জামায়াতের বৈধতা প্রশ্নের নিষ্পত্তি জরুরি - দৈনিকশিক্ষা

জামায়াতের বৈধতা প্রশ্নের নিষ্পত্তি জরুরি

মিজানুর রহমান খান |

রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে দেয়া হাইকোর্টের রায় গতকাল রোববার বহাল রেখেছে আপিল বিভাগ। আইন, বিচার, সংবিধান, সরকার, মুক্তিযুদ্ধ ইত্যাদি বিষয়ের বিশেষজ্ঞ ও গোপন নথি প্রকাশকারী সাংবাদিক প্রয়াত মিজানুর রহমান খান আজ থেকে নয় বছর আগে এ বিষয়ে বিশেষ নিবন্ধ  লিখেছিলেন। শিরোনাম ছিলো ‘জামায়াতের বৈধতা প্রশ্নের নিষ্পত্তি জরুরি’। কেনো এমন শিরোনাম? নিবন্ধে কী বলেছিলেন কালজয়ী এই সাংবাদিক? সময়ের উপযোগিতা বিবেচনায় দৈনিক আমাদের বার্তার পাঠকদের জন্য সেটা পুন:প্রকাশ করা হলো- 

বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম হাইকোর্টে থাকতে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করে রায় দিয়েছিলেন। এবার ওই দলের নেতা মতিউর রহমান নিজামীর যুদ্ধাপরাধ মামলায় ধর্মের অপব্যবহার নিয়ে বিশেষ পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের এর আগে দেওয়া অন্যান্য রায়ে জামায়াতের ধর্মের অপব্যবহার প্রসঙ্গ এভাবে বিস্তারিত আসেনি। তাই এই রায় ধর্মের অপব্যবহারকারী সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বিচারের প্রয়োজনীয়তাকে সামনে এনেছে।

এই মুহূর্তে জামায়াত একটি নিবন্ধনহীন রাজনৈতিক দল। বৈধতার প্রশ্নে কোনো সংগঠনের নিবন্ধন বাতিল হয়ে যাওয়ার পরও দিব্যি রাজনীতি করে যাচ্ছে তারা। সুপ্রিম কোর্টের রায়মতে, জবরদস্তি হরতাল অবৈধ। সেই অর্থে জামায়াতের হরতাল অবৈধ।

ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক জামায়াতের নিবন্ধন মামলায় যুক্তি দিয়েছিলেন যে ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অসাংবিধানিক। এটি গণতন্ত্রের উন্নয়নে সহায়ক নয়।’ জামায়াত তাই আরপিওর বৈধতা চ্যালেঞ্জকারী দল। তারা এটা করেছিল বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া সম্প্রতি টাইমস অব ইন্ডিয়াকে দেওয়া সাক্ষাতকারে জামায়াতকে একটি উগ্র ধর্মীয় সংগঠন হিসেবে ইঙ্গিত করেন। খালেদা জিয়া বলেছিলেন, জামায়াতের সঙ্গে তাঁদের নির্বাচনী সমঝোতা রয়েছে, আদর্শগত নয়। কিন্তু এটা কখনো পরিষ্কার হয়নি যে জামায়াতের কোন কোন আদর্শের সঙ্গে বিএনপির মতবিরোধ রয়েছে। আবার জামায়াত নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে সাময়িক নিবন্ধন পেয়েছিল। আর সেটা পেতে তারা একাধিকবার গঠনতন্ত্র সংশোধন করে কমিশনে জমা দেয়।

বিচারপতি ইনায়েতুর রহিম যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত মতিউর রহমান নিজামীর রায়ে জামায়াতের দ্বারা ধর্মের অপব্যবহারের যে বিবরণ দিয়েছেন তা ১৯৭১ সালের। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশেও দলটি কখনো চেতনায় কখনো প্রতীকী অর্থে সেই ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছে। এরপর পানি আরও গড়িয়েছে। ব্যারিস্টার রাজ্জাক যখন আরপিওকে অসাংবিধানিক দাবি করেছিলেন, তখন সংবিধানে কেবল রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ছিল।

২০১৩ সালের আগস্টে হাইকোর্ট জামায়াতের নিবন্ধন মামলার রায় দেন। কিন্তু তথ্য ও আইনকানুন ব্যাখ্যার বিষয় ছিল বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলের। তাই রাজ্জাক হয়তো সংবিধানে কেবল ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ থাকার যুক্তিতে ধর্মের প্রশ্নে তাদের গঠনতন্ত্রকে যুক্তিগ্রাহ্য করতে সচেষ্ট হতে পারেন। 

২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর পরে রাষ্ট্রধর্ম থাকার পরেও আমাদের সংবিধানে কার্যত ধর্মের অপব্যবহার নিষিদ্ধ হয়ে যায়। ৩৮ অনুচ্ছেদে স্পষ্ট বলা হয়, ‘কারও সমিতি বা সংঘ করবার অধিকার থাকবে না যদি তা নাগরিকদের মধ্যে ধর্মীয়, সামাজিক এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করবার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়।’ সংবিধান আরও বলছে, ‘কোনো সংগঠনের গঠন ও উদ্দেশ্য যদি সংবিধানের পরিপন্থী হয় তাহলে তারা নিষিদ্ধ হবে।’ জামায়াতের গঠনতন্ত্র, বিশেষ করে তার অন্তর্গত সাম্প্রদায়িক চেতনা ২০১১ সালে পরের সংবিধানের প্রস্তাবনা, ৮, ১১ ও ১২ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সংঘাত সৃষ্টি করেছে। এসব বিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনাই যে রাষ্ট্র পরিচালনার ‘মূলনীতি’ ও ‘মূলসূত্র’ হবে তা নির্দিষ্ট করেছে। অথচ জামায়াতের দলীয় গঠনতন্ত্রে ১৫তম সংশোধনীর নির্দিষ্ট প্রতিফলন এখনো ঘটেনি। সুতরাং, সংবিধানে ধর্মের অবস্থান এবং তার সঙ্গে জামায়াতের গঠনতন্ত্রের সামঞ্জস্য ও অসামঞ্জস্য হওয়ার প্রশ্ন এখনো অমীমাংসিত। যুদ্ধাপরাধ ছাড়াও পদ্ধতিগতভাবে তাদের দ্বারা পবিত্র ইসলাম ধর্মের অপব্যবহারকে একটি নতুন অপরাধ হিসেবে গণ্য করা যায় কি না, সেটা বিচারপতি ইনায়েতুর রহিম তার রায়ে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।

হিটলারের ন্যাৎসি পার্টি গণহত্যা কিংবা মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনে ধর্মের অপব্যবহার করেনি। সেদিক থেকে যুদ্ধে ধর্মের অপব্যবহার একটি নতুন অপরাধ। জামায়াত মানবতা, শান্তি ও সাম্যের ধর্ম পবিত্র ইসলামকে সমগ্র বিশ্বমানবতা এবং অনাগত মানব সভ্যতার কাছে কলঙ্কিত করার অপচেষ্টা করেছে। এতে নিশ্চয় ইসলামের নয়, তাদের ক্ষতি হয়েছে।

ট্রাইব্যুনালের রায়ে জামায়াতের ধর্মের অপব্যবহার সম্পর্কে বিশিষ্ট ইসলামি পণ্ডিতদের ভাষ্য বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে। মতিউর রহমান নিজামী ১৯৭১ সালের নভেম্বরে দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকায় আলবদর বাহিনীকে ইসলামের খেদমতগার হিসেবে চিত্রিত করেছিলেন। কেবল এই একটি নিবন্ধই তাঁকে শাস্তি দেওয়ার জন্য যথেষ্ট বলে মন্তব্য করেছেন বিচারপতি রহিম। নিজামীর মতে, পাকিস্তান ছিল ‘আল্লাহর ঘর’; এই বিশেষণ যে ইসলাম সম্মত ছিল না, সেই প্রশ্ন জামায়াতের তরুণ প্রজন্মকে তুলতে হবে।

জামায়াতের নিবন্ধন মামলা এখনো আপিল বিভাগে বিচারাধীন। তবে তারা ওই রায়ের কার্যকারিতা স্থগিত চেয়ে আবেদন করেছিল। কিন্তু আপিল বিভাগে তা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে।
এখন আবার জামায়াতকে ‘উগ্র ধর্মীয় সংগঠন’ হিসেবে ইঙ্গিত দিলেন বেগম খালেদা জিয়া। জামায়াত কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। তবে বিএনপি এর মাধ্যমে কী বোঝাতে চেয়েছে সে বিষয়ে তাদের তরফে একটি পরিষ্কার ব্যাখ্যা আসা দরকার। জামায়াত বর্তমান সংবিধান কিংবা আরপিও মেনেছে কি না সেটা জানা ইসির কর্তব্য। একাত্তরের যুদ্ধকালেই মুজিবনগর সরকার জামায়াতকে নিষিদ্ধ করেছিল। তার আইনি মূল্য জানি না। আমি এ বিষয়ে মার্কিন দলিল প্রকাশের পরে তার সত্যতা জামায়াত বা সরকার কেউ স্বীকার বা নাকচ করেনি। তবে সংবিধান কিন্তু সেই আদেশের সুরক্ষা দিয়েছে। ১৫০(১) অনুচ্ছেদের চতুর্থ তফসিলের (ক্রান্তিকালীন ও অস্থায়ী বিধানাবলি) তিন দফার ১ উপদফা অনুযায়ী জামায়াত আজও একটি নিষিদ্ধ সংগঠন। এই প্রশ্নের একটি ফয়সালা দরকার। জামায়াতের নিবন্ধন মামলায় সংবিধানের ১০৩ অনুচ্ছেদের আওতায় হাইকোর্ট এ মর্মে সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন যে এখানে ‘সংবিধান-ব্যাখার বিষয়ে আইনের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন জড়িত রয়েছে’।

আমিরাত থেকে ফিরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইঙ্গিত দিয়েছেন প্রয়োজনে তিনি যেকোনো সময়ে সাধারণ নির্বাচন দিতে পারেন। সুতরাং, যুদ্ধাপরাধী হিসেবে জামায়াতের নিষিদ্ধ হওয়ার প্রশ্নটি যুক্তির খাতিরে দূরে সরিয়ে রাখলেও বর্তমান সংবিধানের আওতায় জামায়াত তার গঠনতন্ত্র অনুযায়ী নির্বাচনী রাজনীতিতে অংশ নিতে পারে কি পারে না, তার একটা ফয়সালা বহুদলীয় গণতন্ত্র চর্চার দৃষ্টিকোণ থেকেও সুরাহা হওয়া বাঞ্ছনীয়। বেগম খালেদা জিয়া যদি বিশ্বাসও করেন যে তাঁরা জামায়াতের সঙ্গে ‘নির্বাচনী সমঝোতা’য় আছেন, তাহলেও তো জনগণের কাছে এটা পরিষ্কার হওয়া দরকার, যখনই নির্বাচন হোক, তাতে জামায়াত অংশ নিতে পারবে কি না? (১ নভেম্বর, ২০১৪)

শিক্ষার সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক শিক্ষার ইউটিউব চ্যানেলের সাথেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।

দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল  SUBSCRIBE  করতে ক্লিক করুন।

 

কাল থেকে শিক্ষা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী চলবে সব প্রাথমিক বিদ্যালয় - dainik shiksha কাল থেকে শিক্ষা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী চলবে সব প্রাথমিক বিদ্যালয় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান বাড়ানোর নির্দেশ রাষ্ট্রপতির - dainik shiksha বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান বাড়ানোর নির্দেশ রাষ্ট্রপতির ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার দাবিতে দেশজুড়ে সংহতি সমাবেশ - dainik shiksha ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার দাবিতে দেশজুড়ে সংহতি সমাবেশ সব মাদরাসার ওয়েবসাইট ও তথ্য হালনাগাদের নির্দেশ - dainik shiksha সব মাদরাসার ওয়েবসাইট ও তথ্য হালনাগাদের নির্দেশ অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক : দুই মন্ত্রণালয় যা করবে - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক : দুই মন্ত্রণালয় যা করবে নার্সিং-মিডওয়াইফারি ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ - dainik shiksha নার্সিং-মিডওয়াইফারি ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় সিনিয়র আইনজীবীরা বিচার বিভাগের স্বার্থে কথা বলবেন, আশা প্রধান বিচারপতির - dainik shiksha সিনিয়র আইনজীবীরা বিচার বিভাগের স্বার্থে কথা বলবেন, আশা প্রধান বিচারপতির দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.002985954284668