বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতির নামে কী হচ্ছে? ছাত্ররাজনীতি কি আগের জায়গায় আছে? গণমাধ্যমে আসা খবরগুলো কী বলছে? কালের কণ্ঠে গত ১৭ এপ্রিল প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, মোটরসাইকেলের বহরকে রাস্তা ছেড়ে না দেওয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীকে মারধর করা হয়েছে। অভিযুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়েরই এক ছাত্রলীগ নেতা। খবরে আরো বলা হয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ফেব্রুয়ারিতে হল শাখা ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণার পর থেকে বিভিন্ন আবাসিক হল ও ক্যাম্পাসে অন্তত সাতজনকে পেটানো হয়েছে। সব ঘটনার সঙ্গে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। বুধবার (২০ এপ্রিল) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত উপসম্পাদকীয়তে এ তথ্য জানা যায়।
উপসম্পাদকীয়তে আরও জানা যায়, এসব ঘটনার মধ্যে শুধু বিজয় একাত্তর হলে এক শিক্ষার্থীকে মারধরের ঘটনায় ছাত্রলীগের ছয় নেতাকর্মীকে হল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে গণমাধ্যমে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) বিভিন্ন আবাসিক হলে আসন বাণিজ্য, কক্ষ দখলদারি ও শিক্ষার্থী নিপীড়নের খবর সবার নজরে এসেছে। অভিযোগের আঙুল স্পষ্টভাবে তোলা হয়েছে সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠনের দিকে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অভিযোগগুলো আমলে নিয়ে আন্তরিকভাবে যথাযথ সমাধান করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু গণমাধ্যমে যেসব অভিযোগ এসেছে, এর বাইরেও অসংখ্য অভিযোগ শিক্ষার্থীরা প্রকাশ করেননি বা করতে পারছেন না। এ অবস্থায় কয়েক দিন আগে এ বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে চার দফা দাবি জানিয়েছে রাবির প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনগুলো। চার দফা দাবির মধ্যে রয়েছে আবাসিক হলে আসন বাণিজ্য বন্ধ করা, আসন বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িতদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা, অনলাইনে প্রতিটি হলের আসন তালিকা প্রকাশ করা, হলের ডাইনিংয়ে খাবারের দাম কমিয়ে ভর্তুকি দিয়ে মান বাড়ানোর পাশাপাশি ক্যাম্পাসে দাম ও মান মনিটর করা এবং গণতান্ত্রিক ক্যাম্পাস নিশ্চিত করে অবিলম্বে রাকসু নির্বাচনের ব্যবস্থা করা।
দীর্ঘদিন থেকে আসন বাণিজ্য, কক্ষ দখলদারিসহ ভিন্ন ভিন্ন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মনে এক ধরনের ক্ষোভ এবং মেধার ভিত্তিতে আবাসিক হলে আসন বরাদ্দ নিয়ে যথেষ্ট শঙ্কা তৈরি হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে রাবির শের-ই-বাংলা হল থেকে এক আবাসিক শিক্ষার্থীকে ছাত্রলীগের হল শাখার সভাপতির জোরপূর্বক বের করে দেওয়ার অভিযোগ নজরে এলো। এ ছাড়া এর আগেও মতিহার হলের এক বাকপ্রতিবন্ধী আবাসিক শিক্ষার্থীর সঙ্গে একই ঘটনা ঘটেছে বলে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়। বিষয়গুলো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিভিন্নভাবে সমাধান করলেও আরো বেশ কিছু ঘটনা রয়েছে, যেগুলোর জন্য সাধারণ শিক্ষার্থীদের মনে যথেষ্ট ক্ষোভ রয়েছে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে আরো বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অভিযোগ রয়েছে রাবির আবাসিক হলগুলোতে আসন পেতে হল প্রশাসনের অনুমতির পাশাপাশি ছাত্রলীগের সম্মতিও লাগে। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সম্মতি ছাড়া শিক্ষার্থীরা হলের আসন পান না। বঞ্চিত শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, আবাসিক হলে আসন বরাদ্দ পেয়ে প্রতি মাসে টাকা গুনছেন ঠিকই, কিন্তু আসন দখল পাচ্ছেন না। উল্টো মেসভাড়া দিচ্ছেন। হল প্রাধ্যক্ষকে বললে তাঁরা ‘বড় ভাইদের’ (ছাত্রলীগ নেতা) ধরে হলে ওঠার পরামর্শ দেন।
একসময় ছাত্ররাজনীতি বড় বড় রাজনৈতিক নেতা তৈরির সূতিকাগার হিসেবে বিবেচিত হতো, কিন্তু এখন ওই অর্থে আর ছাত্ররাজনীতি হয় না। অনেক ক্ষেত্রেই ছাত্ররাজনীতি প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। এর অন্যতম কারণ ছাত্রসংসদ না থাকা, নির্বাচন না হওয়া। এমনকি যথাযথ প্রতিনিধিত্ব গড়ে না ওঠা। বিশেষ করে ক্ষমতার আধিপত্য, বড়াই-লড়াই, হল দখল, আসন বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, চাটুকারিতা, পকেট নেতা তৈরি, প্রশাসনের অন্যায্য সমর্থন ইত্যাদি কারণে ছাত্ররাজনীতির যথাযথ বিকাশ হচ্ছে না। ছাত্রসংগঠনগুলোর কমিটি গঠনের জন্য এখন যোগ্যতার পাশাপাশি চলে লাখ লাখ টাকার রাজনৈতিক বাণিজ্য। এই অপরাজনীতির দাপটে ক্রমেই ছাত্ররাজনীতি প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। আর এর প্রভাব পড়ছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর।
সাধারণত মূল সংগঠন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকলে ছাত্রসংগঠনগুলো আধিপত্য বিস্তারের নামে নিজেদের হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। ইদানীং যেহেতু ছাত্রসংগঠনগুলোর নির্বাচনের ভিত্তিতে নেতৃত্ব নির্ধারিত হয় না, সেহেতু সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভালো-মন্দ বিচার কিংবা ছাত্রনেতাদের উত্তম চরিত্র প্রকাশের প্রয়োজন পড়ে না। এমনকি তাঁরা এটাও চিন্তা করেন না যে তাঁদের মূল সংগঠনগুলোর ক্ষমতায় আসতে সাধারণ জনগণের ভোটের মুখোমুখি হতে হয়। এ কারণে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের সাধারণ শিক্ষার্থীরা হয়রানির শিকার হন। তাঁরা কখনোই আমলে নেন না যে একজন সাধারণ শিক্ষার্থীকে হয়রানি করার অর্থ হচ্ছে তাঁর পরিবার তথা মা-বাবা ও আত্মীয়-স্বজনকে হয়রানি করা। স্বাভাবিকভাবেই এসব ক্ষেত্রে পরিবারের দুঃখ-কষ্টের প্রভাব পড়ে জাতীয় নির্বাচনের ওপর। একটি সাধারণ পরিবারের সন্তান বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে লাঞ্ছিত কিংবা হয়রানির শিকার হলে ওই পরিবারের সদস্যদের ভোট প্রদানের মাপকাঠি ভিন্নভাবে প্রভাবিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়।
‘শিক্ষা শান্তি প্রগতি’ ছাত্রলীগের মূলনীতি, অথচ বর্তমানে ছাত্রলীগ দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে খুব বেশি ইতিবাচক জায়গা করতে পারছে না। অনেক ক্ষেত্রেই ছাত্রলীগ যথেষ্ট ইতিবাচক ভূমিকা পালন করলেও কিছু নেতিবাচক কার্যক্রম সব ইতিবাচক ভূমিকাকে ম্লান করে দিচ্ছে। যেসব ছাত্রলীগ নেতাকর্মী অন্যায় এবং অসংগতিমূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে দল থেকে বহিষ্কারসহ নানা ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা সত্ত্বেও নেতিবাচক কর্মকাণ্ড বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। বেশ কিছু কারণে অনেকের কাছেই বর্তমানে ছাত্ররাজনীতি এক আতঙ্কের নামে পরিণত হয়েছে।
এখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে, তাই ছাত্রলীগ বাড়াবাড়ি করছে। আবার যখন বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় ছিল, তখন ছাত্রদল ও ছাত্রশিবির বাড়াবাড়ি করেছে। অর্থাৎ যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, সেই দলের অঙ্গসংগঠন কিংবা ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন নিজেদের আধিপত্য খাটাতে গিয়ে সাধারণদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন করতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠা বোধ করে না। এতে যে তাদের মূল দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়, সেটি তারা মোটেও বিবেচনায় আনতে চায় না কিংবা আনে না।
আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মূল ফ্যাক্টর হবেন দেশের ছাত্র ও তরুণ ভোটাররা। যাঁরা নতুন ভোটার হয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থী কিংবা সদ্য পাস করা শিক্ষার্থী। এ থেকেও পরিষ্কার ধারণা করা যেতে পারে, ছাত্রসংগঠনগুলোর বাড়াবাড়ি কিংবা অসংগতিপূর্ণ কর্মকাণ্ড ভোটের রাজনীতিতে কতটা প্রভাব ফেলতে পারে। কাজেই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া সচেতন শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ বাংলাদেশের রাজনীতি কিংবা ক্ষমতার চাবিকাঠির মূল ক্রীড়নকে পরিণত হতে পারে। যে দলই ক্ষমতায় থাকুক বা আসুক, তাদের উচিত ছাত্রসংগঠনের আধিপত্যবাদ বন্ধ করা। কারণ ক্ষমতার অপচর্চাই ক্ষমতার বিড়ম্বনায় পরিণত হতে পারে।
আমি শিক্ষক হিসেবে দেখেছি, বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই বঙ্গবন্ধুর আদর্শ তথা বঙ্গবন্ধুকে পছন্দ করেন। আর এই পছন্দ থেকেই একজন সাধারণ শিক্ষার্থী তাঁর পরিবারকে যথাযথ আদর্শের মাধ্যমে প্রভাবিত করতে সক্ষম হন। কিন্তু সব শিক্ষার্থীই যে সক্রিয় ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে থাকবেন, আবার সবাই যে মিছিল-মিটিংয়ে যাবেন—এমনটি কোনোভাবে প্রত্যাশিত নয়। কিন্তু সাধারণ শিক্ষার্থীরা যখন ছাত্রলীগের দ্বারা লাঞ্ছিত হন, তখন এর প্রভাব কেমন হতে পারে কিংবা কত দূর পৌঁছতে পারে—তা সহজেই অনুমান করা যায়।
লেখক : ড. সুলতান মাহমুদ রানা, সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়