জালিয়াতির মাধ্যমে ১০ লাখ দ্বৈত জাতীয় পরিচয়পত্র - দৈনিকশিক্ষা

জালিয়াতির মাধ্যমে ১০ লাখ দ্বৈত জাতীয় পরিচয়পত্র

নিজস্ব প্রতিবেদক |

নুর জালাল শেখ। বয়স আনুমানিক ৪০ বছর। নিজের বয়স ১০ বছর কমানোর জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি কার্ড) সংশোধনের চেষ্টা চালান। বাহাদুর নামে এক দালালকে ১ লাখ ৫ হাজার টাকাও দেন তিনি। গত ২২ ডিসেম্বর ওই দালালকে নিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অনুবিভাগে যান কার্ডটি আনতে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দালাল বাহাদুরকে আটক করে র‌্যাবের হাতে তুলে দেয়। এরপর তাকে জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে জালিয়াতির নানা তথ্য।

নুরের মতো অনেকেই দ্বৈত এনআইডি কার্ড তৈরি করছে দেদার। তাদের কেউ কেউ আবার ধরাও পড়ছে। আর এসব জালিয়াতির সঙ্গে এনআইডি শাখার কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত বলে তথ্য মিলেছে। জালিয়াতির মাধ্যমে গত ১০ বছরে ১০ লাখ দ্বৈত এনআইডি করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এসব জালিয়াতি রোধে বেশকিছু সুপারিশ করেছে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। এর পরিপ্রেক্ষিতে নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসনও। এনআইডি জালিয়াতিতে জড়িত থাকায় গত আট বছরে ৪২ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বরখাস্ত করা হয়েছে। তাছাড়া দ্বৈত এনআইডি কার্ডধারী ৫৫৬ জনের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা (মামলা) নেওয়া হয়েছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) শাখার অফিসার ইনচার্জ স্কোয়াড্রন লিডার কাজী আশিকুজ্জামান বলেন, ‘এনআইডি জালিয়াতির সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে কঠোর অ্যাকশনে যাচ্ছি। দ্বৈত এনআইডিগুলো বাতিল করা হচ্ছে। আমাদের অফিসে যারা এসব অপকর্মে জড়িত ছিল তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আর যারা এখনো জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত তাদের চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে। জালিয়াত চক্রকে প্রতিরোধ করতে জেলা ও উপজেলায় ব্যানার-ফেস্টুন দিয়ে জনগণকে সচেতন করা হচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো আমাদের সব ধরনের সহায়তা করছে। যারাই এ চক্রের সদস্য হোক না কেন, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবেই। রোহিঙ্গাদের যারা এনআইডি কার্ড পাইয়ে দিতে সহায়তা করেছিল, তাদের আইনের আওতায় আনতে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কাজ করছে। এনআইডি জালিয়াত চক্রের বিরুদ্ধে জোরালো অভিযান অব্যাহত থাকবে।’

অনুসন্ধানে জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরেই এনআইডি শাখার কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর সহায়তায় একটি চক্র এনআইডি জালিয়াতির কাজ চালিয়ে আসছে। তারা মোটা অঙ্কের অর্থ পেয়ে দ্বৈত এনআইডি কার্ড তৈরি করে ফেলছে। একটি এনআইডি কার্ড করতে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এনআইডি কার্ড করার সুনির্দিষ্ট নিয়মাবলি বা আইন থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। নিবন্ধন আইনের (২০১০) ১৭ ধারায় বলা আছে, যেকোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী দায়িত্বে অবহেলা করলে এক বছরের কারাদন্ড অথবা ২০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবে। আবার ১৮ ধারায় বলা আছে, যেকোনো ব্যক্তি জাতীয় পরিচয়পত্র জাল বা কেউ সহায়তা করলে ৭ বছরের কারাদন্ড বা ১ লাখ টাকা জরিমানা করা হবে। অথচ আইন থাকার পরও দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা  বলেন, এনআইডি নিবন্ধন কার্যক্রমে নিজেদের অংশের দায়িত্ব চেয়ে একটি প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছিল। ওই প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে নাগরিক নিরাপত্তা, চোরাচালান প্রতিরোধসহ অন্যান্য বিষয়ের জন্য এটি তাদের দায়িত্বে দেওয়া দরকার। বাস্তবতার ভিত্তিতে এটির গ্রহণযোগ্যতাসহ সামগ্রিক বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মতামত চেয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। এ নিয়ে একটি কমিটি গঠন করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এ কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘এনআইডির বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তদারকি করলে জালিয়াতির ঘটনা অনেকাংশে কমে আসবে। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোও জালিয়াত চক্রের সদস্যদের বিরুদ্ধে কাজ করছে।’

এনআইডি শাখার কয়েকজন কর্মকর্তা  বলেছেন, দ্বৈত এনআইডি কার্ড পাওয়া গেলে প্রাথমিকভাবে বিধি মোতাবেক প্রথমটি রেখে পরবর্তী ভোটার তথ্য ব্লক করে দেওয়া হচ্ছে। কেউ জালিয়াতি করলে ফৌজদারি আইনে মামলা করা হচ্ছে। নাগরিকদের চেহারা এবং আইরিশ স্ক্যানিং বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। এছাড়া অনিয়ম প্রতিরোধে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোও কঠোর হচ্ছে। 

পুলিশ ও র‌্যাব কর্মকর্তারা জানান, বছরের পর বছর ধরে নির্বাচন কমিশনের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী নকল এনআইডি কার্ড তৈরি করছে। এনআইডি ব্যবস্থাপনায় কঠোর নজরদারির অভাব এবং ফাঁকফোকর থাকায় নকল কার্ড তৈরি হচ্ছে বলে পুলিশের তদন্তে উঠে এসেছে। একেকটি এনআইডি কার্ড তৈরি করতে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ হচ্ছে। ওই টাকার একটি অংশ দালালদের একটি গ্রুপ নিয়ে নিচ্ছে। একাধিক এনআইডি তৈরি করা বা প্রদান করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হলেও চক্রের সদস্যরা নাম ও ছবি একই রেখে অন্যান্য তথ্য পরিবর্তন করে নকল কার্ড তৈরি করছে। এ ধরনের ঘটনায় নির্বাচন কমিশনের আইনি শাখার মাধ্যমে ৫৫৬টি মামলা এবং কার্ডগুলো ব্লক করা হয়েছে।

সিআইডি ও ডিবি পুলিশের দুই কর্মকর্তা  বলেন, ভুয়া এনআইডি তৈরি অভিযোগে রাজধানীর মিরপুর থেকে দুজন নির্বাচন কমিশন কর্মচারীসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওই সময় তাদের কাছ থেকে ১২টি নকল এনআইডি কার্ড উদ্ধার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে তারা চক্রের একাধিক সদস্যের নাম প্রকাশ করেন। তাদের মধ্যে দুজন লালমনিরহাটে নির্বাচন কমিশন অফিসে কর্মরত। তা ছাড়া ১০-১২টি জেলায় অন্তত ২০ কর্মকর্তা-কর্মচারী এসব অপকর্ম করছেন। কার্ড জালিয়াতির সঙ্গে এনআইডি শাখার বেশ কয়েকজনের নাম পাওয়া গেছে। তাদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে। তথ্য-প্রমাণ হাতে এলে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। কেউ ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে ব্যর্থ হলে দ্বিতীয় দফায় আরেকটি এনআইডি কার্ড ব্যবহার করে ঋণ নেওয়ার একাধিক ঘটনা ঘটেছে। গত এক বছরে নকল এনআইডি কার্ড ব্যবহার করে বিভিন্ন বেসরকারি ব্যাংক থেকে ১৪ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার তথ্য হাতে এসেছে। এগুলোর গভীরে গিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। গত ৩০ আগস্ট জেকেজি হেলথ কেয়ারের চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরীর নামে দ্বিতীয় এনআইডি কার্ড থাকায় মামলা করে নির্বাচন কমিশন।

পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা  বলেন, ২০১৯ সালে বড় কয়েকটি এনআইডি কার্ড জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়ে। এর মধ্যে রোহিঙ্গাদের জন্য এনআইডি কার্ড তৈরি করায় অন্তত দশ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ওই সব ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে নানা অনিয়ম ধরা পড়ে । পরে নির্বাচন কমিশনের এনআইডি শাখাকে কিছু সুপারিশ করা হয়। এর মধ্যে অপরাধ বন্ধ করতে নতুন এনআইডি কার্ড নেওয়ার সময় নাগরিকদের চেহারা ও আইরিস স্ক্যানিং বাধ্যতামূলক করার সুপারি রয়েছে। এ ছাড়া সার্ভার আরও শক্তিশালী করতে বলা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের যেসব কর্মকর্তা বা কর্মচারী অপকর্মে জড়িত, তাদের চিহ্নিত করে বরখাস্ত করার পাশাপাশি গ্রেপ্তার করার উদ্যোগ নিতে হবে। নাগরিকদের তথ্যভাণ্ডার সংরক্ষণসংক্রান্ত একটি বিধিবদ্ধ সংস্থা গঠন করার মতও দেওয়া হয়েছে। নির্বাচন কমিশন সুপারিশগুলো আমলে নিয়ে জালিয়াত চক্রকে প্রতিরোধ করবে বলে আশা করছেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।

এনআইডি শাখার এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এনআইডি পেতে নতুন আবেদনকারীদের মধ্যে রোহিঙ্গা আছে কি না, তা চিহ্নিত করতে ১০ লাখ রোহিঙ্গার তথ্যসহ রোহিঙ্গা সার্ভারের পাশাপাশি একটি বিশেষ কমিটি ও বিশেষ অঞ্চল গঠন করা হয়েছে। এ ছাড়া ৮ সদস্যের কারিগরি কমিটি ও একটি প্রশাসনিক কমিটিও গঠন করা হয়েছে। ওই সব কমিটিতে বুয়েট, ঢাবি, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য ও কম্পিউটার কাউন্সিলের প্রতিনিধিকে রাখা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, এনআইডি বিভাগকে আরও শক্তিশালী করতে ইউনিক আইডি, স্মার্ট আইডির ব্যবহার চালু, প্রবাসীদের জন্য এনআইডি, কালিয়াকৈর ও যশোর ডেটা সেন্টার চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। জালিয়াতি প্রতিরোধ করতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পাশাপাশি ১০টি স্পেশাল টিম কাজ করছে। ইতিমধ্যে ৪২ কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। কার্ড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম ও ওটিপি ব্যবস্থা করা হয়েছে। একজন অপারেটরের অ্যাকাউন্টে অন্য কেউ প্রবেশ করতে পারবে না। লগইন করার সময় ব্যবহারকারীর ছবি যাচাই ও সংরক্ষণ করা হবে। সার্ভার প্রতিনিয়ত আপডেট করা হচ্ছে।

একই শাখার আরেক কর্মকর্তা বলেন, এনআইডি উইংয়ে আরও জনবল বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। নতুন এবং যুগোপযোগী হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার কেনা হবে। দ্রুত সময়ের মধ্যে আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া ও সৌদি প্রবাসীদের স্মার্টকার্ড বিতরণ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শিগগির তা শুরু হবে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এনআইডি কার্ড জালিয়াত চক্রের সঙ্গে যারাই জড়িত থাকুক, তাদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’

প্রায় একই ধরনের কথা বলেছেন সিআইডির প্রধান ও অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক ব্যারিস্টার মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘জালিয়াত চক্রের বিরুদ্ধে সিআইডির অভিযান অব্যাহত রয়েছে।’

হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য - dainik shiksha হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা - dainik shiksha ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক - dainik shiksha সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি - dainik shiksha ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার - dainik shiksha রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0035309791564941