ঢাকা কলেজের প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকতেই চোখে পড়ে প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসের বিখ্যাত উক্তি ‘নো দাইসেলফ’ (নিজেকে জানো)। ফটকের ওপরে ইংরেজিতে বড় বড় অক্ষরে লেখা আছে এ উক্তিটি। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা শিক্ষার্থীদের সুশিক্ষার মাধ্যমে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলাই এ বিদ্যাপীঠের মূল লক্ষ্য। ১৮৪১ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে সুনামের সঙ্গে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ঢাকা কলেজ। তবে সম্প্রতি এ বিদ্যাপীঠের কিছু ছাত্রের অপকর্ম ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। এর মধ্যে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে কলেজের আশপাশের শপিং মলগুলোর ব্যবসায়ী-কর্মচারীদের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা একটি।
এছাড়া ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজিরও অভিযোগ উঠেছে। একটি ডাকাতির মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক নেতা সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটিতেও বড় পদ বাগিয়ে নিয়েছেন।
একটি ডাকাতি মামলার অভিযোগপত্র (চার্জশিট) ঘেঁটে দেখা গেছে, ২০১৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর সকালে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকার শনির আখড়ায় র্যাবের জ্যাকেট পরে তিন-চারজনের একটি দল অনাবিল পরিবহনের একটি বাস ব্যারিকেড দিয়ে থামায়। মো. মাহমুদুল হাসান নামে ওই বাসের এক যাত্রীকে তারা আগে থেকেই টার্গেট করে। পিস্তল ঠেকিয়ে ওই যাত্রীকে নামিয়ে তার কাছে থাকা দুটি আইফোন ও ৩ লাখ টাকা নিয়ে নেয়। এ সময় মাহমুদুল হাসান চিৎকার দিলে আশপাশের লোক জড়ো হয়। তখন দুর্বৃত্তরা তাদের ব্যবহৃত একটি এক্স করোলা গাড়ি ফেলে মোবাইল ফোন ও টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়।
এ ঘটনায় যাত্রাবাড়ী থানায় বাদী হয়ে মামলা করেন মাহমুদুল হাসান। মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ঢাকা মেট্রো (উত্তর)। তদন্তে উঠে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। এ ডাকাতচক্রের হোতা হিসেবে ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের তৎকালীন যুগ্ম আহ্বায়ক ও বর্তমান কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের বর্ধিত কমিটির সহসভাপতি শুভ্রদেব হাওলাদার বাপ্পি ও ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগকর্মী মেহেদী হাসান রকির সংশ্লিষ্টতা পায় পিবিআই।
পিবিআইয়ের উপপরিদর্শক (এসআই) মো. কামাল হোসেন তদন্ত শেষে গত বছর ৩১ মে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, চক্রটি গাড়ি ভাড়া নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে ডাকাতি করে। ঘটনার সপ্তাহখানেক আগে ঢাকা কলেজের মাঠে বসে মেহেদী হাসান রকি, আশিক পারভেজ, আলমগীর খাঁ, জাহাঙ্গীর আলম স্বাধীন, ইমরান হোসেন, শুভ্রদেব হালদার বাপ্পি, রাকিব হাওলাদার ও ইউনুস হাওলাদার মিলে শনির আখড়ায় বাস ডাকাতির পরিকল্পনা করে। বাপ্পি দিকনির্দেশনা দেয়। তারা কেউ র্যাবের অফিসার, কেউ কনস্টেবলের ভূমিকা পালন করে। অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়, তারা ২০১৫ সাল থেকে ঢাকা শহরে ডাকাতি করে আসছে।
শুভ্রদেব হাওলাদার বাপ্পি গত মঙ্গলবার বলেন, ‘একই এলাকায় বাড়ি হওয়ার সুবাদে মেহেদী আমার পরিচিত ছিল। মামলার তদন্তে তার বিষয়ে পিবিআইকে আমি সহায়তা করেছি। কিন্তু মামলার অন্যান্য আসামিকে আমি চিনি না। পিবিআই কীভাবে আমার নাম পেল আমি জানি না। এটি ষড়যন্ত্রমূলক বলে আমি মনে করি।’
গত ১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকা কলেজের সামনে ছিনতাইয়ের কবলে পড়েন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী। ওইদিন সন্ধ্যায় ঢাকা কলেজ ও টিচার্স ট্রেনিং কলেজের মাঝ দিয়ে যাওয়া গলিতে এ ঘটনা ঘটে। এ সময় তার সঙ্গে থাকা মোবাইল, মানিব্যাগ ছিনিয়ে নেয় ছিনতাইকারীরা। ওই ঘটনায় ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের চার নেতাকর্মী জড়িত বলে অভিযোগ ওঠে। অভিযুক্তরা ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের মেয়াদোত্তীর্ণ আহ্বায়ক কমিটির সদস্য লিখন সরকার ও জসীম উদ্দিনের অনুসারী। সর্বশেষ গত ১৯ এপ্রিল নিউমার্কেট এলাকার ব্যবসায়ী ও ছাত্রদের মধ্যে সংঘর্ষেও নর্থ হলের ছাত্রলীগ নেতা জসীম উদ্দিনের অনুসারীরা ছিল অগ্রভাগে। সংঘর্ষের সময় কুপিয়ে হত্যা করা হয় কুরিয়ার সার্ভিসকর্মী নাহিদ মিয়া ও দোকান কর্মচারী মোরসালিনকে। নাহিদ হত্যাকা-ে জড়িত কয়েকজনকে চিহ্নিত করা হয়েছে যারা কলেজ ছাত্রলীগের নেতাকর্মী।
ওই ঘটনার পরদিন গত ২০ এপ্রিল ঢাকা কলেজের কয়েকজন ছাত্রের বিরুদ্ধে টাকা না দিয়ে পাঞ্জাবি নেওয়ার অভিযোগ ওঠে। ছাত্র-ব্যবসায়ী সংঘর্ষ শেষে সায়েন্স ল্যাবের বাইতুল মামুর মসজিদ মার্কেটে একই মালিকের দুটি দোকানে এ ঘটনা ঘটে। দোকানের ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরায় আটজনকে দোকানে ঢুকতে দেখা যায়। ক্যামেরার ছবি ধরে অনুসন্ধান চালিয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে তারা সবাই ঢাকা কলেজের ছাত্র ও ছাত্রলীগকর্মী।
সায়েন্স ল্যাবের রেশম ঘর দোকানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল হালিম সাংবাদিকদের বলেন, ‘দোকানে আসা ওই ছাত্ররা আটটি পাঞ্জাবি নিয়ে যান, তবে কেউ টাকা দেননি। এ সময় তাদের কাছে টাকা চাইলে তারা আসছি বলে চলে যান। কিন্তু পরে টাকা দিতে আর কেউ আসেননি।’
নাম প্রকাশ না করে কলেজের নর্থ হলের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘ছাত্রলীগের কিছু বড় ভাইয়ের আশকারা পেয়ে একটি গ্রুপ অপকর্ম করে যাচ্ছে। তাদের বিষয়ে কেউ কিছু বলার সাহস পায় না।’
পুলিশ বলছে, সব ছাত্র খারাপ নয়। ঘুরেফিরে ৬০ থেকে ৭০ জন ছাত্রের বিরুদ্ধে নানা অপকর্মের অভিযোগ আসে।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) রমনা বিভাগের নিউমার্কেট জোনের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) শাহেন শাহ্ বলেন, ‘আমাদের কাছে লিখিত অভিযোগ তেমন আসে না। আমরা অভিযোগ পেলে কলেজের শিক্ষকদের মাধ্যমে সমাধান করি।’
এসব বিষয়ে বক্তব্য নেওয়ার জন্য ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যের মোবাইল ফোনে একাধিকবার ফোন করলেও তারা ধরেননি।
ঢাকা কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ এটিএম মইনুল হোসেন বলেন, ‘আমরা শিক্ষার্থীদের অ্যাকাডেমিক বিষয় দেখি। আইনশৃঙ্খলা পরিপন্থী কোনো কাজ কেউ করলে তা পুলিশ প্রশাসন যথাযথ ব্যবস্থা নেবে। এ বিষয়ে আমরা কোনো হস্তক্ষেপ করব না।’ তিনি আরও বলেন, ‘২০ হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে কয়েকজনের অপকর্মের দায় তো সবাই নেবে না। হল সুপার যারা আছেন তাদের নিয়ে আমরা বৈঠক করেছি। আমরা শিক্ষার্থীদের কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করার উদ্যোগ নিয়েছি। ঈদের পর ক্যাম্পাস খুললে আমরা কার্যক্রম শুরু করব।’
২০১৩ সালের ২৯ নভেম্বর রাতে ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের দুপক্ষের সংঘর্ষে একজন নিহত হন। এ ঘটনায় কমিটি স্থগিত করা হয়। বহিষ্কার করা হয় সাধারণ সম্পাদকসহ বেশ কয়েকজন নেতাকর্মীকে। পরে ২০১৬ সালের ১৭ নভেম্বর তিন মাসের জন্য নুর আলম ভূঁইয়া রাজুকে আহ্বায়ক করে একটি আহ্বায়ক কমিটি অনুমোদন দেয় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। ২০১৭ সালের ২২ জানুয়ারি ফের দুপক্ষের সংঘর্ষের ঘটনায় আহ্বায়কসহ ১৯ নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করা হয়। বর্তমানে ওই কমিটিতে ২৮ জন যুগ্ম আহ্বায়ক ও ৯০ জন সদস্য রয়েছেন। এর মধ্যে অনেকেই ছাত্ররাজনীতি ছেড়ে চাকরি ও সংসারজীবনে চলে গেছেন।