দৈনিক শিক্ষাডটকম প্রতিবেদক: মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান ছিলেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি। আজ তার মৃত্যুবার্ষিকী। তিনি সিঙ্গাপুরে মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনে মারা যান।
১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দের ৯ মার্চ কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরব থানার ভৈরবপুরে তার জন্ম। পিতা মেহের আলী মিঞা ছিলেন আইনজীবী, ময়মনসিংহ লোকাল বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং জেলা বোর্ডের সদস্য।
মো. জিল্লুর রহমান ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে ভৈরব কে বি হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। তিনি ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে আইএ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে ইতিহাসে বিএ (অনার্স) এবং ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। পরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি ডিগ্রি লাভ করেন।
জিল্লুর রহমান ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজে অধ্যয়নকালে সিলেটে গণভোটে কাজ করার সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সান্নিধ্যে আসেন। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে ভাষা আন্দোলনে তার সক্রিয় ভূমিকা ছিলো। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ ফেব্রুয়ারি ছাত্র সমাবেশে জিল্লুর রহমান সভাপতিত্ব করেন।
২০ ফেব্রুয়ারি ফজলুল হক হল ও ঢাকা হলের মধ্যবর্তী পুকুরপাড়ে যে ১১ জন ছাত্রনেতার নেতৃত্বে ২১ ফেব্রুয়ারিতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। জিল্লুর রহমান ছিলেন তাদের অন্যতম। ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফজলুল হক হল ছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচিত হন।
ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার অপরাধে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হন এবং পরে প্রবল ছাত্রদাবির মুখে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করেন।
জিল্লুর রহমান ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে বৃহত্তর ময়মনিসংহ জেলা নির্বাচন পরিচালনা কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কিশোরগঞ্জ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন।
১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে ৬-দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে গণ-অভ্যুত্থানসহ প্রতিটি গণ-আন্দোলনে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ষাটের দশকে তিনি ঢাকা জিলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।
জিল্লুর রহমান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। তিনি মুজিবনগর সরকারকর্তৃক পরিচালিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র পরিচালনা এবং জয়বাংলা পত্রিকার প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সরকার তার সংসদ সদস্যপদ বাতিল করে ২০ বছর কারাদণ্ড দেয়া ও সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে।
স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে জিল্লুর রহমান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বাংলাদেশ গণপরিষদ সদস্য হিসেবে সংবিধান প্রণয়নে অংশ নেন। ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি দলের সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের (বাকশাল) পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন।
তিনি ছিলেন বাকশালের চারজন সেক্রেটারির অন্যতম। ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর জিল্লুর রহমানের জীবনের একটানা প্রায় চার বছর কারান্তরালে কাটে। ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে জিল্লুর রহমান বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়ামের সদস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। সংসদ-সদস্য থাকাকালে তিনি আবারো কারাবরণ করেন। ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দে জিল্লুর রহমান বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি জাতীয় সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। পাশাপাশি তিনি জাতীয় সংসদের উপনেতার দায়িত্বও পালন করেন।
১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পুনরায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ২০০১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হন।
২০০৭ খ্রিষ্টাব্দের ১১ জানুয়ারি দেশে জরুরি আইন জারির পর ১৬ জুলাই রাতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা গ্রেফতার হন। সেই সংকটময় সময়ে দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে জিল্লুর রহমান অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে দল পরিচালনা করেন। ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি নবম জাতীয় সংসদের সংসদ উপনেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
২০০৯ খ্রিষ্টাব্দের ১২ ফেব্রুয়ারি মো. জিল্লুর রহমান গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ১৯তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। সাংবিধানিকভাবে তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠা ও দক্ষতার সঙ্গে পালন করেছেন।
রাজনীতির মধ্যদিয়েই জিল্লুর রহমানের সামগ্রিক জীবনধারা গড়ে উঠে। দেশে গণতন্ত্রের ধারা অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে আজীবন তিনি সংগ্রাম করে গেছেন। জাতীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সময় থেকে জাতীয় সংসদে অব্যাহত ছিলো তার প্রতিনিধিত্ব। পরিশীলিত জীবনাচরণের অধিকারী জিল্লুর রহমান ছিলেন অমায়িক ও নম্র স্বভাবের মানুষ।
