চুরির অভিযোগে বরখাস্ত বিতর্কিত ‘শিক্ষক নেতা’ রনি - দৈনিকশিক্ষা

চুরির অভিযোগে বরখাস্ত বিতর্কিত ‘শিক্ষক নেতা’ রনি

নিজস্ব প্রতিবেদক |

এমপিও করিয়ে দেওয়ার নামে সহকর্মীদের কাছ থেকে ঘুষ নেওয়া, স্কুলের টাকা চুরিসহ বিভিন্ন অভিযোগে বরখাস্ত করা হয়েছে ঘটনাক্রমে শিক্ষক পদে চাকরি পাওয়া এবং স্ব-ঘোষিত শিক্ষক নেতা নজরুল ইসলাম রনিকে। গতকাল শনিবার রাজধানীর মীরপুর সিদ্ধান্ত হাইস্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সভায় প্রধান শিক্ষক রনিকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে নয় মাসে সাড়ে পাঁচলাখ টাকার আর্থিক অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া এবং সহকর্মীদের কাছ থেকে ঘুষ নেওয়ায় এমন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানা যায়।  

স্কুলসূত্র দৈনিক শিক্ষাডটকমকে জানায়, অভিযোগ থাকলেও ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির সঙ্গে রনির সখ্য থাকায়  তাকে বরখাস্ত করতে  গড়িমসি করার অভিযোগ ওঠে। গত তিনদিন ধরে সভাপতি ও রনির ছবি দিয়ে পোস্টারিং করা হয় মিরপুর এলাকায়। বাধ্য হয়ে গতকাল শনিবার রনিকে বরখাস্ত করা হয়।

স্কুলটির শিক্ষক আতিকুর রহমান শনিবার সকাল দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, স্কুলের ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর-এই নয়মাসের নিজস্ব অডিটে রনির বিরুদ্ধে টাকা চুরির অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। ম্যানেজিং কমিটি এই ছয় সদস্যের কমিটি গঠন করেছে। কমিটিতে স্কুলের শিক্ষকরাই ছিলেন। টাকা চুরির তথ্য ব্যাংক স্টেটমেন্টেই পরিষ্কার।  

বিএনপি-জামাতপন্থী হিসেবে পরিচিত শিক্ষক রনিকে বরখাস্ত করার পর ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক করা হয়েছে জোতির্ময় সেন নামের স্কুলেরই একজন সিনিয়র শিক্ষককে।

শিক্ষক আতিকুর রহমান জানান, আসলে রনির হওয়ার কথা ছিলো সদরঘাট বা কমলাপুর এলাকার মোবাইল ছিনতাইচক্রের নেতা অথবা শিক্ষাখাতের এমপিওর দালাল কিংবা বিএনপি জামাতের মিছিল থেকে পুলিশের ওপর ইটা নিক্ষেপকারী, কিন্তু ঘটনাক্রমে শিক্ষক পদে চাকরি নিয়েছেন। জালিয়াতি করে এমপিওভুক্তও হয়েছেন। তথ্য গোপন করে প্রধান শিক্ষকও হয়েছেন। ফেসবুক আর ইমেইল সহজলভ্য হওয়ায় নিজেকে শিক্ষক নেতাও ঘোষণা করেছেন। আসলে রনি একটা ফেসবুকিয় টাউট। আর জাতীয়করণ শব্দটা বারবার উচ্চারণ করে সাধারণ শিক্ষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এটাই টাউটদের লক্ষণ। গত সপ্তাহে রাজধানীর মগবাজার এলাকার একটি সংস্থা পরিচালিত স্কুলে জামাত-বিএনপিপন্থী ও দুর্নীতিবাজ কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে বৈঠক করে নিজের বরখাস্ত আদেশ ঠেকানোর চেষ্টা করেছেন রনি। বৈঠকে রিটের নামে টাকা তুলে ভাগাভাগিতে অমিল হওয়ার মারামারিতে লিপ্ত হওয়া মগবাজার এলাকার জামাতী শিক্ষক এনামুল ইসলাম মাসুদ ও স্বঘোষিত ও ফেসবুকীয় বেহায়া ছইদুর রহমান ও চুরির দায়ে অভিযুক্ত অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আবুল বাশার হাওলাদারসহ কয়েকজন ছিলেন।   

আতিকুর রহমান আরো জানান, নিবন্ধন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া ছয়জন শিক্ষককে এমপিও করিয়ে দেওয়ার নামে সোয়ালাখ টাকা নিয়েছেন রনি। এতদিন ভয়ে এগুলো আমরা বলিনি। এসবের তথ্য-প্রমাণ রয়েছে। মগবাজার এলাকার একজন প্রধান শিক্ষক সমিতির নেতার সঙ্গে বৈঠকে রনি চুক্তি করেছেন, যদি বরখাস্ত করা হয় তাহলে রনির পক্ষে বিবৃতি প্রচার করাবেন সমমনা কয়েকজন প্রধান শিক্ষককে দিয়ে। ফেসবুকের গ্রুপে লেখানো হবে ম্যানেজিং কমিটির বিরুদ্ধে। নামধারী সাংবাদিকদের দিয়ে লেখানো হবে রনিকে ‘অন্যায়ভাবে বরখাস্ত’ করা হয়েছে ইত্যাদি। লোকভাড়া করে মানববন্ধন করানো হবে রনির পক্ষে! ভুয়া ফেসবুক আইডি দিয়ে রনিকে জাতীয়করণের নেতা বলা হবে! নেপথ্যে থেকে এসবের নেতৃত্ব দেবেন কুমিল্লা অঞ্চল থেকে আসা সেই প্রধান শিক্ষক। উপরে উপরে আওয়ামী লীগ হলেও রক্তেমাংশে জামাতী মগবাজার এলাকার এই প্রধান শিক্ষক সমিতির নেতা। 

নাম প্রকাশে অনিচছুক মীরপুর সিদ্ধান্ত হাইস্কুলের আরেকজন শিক্ষক বলেন, এর আগে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে দৈনিক ভোরের কাগজে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের রনিকে মোবাইল চোর হিসেবে উল্লেখ করা হয়। মিরপুর এলাকার আওয়ামী লীগের এমপি এই রনির বিরুদ্ধে ডিও লেটার দেন। সেখানে রনির অপকর্মের ফিরিস্তি দেওয়া হয়েছে। ভোরের কাগজে প্রতিবেদন প্রকাশের পর কল্যাণট্রাস্টের একজন বিতর্কিত নেতার সঙ্গে গোপনে মাফ চেয়ে আসেন রনি। মুচলেকা দেন রনি।  

তিনি বলেন, তথ্য গোপন করে প্রথমে জান্নাত একাডেমি হাইস্কুলের প্রধানশিক্ষক পদে ও পরে রাজধানীর মীরপুর সিদ্ধান্ত হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক পদ বাগান রনি। মূলত এমপিওর দালাল রনি। ফেসবুক ব্যবহার করে নেতা পরিচয় দেওয়ায় দালালি করতে সুবিধা হয়। বদলি ও এমপিওর দালালি নিয়ে রনির বিরুদ্ধে ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনে ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। মনজুরুল করিম পলাশের করা তালাশের সেই প্রতিবেদন এখনও ইউটিউবে পাওয়া যায়।

বরখাস্ত ও টাকা চুরির অভিযোগের বিষয়ে নজরুল ইসলাম রনির মতামত জানার চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। 

বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির নেতারা দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেছেন, ‘টাকা চুরি ও এমপিওর নামে ঘুষ নেওয়ার দায় যার যার, সংগঠন দায় নেবে না। নানা অভিযোগে রনিকে অনেক আগেই বহিস্কার করা হয়েছে। তবুও তিনি নিজেকে সংগঠনের সভাপতি দাবি করেন।’

‘রনির মতো মানুষ শিক্ষকতা পেশায় ঢুকে পড়েছে বলেই শিক্ষকদের নিয়ে আজ যে যা খুশী মন্তব্য করতে পারেন। রনিদের চিরতরে বরখাস্ত করতে প্রকৃত শিক্ষকরা সহযোগীতা করে পেশার মান রক্ষার আহ্বান জানানো হয়।’ 

‘শিক্ষক নেতার বিচার চেয়ে এমপির ‘ডিও’ ‘ শিরোনামে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি দৈনিক ভোরের কাগজে প্রকাশিত প্রতিবেদন : 

একসময় তিনি ছিলেন বিএনপি সমর্থিত শিক্ষক সংগঠনের অর্থ সম্পাদক। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ভোল পাল্টে নৌকার সমর্থক বনে যান। কোনো ধরনের চোটপাট না করে নিজেই একটি শিক্ষক সংগঠন খুলে বসেন। এরপর দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণের দাবিতে কিছু শিক্ষককে নিয়ে আন্দোলনে নামেন। নিজেই নিজের পদ ঘোষণা করে বলেন, এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ লিয়াজোঁ ফোরামের ‘মুখপাত্র’ তিনি। এরপর জাতীয়করণের দাবিসহ শিক্ষা প্রশাসনের নানা ইস্যুতে সরকারবিরোধী কাজ শুরু করেন।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, স্বঘোষিত এই শিক্ষক নেতা রাজধানীর মিরপুরের সিদ্ধান্ত হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক নজরুল ইসলাম রনি। তার কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ হওয়ার পর বিচার চেয়ে গত ১১ জানুয়ারি শিক্ষামন্ত্রী বরাবর ‘ডিও’ লেটার দিয়েছেন স্থানীয় সাংসদ মো. আসলামুল হক। এছাড়া করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার যেখানে দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখেছে সেখানে এই শিক্ষক নেতা তার স্কুল খোলা রেখে ক্লাস-পরীক্ষা চালু রেখেছেন। এমন অভিযোগ পেয়ে রাজধানীর দারুস সালাম থানার ওসি তোফায়েল আহমেদ গতকাল বুধবার প্রধান শিক্ষক নজরুল ইসলাম রনিকে থানায় ডেকে নিয়ে জেরা করেছেন। জানতে চাইলে ওসি তোফায়েল আহমেদ ভোরের কাগজকে বলেন, সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখলেও সিদ্ধান্ত হাইস্কুলসহ আরো কয়েকটি স্কুলে ক্লাস-পরীক্ষা চলছে এমন অভিযোগ পাওয়ার পর প্রধান শিক্ষক নজরুল ইসলাম রনিকে ডেকে নিয়ে এসে মূল ঘটনা জানতে চেয়েছিলাম। প্রধান শিক্ষক অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, দশম শ্রেণির সংক্ষিপ্ত সিলেবাস বিতরণের জন্য শিক্ষার্থীদের স্কুলে ডাকা হয়েছিল। ক্লাস-পরীক্ষা হয়নি। এরপর আমি রনি সাহেব বলে দিয়েছি, কোনোভাবেই সরকারের নিয়ম ভাঙা যাবে না।

এদিকে নজরুল ইসলাম রনির বিচার চেয়ে গত ১১ জানুয়ারি শিক্ষামন্ত্রী বরাবর স্থানীয় সাংসদ যে ডিও লেটার দিয়েছেন তা ভোরের কাগজের কাছে এসেছে। ওই ডিও লেটারে সাংসদ আসলামুল হক লিখেছেন, আমার নির্বাচনী এলাকার মিরপুর সিদ্ধান্ত হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক নজরুল ইসলাম রনির বিরুদ্ধে ওঠা এমপিও জালিয়াতি, সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকা ও জাতির পিতার ছবি অবমাননার বিষয়ে বিভাগীয় তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে হবে। ওই ডিও লেটারে সাংসদ আরো লেখেন, ১৯১৭ সালে মিরপুর সিদ্ধান্ত হাইস্কুল প্রতিষ্ঠিত হলেও বর্তমান প্রধান শিক্ষক নজরুল ইসলাম রনির কর্মকাণ্ডে বিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি প্রায় ধ্বংসের পথে। ২০০০ সালের ১৪ মে মিরপুর জান্নাত একাডেমি হাইস্কুলের সৃষ্ট পদে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন তিনি। ওই সময়ে বিধি অনুযায়ী এমপিওভুক্তির সুযোগ না থাকলেও নিয়মবহির্ভূতভাবে অবৈধ উপায়ে তৎকালীন জান্নাত একাডেমির অবসরপ্রাপ্ত সহকারী প্রধান শিক্ষক নজরুল ইসলামের ইনডেক্স নম্বর জালিয়াতি করে এমপিওভুক্ত হন। পরে সিদ্ধান্ত হাইস্কুলে এসে প্রধান শিক্ষক হন এই বিএনপি নেতা। চারদলীয় জোটের আমলে শিক্ষক সমিতির নেতা সেলিম ভূঁইয়ার কমিটির অর্থ সচিবও ছিলেন। এছাড়া মোবাইল চুরির দায়ে জেল খাটা আসামি তিনি। ডিও লেটারে আরো লেখা হয়, আমার নির্বাচনী এলাকায় বিএনপি-জামায়াতের গোপন বৈঠকের সময় ৩০ জন শিক্ষকসহ হাতেনাতে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন রনি। এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত করে তাকে চাকরি থেকে বহিষ্কারের কথাও বলা হয় ওই ডিও লেটারে।

ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0040252208709717