জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে অধিদপ্তরকে। তবে এই অধিদপ্তর এখনো সৃষ্টি হয়নি। আইনের খসড়া করা হয়েছে কেবল। খসড়াটি মন্ত্রিসভায় অনুমোদন হয়ে সংসদে পাস হলে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অধিদপ্তর গঠন করা হবে। এই অধিদপ্তর হবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের অধীনে। তারপর সেই অধিদপ্তরে গড়াবে নির্বাচন কমিশনের এনআইডি-সংক্রান্ত যাবতীয় কাজ।
নির্বাচন কমিশন থেকে নিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্রের দায়িত্ব অধিদপ্তরকে দেওয়ার জন্য এ আইন করা হচ্ছে। কারণ ২০১০ সালের আইনে এনআইডির দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনকে দেওয়া হয়েছে। ওই আইনটিতে ‘নির্বাচন কমিশন’ শব্দদ্বয়ের বদলে ‘সরকার’ শব্দ প্রতিস্থাপন করলেই কাজ হতো। এমনটাই বলা হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনায়।
কিন্তু কাজ করতে গিয়ে কর্মকর্তারা দেখছেন, শুধু এ শব্দ দুটো বদলালেই হচ্ছে না। পুরো আইনটাই পাল্টাতে হচ্ছে। কারণ নিবন্ধন কাজ পরিচালনার জন্য প্রজ্ঞাপন দিয়ে অধিদপ্তর করতে হবে। সেই প্রজ্ঞাপন জারির এখতিয়ার পেতে হবে আইনের মাধ্যমে। নিবন্ধন করাতে অভিভাবকের অনিচ্ছা দূর করার জন্য আইনি বাধ্যবাধকতা দরকার। পরিচয়পত্র দেওয়ার এখতিয়ার অর্জনের জন্য ভোটার তালিকা আইনের সংশ্লিষ্টতা ছিন্ন করতে হবে। তাছাড়া জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইনের সঙ্গেও সমন্বয় করতে হবে। এত ঝামেলা করার চেয়ে নতুন আইন করারই সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। নতুন আইনের খসড়া করার পরও তাতে এক দফা পরিবর্তন আনা হয়েছে। জাতীয় পরিচয়পত্র জাল-জালিয়াতি বেড়ে যাওয়ায় খসড়া আইনে জেল-জরিমানার পরিমাণও বাড়ানো হয়েছে। সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে খসড়া করে দফায় দফায় পরিমার্জন করা হচ্ছে ‘জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন, ২০২২’।
প্রথম দফার খসড়ায় নির্বাচন কমিশনের ভোটার তালিকার তথ্য-উপাত্ত প্রস্তাবিত নিবন্ধন অধিদপ্তরের সরবরাহ করার বিধান রয়েছে। সেই তথ্যের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশনের ভোটার তালিকা করার বাধ্যবাধকতাও ছিল। কিন্তু পরের খসড়ায় বাধ্যবাধকতার জায়গা থেকে সরে এসেছে সরকার।
কারণ হিসেবে জানা গেছে, ভোটার তালিকা কীভাবে করা হবে, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশনের। সরকার এ আইন দিয়ে বলে দিতে চায় না ‘নিবন্ধন কর্তৃপক্ষের তথ্যেই ভোটার তালিকা করতে হবে’। এ কারণে পরিমার্জিত খসড়ায় ভোটার তালিকা প্রস্তুতের জন্য অধিদপ্তর প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত দেওয়ার বিধান বহাল রাখলেও সেই তালিকার ভিত্তিতেই ভোটার তালিকা করতে হবেÑএমন বিধান থেকে সরে এসে খসড়া করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগ।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রাথমিক খসড়া থেকে অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়, মহাপরিচালক নিয়োগের বিধান, কর্মচারী নিয়োগসংক্রান্ত বিষয়গুলো সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। প্রাথমিক খসড়ায় বলা হয়েছিল অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয় ঢাকায় থাকবে। সরকার প্রয়োজন মনে করলে যেকোনো জায়গায় শাখা খুলতে পারবে। অধিদপ্তরের একজন মহাপরিচালকের কথা বলা হয়েছিল, তার প্রধান নির্বাহীর দায়িত্ব পালনের কথা ছিল। সাংগঠনিক কাঠামো অনুযায়ী কর্মচারী নিয়োগ, পদায়ন ও পদোন্নতিসহ চাকরির অন্যান্য শর্ত নির্ধারণের এখতিয়ারও ছিল।
সুরক্ষা সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব তরুণ কান্তি শিকদার বলেন, ‘জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন, ২০২২’-এর প্রাথমিক খসড়া করা হয়েছে। খসড়াটি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। খসড়ার বিভিন্ন বিষয় যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। চূড়ান্ত হলে অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হবে।’
শুধু ভোটার তালিকা বা নিবন্ধন কর্তৃপক্ষের মধ্যেই নতুন আইন সীমাবদ্ধ নেই। বর্তমান আইনে পরিচয়পত্রে তথ্য-উপাত্ত সঠিকভাবে লেখা না হলে কোনো রকম ফি ছাড়াই সংশোধন করার বিধান রয়েছে। কিন্তু খসড়া আইনে সেই বিধান তুলে দেওয়া হয়েছে। সংশোধনের দরকার হলে নির্ধারিত ফি দিয়ে হালনাগাদ করার আবেদন করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
বর্তমান আইনে জাতীয় পরিচয়পত্রের মেয়াদ ১৫ বছর। নির্ধারিত ফি দিয়ে তা নবায়নের ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। কিন্তু খসড়া আইনে এ-সংক্রান্ত ধারাটিই বিলুপ্ত করা হয়েছে।
শিশুর জন্মের ছয় মাসের মধ্যে তার পরিচয়পত্রের জন্য মা, বাবা বা অভিভাবককে আবেদন করতে হবে। তবে এ সময়সীমা প্রজ্ঞাপন দিয়ে পরিবর্তন করার এখতিয়ার সরকারের হাতে রাখা হয়েছে। নতুন ধারা সংযোজন করে বলা হয়েছে, শিশুর পরিচয় নিবন্ধনের আবেদন না করলে মা, বাবা বা অভিভাবকের ছয় মাসের কারাদন্ড, ৫০ হাজার টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন। বর্তমান আইনে ফি দিয়ে এবং ফি ছাড়া পরিচয়পত্র সংশোধনের সুযোগ রয়েছে। খসড়া আইনে ফি দিয়ে এবং বিধি দিয়ে নির্ধারিত পদ্ধতিতে সংশোধন বা হালনাগাদ করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
দেশে নানা ধরনের কাজে জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করা হয়। যার মধ্যে সরকারি সব অনলাইন সুবিধা, ড্রাইভিং লাইসেন্স করা ও নবায়ন, পাসপোর্ট করা ও নবায়ন, সম্পত্তি কেনাবেচা, আয়করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর বা টিআইএনপ্রাপ্তি, বিয়ে ও তালাক নিবন্ধন, ব্যাংক হিসাব খোলা, ব্যাংক ঋণগ্রহণ, সরকারি ভাতা উত্তোলন, সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর সহায়তাপ্রাপ্তি, বিআইএন বা বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন নম্বর, শেয়ার-বিও অ্যাকাউন্ট, ট্রেড লাইসেন্স, যানবাহন নিবন্ধন, বীমা স্কিম, ই-গভর্ন্যান্স, গ্যাস-বিদ্যুৎ-সংযোগ, মোবাইল সংযোগ, হেলথ কার্ড, ই-ক্যাশ ও শিক্ষার্থী ভর্তির কাজ ছাড়াও আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় কাজ রয়েছে। সম্প্রতি অনলাইনে রেলের টিকিট কাটার জন্যও জাতীয় পরিচয়পত্র বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।