আমাদের শিক্ষার্থীদের চূড়ান্ত টার্গেট সংখ্যা কত, সেটিও দিতে পারেনি। তাদের জিজ্ঞেস করুন, তারা কী করছে? এমন অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে, যারা সামগ্রিক কথা চিন্তা না করে কেবল নিজেদের প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের টিকা দিতে চাইছেন। চট্টগ্রামেও সংক্রমণ বাড়ছে, এটি সবার জন্যই দুশ্চিন্তার। ঢাকায় এরই মধ্যে করোনার নতুন ওমিক্রন ধরন শনাক্ত হয়েছে। চট্টগ্রামেও এ ধরন ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।'
চট্টগ্রামের জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মুহাম্মদ ফরিদুল আলম হোসাইনী বলেন, 'আমি কারও ওপর দোষ চাপাতে চাই না। শিক্ষার্থীদের সবার টিকা প্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছি প্রতিনিয়ত। আট লাখ ৬৪ হাজারের বেশি টার্গেট শিক্ষার্থীর একটি তালিকা সিভিল সার্জন কার্যালয়ে দিয়েছি। তবে শিক্ষার্থীর সংখ্যা আরও বাড়বে। কারণ অনেক কওমি মাদ্রাসাসহ তালিকার বাইরে রয়েছে আরও বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। যাদের অনেকে এরই মধ্যে টিকা পেতে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে।'
দুই মেয়েকে নিয়ে টিকা দিতে আসা সিঅ্যান্ডবি এলাকার বাসিন্দা কানিজ আরা বেগম বলেন, 'সরকার বলছে টিকা ছাড়া ক্লাসে যাওয়া যাবে না। আর টিকা নিতে এসে পড়তে হচ্ছে সীমাহীন দুর্ভোগে। শিক্ষার্থীর তুলনায় কেন্দ্রের সংখ্যা কম হওয়ায় দুর্ভোগ বেশি হচ্ছে।'
আরেক শিক্ষার্থীর অভিভাবক সুজয় চৌধুরী বলেন, 'অব্যবস্থাপনা ও সঠিক পরিকল্পনার অভাবেই শিক্ষার্থীদের টিকা কার্যক্রমে নানা জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে। এত ভিড়ের মধ্যে করোনা সংক্রমণ বাড়ার আশঙ্কা বেশি। বিষয়টি শিক্ষার্থীদের মতো আমাদের জন্যও আতঙ্কের।'
দুই বছর ধরে চট্টগ্রামে করোনা নিয়ে একাধিক গবেষণায় নেতৃত্ব দেওয়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আদনান মান্নান
বলেন, 'যারা করোনা ভ্যাকসিন নেয়নি তাদের তুলনায় প্রথম ডোজ টিকা নেওয়াদের শরীরে প্রায় তিন গুণ বেশি অ্যান্টিবডি তৈরি হওয়ার প্রমাণ গবেষণায় পেয়েছি আমরা। এতে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও থাকে কম। শিক্ষার্থীদের দ্রুত টিকার আওতায় আনা গেলে সংক্রমণের হার অনেকটা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে।'