প্রতি বছর মেডিকেলে ভর্তির সময় এলেই সামনে আসে স্বাস্থ্য চিকিৎসা শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন। বিশেষ করে অধিকাংশ বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার মান নিয়ে কথা উঠছে দীর্ঘদিন ধরেই। দেশে বেসরকারি মেডিকেল কলেজের যাত্রা আশির দশকের মাঝামাঝিতে। সরকারি অনুমোদন পেয়ে ক্রমেই এসব প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ছে। চিকিৎসকের সংখ্যাও বাড়ছে। তবে এসব প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করে বের আসা চিকিৎসকদের গুণগত মান নিয়ে সংশয় আছে অনেকেরই। সরকারের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ৩৭টি সরকারি ও ৭২টি বেসরকারি মেডিকেলে কলেজ রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্বের অনেক দেশেই সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগে চিকিৎসা শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। রাষ্ট্রীয় বাধ্যবাধকতা ও মানদণ্ড পূরণ করে সেসব দেশে এসব প্রতিষ্ঠান মানসম্পন্ন চিকিৎসা শিক্ষা নিশ্চিত করছে। গবেষণা ও স্বাস্থ্যসেবায় তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখছে। কিন্তু দেশে চিকিৎসা শিক্ষার উন্নয়নে বৈশ্বিক অভিজ্ঞতাগুলো আমরা কাজে লাগাতে পারছি না। তারা বলেন, গত কয়েক বছরে সরকারি-বেসরকারি এই দুই খাতে মেডিকেল কলেজের সংখ্যা যেমন বেড়েছে; সেই সঙ্গে এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় শিক্ষাদানে দক্ষ চিকিৎসকের সংকটও বেড়েছে। মৃত্যু ও অবসরসহ স্বেচ্ছায় পদত্যাগজনিত কারণে মেডিকেল কলেজগুলোতে মৌলিক বিষয়ে পাঠদানের জন্য অভিজ্ঞ ও সিনিয়র শিক্ষকের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমছে। ফলে হাজারো শিক্ষার্থীর একাডেমিক শিক্ষা কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
জানা যায়, অধিকাংশ মেডিকেল কলেজে অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও সহকারী অধ্যাপকের পদের তুলনায় শিক্ষক স্বল্পতার কারণে সাধারণ এমবিবিএস পাস করা ডাক্তাররা শিক্ষার্থীদের ক্লাস নিচ্ছেন। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা জানান, চিকিৎসা শিক্ষায় অ্যানাটমি, ফিজিওলজি, বায়োকেমিস্ট্রি, মাইক্রোবায়োলজি, ফরেনসিক মেডিসিন, ফার্মাকোলজি ও প্যাথলজিকে মৌলিক বিষয় বলা হয়। এ ৭টি মৌলিক বিষয়ের দুএকটি ছাড়া অধিকাংশ বিষয়ে প্রাইভেট
প্র্যাকটিস বা অন্যকোনো উপায়ে অর্থ উপার্জনের সুযোগ না থাকায় জুনিয়র ডাক্তারদের কেউ আর এখন এসব বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করে শিক্ষকতা পেশায় আসতে চাইছেন না।
বেসরকারি মেডিকেল কলেজের মান নিয়ে অভিযোগ প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিংহভাগ বেসরকারি মেডিকেল কলেজই পরিচালন নীতিমালা মানছে না। শিক্ষক স্বল্পতা ও অন্য জনবল ঘাটতির পাশাপাশি বেসরকারি অনেক মেডিকেল কলেজের নেই নিজস্ব জমি। কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদা কলেজ ও আলাদা হাসপাতাল ভবন নেই। ফলে শিক্ষার্থীরা ব্যবহারিকভাবে বিষয়টি শিখতে পারছেন না। শিক্ষা সরঞ্জামের ঘাটতির পাশাপাশি প্রয়োজনীয় ল্যাব সুবিধা, পরীক্ষা নেয়ার জন্য সুনির্দিষ্ট রুম, মিলনায়তনও নেই। কিছু বেসরকারি মেডিকেল কলেজ নির্ধারিত শিক্ষাক্রমও অনুসরণ করছে না। সব মিলিয়ে দেশে বেসরকারি উদ্যোগে চলা চিকিৎসা শিক্ষার অবস্থা হতাশাজনক। এসব সমস্যা সমাধানে বারবার তাগাদা দেয়া হলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এ বিষয়ে আগ্রহ কম। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায়। আর এসব মানহীন মেডিকেলে কলেজ থেকে মানহীন চিকিৎসক তৈরি হচ্ছে। রোগীর জীবন ঝুঁকিতে পড়ছে।
এসব অনিয়মের কারণে বিভিন্ন সময় সমালোচিত হয়েছে বিভিন্ন বেসরকারি মেডিকেল কলেজ। এর মধ্যে কেয়ার মেডিকেল কলেজ, নাইটিংগেল মেডিকেল কলেজ, আশিয়ান মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, আইচি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ আরো কয়েকটি মেডিকেল কলেজ অন্যতম। পর্যাপ্ত শিক্ষক ও ফরেনসিক ল্যাবে আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতির সংকটের পাশাপাশি বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) নিবন্ধন না থাকার পরও ভর্তি কার্যক্রম চালিয়ে গেছে এই প্রতিষ্ঠানগুলো। বাংলাদেশে স্বাস্থ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর স্নাতক, স্নাতকোত্তর এবং কর্মকালীন প্রশিক্ষণ- প্রভৃতি শিক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশে ভূমিকা রাখছে মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান ও মেডিকেল কলেজ।
চলতি বছরের ৩০ মার্চ সংসদে উত্থাপিত হয়েছে বেসরকারি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজ পরিচালনায় বিল। বিলে বলা হয়েছে, বেসরকারি মেডিকেল কলেজ বা ডেন্টাল কলেজের প্রত্যেক বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত হবে ১:১০। এসব প্রতিষ্ঠানে কোনো বিভাগের খণ্ডকালীন শিক্ষকের সংখ্যা সংশ্লিষ্ট বিভাগের অনুমোদিত পদের শতকরা ২৫ শতাংশের বেশি রাখা যাবে না। এসব কলেজ অন্যূন ৫০ জন শিক্ষার্থীর আসন বিশিষ্ট হতে হবে। বেসরকারি মেডিকেল কলেজ স্থাপনের জন্য মেট্রোপলিটন এলাকায় কমপক্ষে ২ একর এবং ডেন্টাল কলেজের জন্য ১ একর জমি থাকতে হবে। অন্য এলাকায় এই জমির পরিমাণ যথাক্রমে ৪ একর ও ২ একর হতে হবে। এই জমি সংশ্লিষ্ট কলেজের নামে নিরঙ্কুশ, নিষ্কণ্টক, অখণ্ড ও দায়মুক্ত হতে হবে। মেডিকেল কলেজ বা ডেন্টাল কলেজ এবং এর অধীনে পরিচালিত হাসপাতাল কোনোভাবেই ইজারা বা ভাড়া নেয়া জমিতে বা ভবনে স্থাপন করা যাবে না। প্রত্যেক বেসরকারি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজের সব শিক্ষার্থীর ভর্তি ফি সরকার নির্ধারণ করবে। কোনো মেডিকেল বা ডেন্টাল কলেজ কাউন্সিলের অনুমোদন না নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করলে ১ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। ৫ শতাংশ আসন অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের জন্য না রাখলে এবং অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তি করলে একই দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। সেই সঙ্গে সরকারের অনুমতি ছাড়া নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি করলে ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। বিলটি আইন হিসেবে কার্যকর হওয়ার ১ বছরের মধ্যে আগেই স্থাপিত মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজগুলোকে এ বছরের মধ্যে বিধান মেনে অনুমোদন নিতে হবে।
দেশে চিকিৎসা শিক্ষার মান সম্পর্কে তার মূল্যায়ন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব বলেন, মেডিকেল কলেজের শিক্ষাকে এখন বাণিজ্যের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। শিক্ষা এখন পণ্যে রূপান্তরিত হয়েছে। বাণিজ্যের বিষয়টিকে কম গুরুত্ব দিয়ে যদি আধুনিকায়ন শিক্ষার দিকে মনোযোগ দিলে এই অবস্থা হতো না। এর পরে আছে দুর্বৃত্তায়ন, সমাজের চাপ। যা প্রতি রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে। এ থেকে আমাদের উত্তোরণ না হলে সামনে সম্মুখ বিপদ।
তবে হাতে গোনা ৪-৫টা প্রতিষ্ঠান ছাড়া অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই মানসম্মত বলে দাবি করেন বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ এসোসিয়েশনের সভাপতি এম এ মবিন খান। তিনি বলেন, কিছু বেসরকারি মেডিকেল কলেজের মান খারাপ। বাস্তবতা হলো কিছু সরকারি মেডিকেল কলেজের মান নিয়েও প্রশ্ন আছে। তবে সংখ্যার বিচারে অধিকাংশ বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষাই মানসম্মত। তবে যেসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন আছে সরকার ইতোমধ্যেই তাদের বিরুদ্ধে কঠিন ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে। মানসম্মন চিকিৎসা শিক্ষা নিশ্চিত করতে আমরা অসংখ্য মিটিং করেছি। দেশ ও জাতির স্বার্থে কীভাবে এই শিক্ষার গুণগত মান উন্নত করা যায় সেই লক্ষ্যে আমরা আমাদের সদস্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলছি। সবাই মিলে এই ব্যাপারে কাজ করছি।