করোনার কারণে দীর্ঘ এগার মাস ধরে প্রাথমিক থেকে উচচশিক্ষা স্তর পর্যন্ত দেশের সাড়ে সাড়ে চার কোটির মতো শিক্ষার্থী গৃহবন্দী অবস্থায় দিন কাটাচেছ। সংক্রমণ অনেকটা কমে আসায় এবং করোনার টিকা প্রাপ্তির কারণে অবশেষে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার জোর প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। তবে ক্লাসে আগের মতো শিক্ষার্থী হয়তো দেখা যাবেনা। আগের বছরগুলোর চেয়ে এবার ঝরে পড়ার হার নিশ্চিতভাবেই বাড়বে বলছেন পরিসংখ্যান ও বিশ্লেষকগন। শিক্ষার্থীদের যারা করেনাকালে কাজে যুক্ত হয়েছে তাদের অনেকেই আর স্কুলে ফিরবে না। আবার অনেকে স্কুলে ভর্তি হলেও ক্লাসে অনুপস্থিতির হারও বাড়বে। গত বছরের তুলনায় এ বছর এখনো এক-তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থী ভর্তি হয়নি। এমনকি শিক্ষকগন বাড়িতে বাড়িতে গিয়েও শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারছেন না। এটি নি:সন্দেহে শিক্ষার একটি ভয়ংকর চিত্র। বিশেষ করে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় যেখানে ভর্তিতে কোন ধরনের টাকা নেওয়া হয়না, সেখানেও ভর্তির হার ব্যাপকভাবে কমেছে। ঢাকার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর চিত্রও প্রায় একই। তবে শহরাঞ্চলের নামি-দামি স্কুলগুলোর ভর্তির ক্ষেত্রে এমনটি ঘটেনি।
২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার ছিল ১৭ দশমিক ৯ শতাংশ আর মাধ্যমিকে এই হার ছিল ৩৭.৬২শতাংশ। ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে এই ঝরে পড়ার হার অনেক বাড়বে বলেই নিশ্চিত সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, ঝরে পড়ার পেছনে অন্যতম কারণ দারিদ্র ও বাল্যবিয়ে। বিশেষ করে শহরের বস্তিবাসী এবং চর ও হাওড় অঞ্চলের শিশুরাই বেশি ঝরে পড়ে। করোনার কারণে এসব পরিবারে দারিদ্র আগের চেয়ে বেড়েছে, বেড়েছে বাল্যবিয়ের হারও। আমাদের দেশে এখন ২০ শতাংশ মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে বাস করে। করোনার কারণে আরো ২০ শতাংশ মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে নামতে পারে।
সম্প্রতি পাওয়ার অ্যন্ড পার্টিসিপেশন বিসার্চ সেন্টার ( পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের এক যৌথ গবেষণায় দেখা যায় করোনাভাইরাস সংক্রমনের কারনে তৈরি হওয়া পরিস্থিতিার প্রভাবে শহরের নি¤œ আয়ের মানুষের আয় কমেছে ৮২ শতাংশ। আর গ্রামাঞ্চলের নিম্ন মানুষের আয় কমেছে ৭৯শতাংশ। গত সপ্তাহে প্রকাশিত এডুকেশন ওয়াচের অন্তবর্তীকালীন প্রতিবেদন ২০২১ এ ঝরে পড়ার ব্যাপারে উদ্বেগজনক মতামত পাওয়া যায়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রাথমিকে ৩৮ শতাংশ শিক্ষক মনে করেন বিদ্যালয় খুলে দেওযার পরও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কমে যেতে পারে। ২০ শতাংশ মনে করেন ঝরে পড়ার হার বাড়বে এবং ৮.৭শতাংশ মনে করেন শিক্ষার্থীরা শিশুশ্রমে নিযুক্ত হতে পারে। মাধ্যমিকে ৪১.২ শতাংশ শিক্ষক মনে করেন, বেশি শিক্ষার্থী ক্লাসে অনুপস্থিত থাকতে পারে। ২৯ শতাংশ মনে করেন, ঝরে পড়ার হার বাড়বে। ৪০ শতাংশ অভিভাবক মনে করেন শিক্ষার্থীদের অনিয়মিত উপস্থিতির হার বাড়বে এবং ২৫শতাংশ মনে করেন ঝরে পড়ার হার বাড়বে। ৪৭শতাংশ জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মনে করেন, শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতির হার বাড়বে, ৩৩.৩ শতাংশ মনে করেন ঝরে পড়া বাড়বে এবং ২০ শতাংশ মনে করেন অনেকেই শিশুশ্রমে যুক্ত হতে পারে। ৬৪শতাংশ এনজিও কর্মকর্তা মনে করেন, শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতির হার ও ঝরে পড়া বেড়ে যাবে।
করোনাকালে সবচেয়ে বেশি দুরবস্থায় আছে কিন্তারগার্টেনগুলো। দ্রুত স্কুলগুলো খুলে না দিলে অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়বে। এডুকেশন ওয়াচের অন্তবর্তীকালীন প্রতিবেদনে বলা হয় দ্রুত ক্লাসে ফিরে যেতে চায় ৭৫শতাংশ শিক্ষার্থী। ৭৬শতাংশ অভিভাবক ও ৭৩শতাংশ জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা দ্রæত স্কুল খোলার পক্ষে মত দিয়েছেন। ৫৮ শতাংশ শিক্ষক ৫২ শতাংশ উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা একই মত দিয়েছেন। ৮২শতাংশ শিক্ষক স্কুল খুলে দেওয়ার আগে যথাযথ স্বাস্থ্য বিধি মাস্ক ব্যবহার, স্যানিটাইজার ও সামাজিক দূরত্বের বিষয়টির ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর বেঁধে দেওয়া শর্তাবলি পালন করে দেশের ৬৫ হাজার ৬২০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় খুলে দেওয়ার জন্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ’ স্কুল রি-ওপেনিং প্ল্যান’ তৈরি করেছে । গত ১৮ আগস্ট এই পরিকল্পনা জারি করেছে মন্ত্রণালয়। এতে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে স্কুল খুলে দেওয়ার পর স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরিচালিত হবে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সব কার্যক্রম। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মুখে মাস্ক পরা, হাত পরিষ্কার ও থার্মোমিটার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হবে। আগের মতো প্রতিদিন সব বিষয়ের ক্লাস হবেনা। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার ব্যাপারে কাজ শুরু করেছে।
তবে রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকার বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে সমস্যা হবে। রাজধানী ছাড়াও জেলা শহর ও গ্রাম এলাকার কিছু কিছু বিদ্যালয়ে শিক্ষা সংখ্যা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি। গত সপ্তাহে ফিল্ড ভিজিটে গিয়ে শিক্ষকদের সাথে কথা বলে বুঝলাম তাদের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষার্থী বসানো বেশ কষ্টকার হবে। তারপরেও বিদ্যালয় খুলে দিতে হবে। দীর্ঘদিন গৃহবন্দি থাকার ফলে শিক্ষার্থীদের শরীর ও মনের ওপর যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে এবং অনলাইন ক্লাসের সীমিত কার্যকারিতার বিবেচনায় বিদ্যালয় খোলার ঝুঁকি বেশি না হওযারই কথা। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে শিক্ষা প্রশাসন ও সাধারন প্রশাসন মিলে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও কমিটির সাথে করণীয় নির্ধারন করাটা সমীচীন হবে। তবে, মূল উদ্যোগ মাউশি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়কেই নিতে হবে। চলতি অর্থবছরে সরকারের শিক্ষা বাজেট ৬৬০০০ কোটি টাকার পুরোটাই ব্যয় হচেছনা করোনার কারনে। বিদ্যালয়ে খোলার প্রস্তুতি স্বরূপ এখান থেকে সরকার একেবারে পিছিয়ে পড়া বিদ্যালয়গুলোর জন্য কিছু অর্থ ব্যয় করতে পারে। করোনার কারণে বিদ্যালয়ের কার্যক্রম আরো এক বছর ব্যাহত হলে সে ক্ষতির ভার শিশুরা বইতে পারবেনা বলে জানিয়েছে ইউনিসেফ যা আমরাও বুঝি।ইতিমধ্যে যে ক্ষতি হয়েছে সেটি পুষিয়ে নিতেই অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে। কাজেই আর দেরি নয়।
লেখক : মাছুম বিল্লাহ, শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক।