ছাত্রকে ধর্ষণের অভিযোগে মাদরাসা শিক্ষক গ্রেফতার - দৈনিকশিক্ষা

ছাত্রকে ধর্ষণের অভিযোগে মাদরাসা শিক্ষক গ্রেফতার

নরসিংদী প্রতিনিধি |

দশ বছরের ছোট্ট এক ছেলেশিশু। তাকে রমজানের প্রথম দিন মাদরাসার একটি কক্ষে ধর্ষণ করেছে তারই এক শিক্ষক। এরপর ঘটনা ধামাচাপা দিতে চলে নানা কূটকৌশল। ভুক্তভোগী পরিবারের সঙ্গে দেন-দরবার করে মাদরাসার পরিচালনা কমিটির সদস্য ও প্রিন্সিপাল বিষয়টি মিটমাট করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। মাদরাসার ভাবমূর্তি রক্ষার কথা বলে বিষয়টি যাতে পুলিশ পর্যন্ত না পৌঁছায়, সেটি নিশ্চিত করতেও চেষ্টা চালানো হয়।

ঘটনার তিন দিন পর গত শনিবার মাদরাসার ভেতরেই সালিশের আয়োজন করা হয়। ওষুধ-মলম ও তার সঙ্গে পাঁচ-সাত হাজার টাকার বিনিময়ে ঘটনাটি চেপে যাওয়ার 'রায়' দেয় সালিশ আয়োজকরা। তবে এরই মধ্যে খবরটি পুলিশ পর্যন্ত পৌঁছে যায়। সালিশ থেকেই শনিবার অভিযুক্ত শিক্ষক নজরুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে নরসিংদীর মাধবদী থানা পুলিশ। গতকাল রোববার শিশুটির মেডিকেল পরীক্ষায় ধর্ষণের আলামত পাওয়া গেছে।

শিশুটির বাবা পেশায় একজন অটোরিকশাচালক। ছেলের সঙ্গে ঘটা ঘটনা নিয়ে গতকাল সমকালের সঙ্গে কথা বলার সময় তার গলা ভারি হয়ে আসছিল। তিনি জানান, দুই সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে সুখের সংসার তার। পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন নরসিংদীর মাধবদীতে। ১০ বছরের ছোট্ট ছেলেটি পড়াশোনা করছে স্থানীয় শিমুলেরকান্দি দারুল আরকাম আল ইসলামিয়া হাফিজিয়া মাদরাসা ও এতিমখানার হেফজ বিভাগে। আরেক ছেলে পড়াশোনা করছে স্থানীয় একটি স্কুলে। বেশ কিছুদিন ধরে তার ছোট্ট সন্তান জ্বরে ভুগছে। এরই মধ্যে রমজানের প্রথম দিন গত ১৪ এপ্রিল সকালে মাদরাসার শিক্ষক নজরুল ইসলাম তার স্ত্রীর মোবাইলে ফোন করেন। ছেলেকে মাদরাসায় পাঠাতে জোরাজুরি করেন।

শিশুটির বাবা আরও জানান, ছেলেকে মাদরাসায় পাঠানোর কথা বললে তার স্ত্রী শিক্ষককে জানিয়ে দেন ছেলে অসুস্থ। এরপরও নাছোড়বান্দার মতো আচরণ করেন তিনি। ওই শিক্ষক তার মাকে বলেন, অসুস্থ হলে প্রয়োজনে 'পানি-পড়া' দেওয়া হবে। তাকে যেন মাদরাসায় পাঠানো হয়।

অসুস্থ থাকায় বড় সন্তানকে দিয়েই ছোট ছেলেকে মাদরাসায় পাঠান তার মা। এরপর ওই দিন দুপুর নাগাদ শিশুটি যেভাবে বাড়ি ফেরে, তা দেখে আঁতকে ওঠেন তারা। তার পরনের পোশাক রক্তে ভেজা। তখন শিশুটির পুরো শরীর অবশ দেখাচ্ছিল।

শিশুটির বাবা আরও বলেন, ছেলে আমার কাছে কোনোমতে মাদরাসায় ঘটে যাওয়া ঘটনার বর্ণনা দিতে পেরেছিল। ভয়ার্ত ও কাতর কণ্ঠে ছেলে জানায়, বড় ভাই তাকে রেখে চলে আসার পর বন্ধ মাদরাসার একটি নির্জন কক্ষে শিক্ষক নজরুল ইসলাম তার সঙ্গে 'খারাপ কাজ' করেছে। যন্ত্রণায় কাতর হলেও মাদরাসা শিক্ষকের বর্বরতা থেকে তার মুক্তি মেলেনি। কিছু সময় পর দেখে তার শরীর রক্তে ভিজে গেছে। তিনি বলেন, 'ছেলের এমন রক্ত ভেজা শরীর দেখে স্থির থাকতে পারিনি। ঘটনার পরপরই বাঁশের লাঠি নিয়ে ছেলের মা ও আমি কুলাঙ্গারটাকে শায়েস্তা করতে মাদরাসায় ছুটে যাই। আমাদের বাড়ি থেকে মাদরাসার খুব বেশি দূরে নয়। কারও কাছ থেকে খবর পেয়ে মাদরাসার অধ্যক্ষ আবদুল হান্নান ও মাদরাসা পরিচালনা কমিটির কয়েকজন ঘটনাস্থলে এসে হাজির হন। ঘটনাটি আমাদের কয়েকজন আত্মীয়স্বজন ততক্ষণে জেনে যায়। তারাও মাদরাসায়  এসে জড়ো হয়। এরপর একটি কক্ষে শিক্ষক নজরুলকে আটক করে রাখি। এরই মধ্যে বারবার মাদরাসার অধ্যক্ষ বলতে থাকেন, যেন বিষয়টি নিয়ে আমরা বেশি হট্টগোল না করি। তিনি মিটমাট করে দেবেন। বেশি জানাজানি হলে মাদরাসার  ইমেজ নষ্ট হবে।'

অটোরিকশাচালক আরও বলেন, কুলাঙ্গারের বিচার দাবিতে যখন মাদরাসায়  এমন হট্টগোল চলছিল এরই মধ্যে জোহরের নামাজের সময় হয়ে যায়। ওই শিক্ষককে কক্ষে আটকে সবাই মসজিদে নামাজ পড়তে চলে যাই। নামাজ শেষে কক্ষের সামনে এসে দেখি, ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত শিক্ষক ভেতরে নেই। অধ্যক্ষের কাছে নজরুলের সন্ধান চাইলে তিনি আমাদের মাথা গরম না করার পরামর্শ দেন। পরে জানতে পারি, কক্ষের সামনে তালা দেওয়ার পর পেছনের জানালা দিয়ে নজরুলকে পালিয়ে যেতে সহায়তা করেন অধ্যক্ষ নিজেই। এরপর সেই অধ্যক্ষ ও তার সাঙ্গোপাঙ্গরা বলেন, পরদিন বিষয়টি নিয়ে বৈঠক হবে। সেখানে আমাদের ডাকা হবে।

শিশুটির বাবা আরও বলেন, অনেক চাপ ও মিথ্যা প্রবোধ দেওয়ার পর শনিবার মাদরাসায় সালিশ বৈঠক ডাকা হয়। বৈঠকে মাদরাসা পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল, অধ্যক্ষ, অভিযুক্ত শিক্ষকসহ আরও অনেকে উপস্থিত হন। তারা ছেলের চিকিৎসার জন্য ওষুধ ও মলম কিনে দেওয়া এবং সঙ্গে খুব সামান্য কিছু টাকা নিয়ে বিষয়টি চেপে যেতে বলেন। সালিশের নামে যখন এটাকে নিয়ে চরম প্রহসন করার আয়োজন চলছিল, তখনই হঠাৎ পুলিশ এসে হাজির হয়। বৈঠকের মাঝ থেকেই নজরুলকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় তারা। এতে পণ্ড হয় সালিশ।

শিশুটির বাবা আরও বলেন, শুরু থেকে ধর্ষণের এই ঘটনা যারা ধামাচাপা দিতে দেনদরবার করছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন স্থানীয় মিজান চৌধুরী, মহসিন শিকদার, রেনু মুন্সী, সিরাজ প্রধান, লিল মিয়া, বাবুলসহ কয়েকজন।

নজরুলকে আসামি করে থানায় মামলা করা হয়েছে জানিয়ে শিশুটির বাবা বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় অভিযুক্ত শিক্ষক গ্রেপ্তার হয়েছে। এখন তার দৃষ্টান্তমূলক সাজা চাই। তিন-চার দিন হাসপাতালে রাখার পরও ছেলে সুস্থ হয়নি। অপরিচিত কাউকে দেখলে আঁতকে উঠছে। ছেলের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চিকিৎসক যে প্রতিবেদন দিয়েছেন, তা রোববার পুলিশকে দেওয়া হয়েছে। এতে ভেস্তে যায় ওষুধ-মলমের মূল্যে ধর্ষণের ঘটনা চাপা দেওয়ার ষড়যন্ত্র।

শিমুলেরকান্দি দারুল আরকাম আল ইসলামিয়া হাফিজিয়া মাদরাসা পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল বলেন, 'আমরা বলেছি একটি দুর্ঘটনা হয়ে গেছে, এটা সত্য। এটি সামাজিকভাবে মিটমাট করে দেওয়ার চিন্তা করেছিলাম। চিকিৎসার খরচ লাগলে সেটা দেওয়ার কথাও বলেছি।'

নরসিংদীর পুলিশ সুপার কাজী আশরাফুল আজীম বলেন, শিশুটির সঙ্গে যা হয়েছে, সেটা অত্যন্ত ন্যক্কারজনক। ওই শিক্ষক আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।

মাধবদী থানার ওসি সৈয়দুজ্জামান বলেন, পুলিশ যথাসময়ে ঘটনাস্থলে না গেলে এমন জঘন্য ঘটনা আড়ালেই থাকত। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের এই মামলার তদন্তও দ্রুত শেষ করা হবে।

এ ব্যাপারে মাদরাসার অধ্যক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টাও করে তাকে পাওয়া যায়নি।

জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন - dainik shiksha জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন পছন্দের স্কুলে বদলির জন্য ‘ভুয়া’ বিবাহবিচ্ছেদ - dainik shiksha পছন্দের স্কুলে বদলির জন্য ‘ভুয়া’ বিবাহবিচ্ছেদ হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা - dainik shiksha হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে - dainik shiksha সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন - dainik shiksha জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো - dainik shiksha ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা - dainik shiksha তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.013284921646118