ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে আমার ঋণ অপরিশোধ্য - দৈনিকশিক্ষা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে আমার ঋণ অপরিশোধ্য

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী |

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে মায়ের সঙ্গে তুলনা করবার রেওয়াজ আছে; আমার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল, এখনও রয়েছে, মাতৃসম। অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান আমাকে এমন স্নেহে এবং এতটা সময় ধরে শেখায় নি। সময়টাও কিন্তু বেশ দীর্ঘ। বিশ্ববিদ্যালয় এক শ’ বছরে পা রাখছে, আমার সঙ্গে এর সম্পর্ক ৬৯ বছরের। এসেছিলাম সেই ১৯৫২-তে, তার পরে প্রথম চার বছর ছাত্র এবং অনেক বছর শিক্ষক হিসেবে কাটিয়েছি; এখনও রয়ে গেছি। সবটা সময়ই কিন্তু ছিল শেখার, সে শেখার এখনও শেষ হয় নি।

শিখেছি ক্লাস রুমে, গ্রন্থাগারে, শিক্ষক ও ছাত্রদের সঙ্গে সম্পর্কে, এবং সহপাঠীদের সান্নিধ্যে। প্রথম বছরেই আমি সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ছাত্র সংসদের নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলাম, নির্বাচিতও হয়েছিলাম; পরের তিন বছর প্রত্যেকটি নির্বাচনে আমার অংশগ্রহণ ছিল। আবার শিক্ষক হিসেবে নয় বছর আমি ডাকসু’র কোষাধ্যক্ষ ছিলাম। 

সামাজিকতার শিক্ষাটা যে কত জরুরি ও উপকারি সেটা আমি বুঝেছি ছাত্রসংসদের সঙ্গে ওই সংযোগ থেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাজীবন কিন্তু অপূর্ণ থাকে ছাত্রসংসদ কাজ না করলে। সামাজিকতা শেখার আরেকটি জায়গা ছিল। সেটা হলো সাবসিডিয়ারি ক্লাস। অনার্স ক্লাসে আমরা ছিলাম মাত্র ১২ জন; পলিটিক্যাল সায়েন্সের সাবসিডিয়ারীতে কমপক্ষে ৬০ জন হবে। সেখানে অনেকের সঙ্গে বন্ধুত্ব। সে-বন্ধুত্ব পরের দিনগুলোতেও অক্ষুন্ন ছিল।

আমার জন্য মস্ত বড় আকর্ষণ ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল গ্রন্থাগারটি। ছাত্রজীবনে গ্রন্থাগারের পাঠকক্ষ পর্যন্ত ছিল আমার দৌড়, তার ভেতরের জগৎটা ছিল অনধিগম্য ও অতীব আকর্ষণীয়। শিক্ষক হিসেবে গ্রন্থাগারে অবাধ বিচরণের সুযোগ আমাকে মুক্তির স্বাদ দিয়েছে এবং আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে চেয়েছি তার একটা কারণ ছিল ওই গ্রন্থাগার।

শুরু থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছিল দু’টি বৈশিষ্ট্য। একটি তার আবাসিক চরিত্র, অন্যটি তিন বছরের অনার্স কোর্স। আবাসিক হলগুলোকে জীবন্ত রাখতো ছাত্রসংসদের বার্ষিক নির্বাচন এবং বছর জুড়ে সংসদের সাংস্কৃতিক কাজকর্ম। দ্বিতীয় বর্ষে দুটো সাবসিডিয়ারি পরীক্ষা দিয়ে আমরা ভারমুক্ত হতাম, পরের বছর পুরোপুরি এবং কেবলই অনার্সের বইপত্র পড়া। ওই তৃতীয় বর্ষে নতুন যা পড়েছি সেসব তো বটেই, আগের দু’বছরে যা পড়েছিলাম তাও পুনর্পাঠ ঘটতো। অনার্সের পাঠ্যবিষয়টা একসঙ্গে পেতাম। সে-ব্যবস্থাটা কিন্তু এখন আর নেই। কোর্স ও সেমিস্টার সিস্টেম এসে তিন বছরের সংবদ্ধ শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচিকে টুকরো টুকরো করে দিয়েছে। এখনকার ছেলেমেয়েরা তৃতীয় বর্ষে আসে প্রথম দুই বছরের বইপত্র ও কাগজখাতা দূরে সরিয়ে রেখে। অনভ্যাসে বিদ্যালয়ের আশঙ্কা দেখা দেয়। আমাদের সময়ে টিউটরিয়ালের ব্যবস্থা ছিল। চার-পাঁচজনের গ্রুপে একজন শিক্ষকের সাথে প্রতি সপ্তাহে একবার মিলিত হতাম। সেখানে আমরা লিখতাম, বলতাম এবং শুনতাম। তিনটাই ছিল খুব উপকারী। এখন তাও গেছে চলে।

এ ভাঙচুরটা কিন্তু শিক্ষাগত বিবেচনায় ঘটে নি, ঘটেছে রাজনৈতিক কারণে। রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করেছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিল দু’বছর পেরিয়ে সাবসিডিয়ারী এবং তিন বছরের শেষে অনার্সের পরীক্ষার বদলে ছয় মাস পর পর পরীক্ষা নেওয়া হবে, ছেলেমেয়েরা পরীক্ষার দুশ্চিন্তায় অস্থির থাকবে, ঘাড় তুলবার সময় পাবে না; তারা রাজনীতি ছাড়বে। ওই একই কারণে ছাত্রসংসদের নির্বাচনও এক সময়ে বন্ধ হয়ে গেল। ফলটা শুভ হয় নি। শিক্ষার জন্য নয়, সমাজের জন্যও নয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ বার বার ঘটেছে। বড় আকারে ঘটে ১৯৫২-তে, অবিশ্বাস্য রকমের ভয়াবহ মাত্রায় ঘটেছে ১৯৭১-এ। দু’টি ঘটনারই আমি প্রত্যক্ষদর্শী। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিতে পুরাতন কলাভবনের আমতলার জমায়েতে আমিও ছিলাম; কাঁদানে গ্যাসের মোকাবিলায় সেটিই আমার প্রথম অভিজ্ঞতা। আবার একাত্তরে পঁচিশে মার্চের রাতেও আমি উপস্থিত, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার বাসিন্দা হিসেবে। রাষ্ট্র অস্ত্রহাতে আক্রমণ করলো, রক্তপাত ঘটালো, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পরাজিত হলো। পরাজয় দুইবারই। এবং বিশ্ববিদ্যালয় যে শক্তির প্রতিভূ তার কাছেই।

বায়ান্নর শেষ দিকে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই তখন নতুন স্বাধীনতার এবং পাকিস্তানবাদিতার আবহাওয়াটা যে একেবারে কেটে গেছে তা নয়। রাষ্ট্রকে ভাঙার কথাও ওঠে নি। দাবিটা ছিল বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করবার। ঘটনার কয়েক বছর পরে আমাদের শিক্ষক সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন একটি প্রবন্ধে ভাষা আন্দোলনকে ‘ল্যাঙ্গুয়েজ রায়ট’ বলেছিলেন।  এই মনোভাবটি তাঁর একার নয়, অন্য কারো কারো মধ্যেও ছিল। আবার যে জায়গাটাতে পুলিশের গুলিতে বরকত শহীদ হলেন তার কাছেই, দশ বছর আগে নাজির আহমদ নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র প্রাণ হারিয়েছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ের ছাত্রদের ছুরিকাঘাতে। সেই স্মৃতি যে একেবারে মুছে গিয়েছিল তাও নয়; কিন্তু বাঙালী জাতীয়তাবাদ দ্রুত এগুচ্ছিল।

মুনীর চৌধুরী আমাদের বিভাগের শিক্ষক ছিলেন, কিন্তু ক্লাসরুমে তাঁকে আমরা পেলাম না, কারণ তখন তিনি জেলে। তাঁর অপরাধ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক। জেলে থাকা অবস্থায় তিনি বাংলা সাহিত্যে এম এ পরীক্ষা দিয়ে খুব ভালো ফল করলেন এবং যখন বের হয়ে এলেন তখন আর ইংরেজী বিভাগে রইলেনই না, বাংলা বিভাগে চলে গেলেন। বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল না যে বাঙালী জাতীয়তাবাদই মূল ধারায় পরিণত হবে। আমাদের শিক্ষক খান সারওয়ার মুর্শিদ প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ইংল্যান্ডে যাবার; তাঁর সঙ্গে ড. সাজ্জাদ হোসায়েনের খুব ভালো সম্পর্ক ছিল; ইংল্যান্ডে তাঁরা একই বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং একই শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে ডক্টরেট করেছেন।

দু’জনেই পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদী ছিলেন, এক সময়ে যেটা ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু ধীরে ধীরে দেখা গেল তাঁরা পরস্পর থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন; কারণ ড. হোসায়েন পাকিস্তানপন্থীই রয়ে গেলেন, ড. মুর্শিদ এগিয়ে গেলেন বাঙালী জাতীয়তাবাদের দিকে। শেষ পর্যন্ত দু’জনের ভেতর কথাবার্তাই বন্ধ হয়ে গেল। একই ঘটনা ঘটেছিল ড. হোসায়েনের সঙ্গে অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের সম্পর্কের বেলাতেও। অধ্যাপক রাজ্জাক যখন শিক্ষক, ড. হোসায়েন তখন ছাত্র। এক সময়ে দু’জনেই ছিলেন পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদী, তাঁদের সম্পর্কটাও ছিল খুবই ঘনিষ্ঠ; কিন্তু ১৯৬৫-এর যুদ্ধের পর সে সম্পর্কটা আর রইলো না, ওই জাতীয়তাবাদের প্রশ্নেই।

আইয়ুব খানের শাসনামলে পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদকে পোক্ত করবার চেষ্টা নিরন্তর চলছিল। এ কাজে রাষ্ট্রক্ষমতা যত তৎপর হয়েছে বাঙালী জাতীয়তাবাদের শক্তি ততোই বেড়েছে। আইয়ুব খান আরেক কাণ্ড করেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়কে তিনি সরকারী দপ্তরে পরিণত করতে চেয়েছিলেন। তাঁর সামরিক শাসনের শুরুতেই ঢাকা হাইকোর্টের বিচারপতি হামুদুর রহমানকে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য করে বসিয়ে দিয়েছিলেন। এই উপাচার্য হুকুম জারি করেছিলেন ক্লাস থাকুক না-থাকুক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরকে দশটা পাঁচটা অফিস করতে হবে।

সেসময়ে কলা অনুষদের ডীন ছিলেন অধ্যাপক আবদুল হালিম, তিনি উপাচার্যকে গিয়ে বললেন, দশটা-পাঁচটার জোয়ালে আটক থাকলে শিক্ষকরা নিজেদের পড়াশোনা ও গবেষণা করবেন কখন? উপাচার্য তাঁকে বলেছিলেন, “পড়াশোনা করছেন বলেই তো আপনাদেরকে চাকরি দেওয়া হয়েছে, আবার কি?” উপাচার্যের ওই হুকুম প্রচুর হাস্যরসের সৃষ্টি করেছিল এবং অবশ্যই তাঁর হুকুম বহাল থাকে নি; কিন্তু এর রাষ্ট্রের সামরিক শাসকরা যা করেছিল সেটা ছিল আরও মারাত্মক। তারা এমন একটি আইন জারি করলো যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন বলতে কোনো কিছু আর অবশিষ্ট রইলো না।

এটা শুধু যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য জারি করা হয়েছিল তা নয়, পাকিস্তানের সকল বিশ্ববিদ্যালয়েই একই রকম নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। স্বভাবতই প্রতিবাদ হয়েছে, এবং সেটা সারা পাকিস্তান জুড়েই। তাই দেখা গেছে ছাত্ররা যখন আইয়ুব শাহীর পতন চেয়ে আন্দোলন করছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও তখন আন্দোলনে নেমেছেন শিক্ষার ব্যাপারে স্বাধীনতার জন্য। সেই স্বাধীনতা পাওয়া গেল বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হবার পর, বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নতুন একটা অধ্যাদেশ জারির মধ্য দিয়ে। আমরা ভাবলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরী করা যাবে। উপাচার্য, ডীন, সিন্ডিকেট, সিনেট- সর্বত্রই নির্বাচনের বিধি তৈরী হলো।

কিন্তু দেশে যেমন, বিশ্ববিদ্যালয়েও তেমনি, গণতন্ত্র শক্তিশালী হয় নি। আমরা আশা করছিলাম গণতন্ত্রের চর্চার ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় হবে অগ্রপথিক, সেটা ঘটলো না। অভিযোগ আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বড় বেশী দলাদলি করেন। কথাটা অর্থসত্য মাত্র। নির্বাচনী ব্যবস্থা আছে, একা একা নির্বাচন করা যায় না, তাই নির্বাচনী জোট তৈরী হয়েছে; ভিত্তিটা ছিল মতাদর্শগত ভিন্নতা। সেটা কোনো খারাপ ব্যাপার নয়। শিক্ষকতা কখনোই তাঁদের রাজনৈতিক অবস্থানকে ছাত্রদের মধ্যে নিয়ে যেতে সচেষ্ট হন নি। নির্বাচন ব্যবস্থার ফলে দু’টি ভালো জিনিস পাওয়া গিয়েছিল, একটি হলো শিক্ষকদের ভেতর পরিচিতি গড়ে তোলা। দ্বিতীয়টি এই বোধ তৈরী হচ্ছিল যে, শিক্ষকদের ভেতর জ্ঞান ও বয়সের পার্থক্য অবশ্যই সত্য কিন্তু এটাও সত্য যে শিক্ষক হিসেবে তাঁরা একই সমতলে রয়েছেন।

এক কথায় বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন অধ্যাদেশ আমাদেরকে সামন্তবাদী সংস্কৃতির বলয় থেকে বের হয়ে গণতন্ত্রের প্রশস্ত ক্ষেত্রে আসবার সুযোগ করে দিয়েছিল। গণতন্ত্রের সুফল যে পুরোপুরি পাওয়া যায় নি তার দায় গণতন্ত্রের নয়, দায় রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের। ঘটনাটা আমরা ঘটতে দেখলাম, কিন্তু থামাতে পারলাম না। এক সময়ে দেখা গেলো সাদা ও নীল উভয় গোষ্ঠীর কিছু শিক্ষক বড় দুই রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। রাজনৈতিক নেতাদেরও আগ্রহ ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ভেতরে সমর্থক জোগাড় করার। এভাবেই বাইরের দলীয় রাজনীতিটা চলে এসেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ভেতরে। ক্ষুন্ন হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা ঘটেছিল সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের দেওয়া ‘কনশেসন’ হিসেবে; শাসক বদল হয়েছে কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় স্বাধীন হয় নি।

রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ আরেক ভাবে ঘটছিল। সেটা হলো মেধাবান তরুণদেরকে সরকারী চাকরীতে টেনে নিয়ে যাওয়া। সরকারী চাকরীতে ক্ষমতা, উন্নতি ও অর্থ, তিনটিরই প্রাপ্তির যে সুযোগ ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় তা ছিল না। যে তরুণরা শিক্ষক হলে তাঁদের নিজেদের জন্য এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের জন্য ভালো হতো তাঁরা অনেকেই সরকারী চাকরীতেই চলে গেছেন। এটা ব্রিটিশ আমলে ঘটেছে, পাকিস্তান আমলে তো কমেই নি, বরং বেড়েছে। দেখা যেত বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় যারা ভালো ফল করেছেন তাঁরা সরাসরি সিভিল সার্ভিসে যাবার লক্ষ্যে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

কেউ কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতেন প্রস্তুতিকালীন সময়টা কাটাবার জন্য। আমি যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ পেয়েছিলাম সেটা অত দ্রুত সম্ভব হতো না, যদি না আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ সিভিল সার্ভিসে চলে যেতেন। সেকালে পদ খালি না হলে নতুন নিয়োগের কোনো সুযোগ ছিল না; আর পদসৃষ্টি ছিল প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। আমার পিতা সরকারি চাকরি করতেন, তিনিও চেয়েছিলেন আমি সিভিল সার্ভিস মুখো হই, এবং না-হওয়াতে যে মনোক্ষুন্ন হন নি এমন নয়। রাষ্ট্র টানতো, বিশ্ববিদ্যালয়ও ঠেলে দিতো, কেননা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরীতে সুযোগ-সুবিধাগুলো ছিল অত্যন্ত সীমিত।

বায়ান্নতে যখন প্রবেশ করি তখন আমাদের বিভাগে শিক্ষক ছিলেন অল্প কয়েকজন। অমলেন্দু বসু গেছিলেন অক্সফোর্ডে, ডক্টরেট শেষ করে তিনি আর ঢাকায় ফেরৎ আসেন নি, দেশভাগের কারণে। এফেসর এ জি স্টক এসেছিলেন অক্সফোর্ড থেকে, সাতচল্লিশের আগস্টের অল্পকিছু আগে। শিক্ষক হিসেবে তিনি অত্যন্ত খ্যাতিবান ছিলেন, পণ্ডিত হিসেবেও; এবং উপনিবেশবাদবিরোধী ছিলেন দৃষ্টিভঙ্গিতে, যে জন্য তাঁর ঢাকায় আসা। সাতচল্লিশের পর থেকেই ছাত্রবিক্ষোভে বিশ্ববিদ্যালয় তপ্ত হয়ে উঠছিল, প্রফেসর স্টক টের পাচ্ছিলেন যে তাঁকেও সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে; তাঁর চিঠিপত্র গোয়েন্দারা নাড়াচাড়া করছে।

এমন পরিস্থিতিতে তিনি ভাবলেন সম্মানের সঙ্গে বিদায় নেওয়া ভালো। সেটাই তিনি করেছেন, চলে গেছেন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের আগেই। আমরা তাঁকে পাই নি। তবে আমাদের অনার্সের মৌখিক পরীক্ষা নিতে তিনি এসেছিলেন। প্রফেসর স্টক কিন্তু আবারও এলেন, এবং এবারও স্বেচ্ছায়; একাত্তরের পরে। ড. মুর্শিদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল, ব্যবস্থাটা তিনিই করেছিলেন। একান্নতে প্রফেসর স্টক চলে গেছিলেন যে-বাঙালী জাতীয়তাবাদের উন্মেষ দেখে, বায়াত্তরের এসে তারই বিজয় দেখতে পেলেন। কিন্তু নতুন রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক পরিস্থিতি যে তাঁকে সন্তুষ্ট করতে পেরেছিল এমনটা মনে হয় নি। এক বছর থাকার পর তিনি চলে গেলেন। যাবার আগে অবশ্য একটি বই লিখে গেছেন, মেময়ার্স অব ঢাকা ইউনিভার্সিটি নাইনটিন ফরটি সেভেন-ফিফটিওয়ান নামে। চমৎকার বই। উপন্যাসের মতো।

স্টকের পরে আরেকজন ইংরেজ এসেছিলেন, প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে। নাম জে এস টার্নার। তাঁর সময়ে আমরা ছাত্র। তিনি ছিলেন অনেকটা দার্শনিকের মতো। প্রিয় কবি ছিলেন মিল্টন ও ওরার্ডসওয়ার্থ; তিনি ওই দুই কবির কবিতা পড়াতেন, এবং আমরা টের পেতাম খুব আনন্দ পাচ্ছেন পড়িয়ে, এবং সচেষ্ট রয়েছেন নিজের আনন্দকে আমাদের কাছে পৌঁছে দিতে। ১৯৭২-এ তিনিও একবার এসেছিলেন তাঁর প্রিয় ঢাকা ও পূর্ববঙ্গকে দেখতে। তখন তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন।

তাঁর সঙ্গে দেখা কলকাতার এক সেমিনারে, যেখানে আমি বাংলাদেশে জাতীয়তাবদ ও গণতন্ত্রের ওপর একটি প্রবন্ধ পড়েছিলাম; তিনি শুনলেন এবং শুনে বললেন, “তা ভালোই লিখেছ হে, কিন্তু বেশ পলিটিক্যাল”। মন্তব্যটা মনে আছে। সাহিত্যে পাঠদানের আরেকটি ধরন ছিল, সেটি ব্যাখ্যা করা, শব্দের অর্থ স্পষ্ট করা, উপমাগুলোর তাৎপর্য তুলে ধরা। এই রীতিতে পড়াতেন বি সি রায়। পড়তেন; এবং পড়াতে ভালোবাসতেন। ছিলেন অকৃতদার। ছাত্রজীবনে তো বটেই, যখন শিক্ষক হয়েছি তখনও টের পেয়েছি তেভরে ভেতরে ছিলেন অত্যন্ত স্নেহপ্রবণ। ধুতি পরে আসতেন; কিন্তু সে পরিধেয়তে থাকতে পারলেন না, ১৯৬৪-এর দাঙ্গার পরে নিরাপত্তার স্বার্থে তাঁর শুভার্থীরা তাঁকে পোশাক বদলানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন; বদলানো পোশাকে কয়েকদিন এসেছেনও; কিন্তু কাজটা তাঁর কাছে কতটা অপমানজনক মনে হয়েছে জানি না, আমরা কিন্তু অপরাধী মনে করেছি নিজেদেরকে। আমি তো চোখ তুলে তাঁর দিকে তাকাতেই পারি নি; লজ্জায় ও অপরাধবোধে।

এর পরে অবশ্য তিনি বেশীদিন আমাদের সঙ্গে থাকেন নি, অবসর গ্রহণ করে কলকাতায় চলে গেছেন। শিক্ষা ছুটি নিয়ে কেম্ব্রিজ গেছিলেন সৈয়দ আলী আশরাফ, তিনি ফিরে এসেছিলেন আমরা যখন প্রথমবর্ষের ছাত্র তখনই। সাহিত্যপাঠে তখন নতুন একটি রীতির প্রবর্তন ঘটছিল; সেটা ছিল টেক্সটের পুঙ্খাণুপুঙ্খ বিশ্লেষণ; বৈজ্ঞানিক ভাবে নয়, নান্দনিক ভাবেই। এই পদ্ধতিতে সাহিত্যপাঠ ও সাহিত্যের মর্মোদ্ধার আরও গভীর হতো। সৈয়দ আলী আশরাফ ওই রীতির সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি বেশী দিন রইলেন না, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে গেলেন। জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার উপস্থিতিটা ছিল খুবই উজ্জ্বল। আমরা জানতাম তিনি এম এন রায়ের রাজনৈতিক মতাদর্শে আস্থাবান ছিলেন; যে আস্থার প্রতিফলন ঘটেছিল মুক্তি নামে একটি সাহিত্যপত্রিকার মধ্যে।

পত্রিকাটি তিনি যে সম্পাদনা করতেন তা নয়। তবে তিনি ছিলেন পেছনের অনুপ্রেরণা। মুক্তি কেবল যে নামের ওই বানানের জন্য বিশিষ্ট ছিল তা নয়, সেখানে যে আলোচনাগুলো বের হতো সেগুলোও ছিল মনোযোগ দিয়ে পড়বার মতো। কিন্তু পত্রিকাটি টেকে নি। জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা ও তাঁর স্ত্রী বাসন্তী গুহঠাকুরতা ছিলেন মনেপ্রাণে শিক্ষক; তাঁরা দেশ ছেড়ে যাবেন এমনটা কখনো ভাবেন নি; যাকে বলে মাটি কামড়ে পড়ে থাকা অনেকটা সেভাবেই রয়ে গেলেন, এবং আমাদের এই শিক্ষক, যাঁর উপস্থিতিতে আমরা অনুপ্রাণিত বোধ করতাম। তিনি চলে গেলেন একাত্তরে, পাকিস্তানী হানাদারদের আক্রমণে।

তা একাত্তর আমাদের জন্য কেমন অভিজ্ঞতা ছিল তা বর্ণনা করা কঠিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল আক্রমণের প্রথম কেন্দ্রগুলোর একটি। ওই আক্রমণে ছাত্র, শিক্ষক, কর্মচারী- কোনো বাছবিচার করা হয় নি। পরে, ১৪ ডিসেম্বরে ঘটেছে ‘নির্বাচিত হত্যাকাণ্ড’। পঁচিশে মার্চ আমরা বেঁচে গেছি আমাদের আবাসিক এলাকাটিতে হানাদারেরা ঢোকে নি বলে, পরে আমি বাঁচলাম পলাতক থাকার দরুন। আল-বদর যাদের খুঁজেছিল আমিও তাঁদের একজন ছিলাম। সামরিক প্রশাসক হিসেবে বিদায় নেবার আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ছয়জন শিক্ষককে সতর্ক করে দিয়ে গিয়েছিল তাঁদের মধ্যে আমিও একজন। ওই প্রথম ও শেষবার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পরিচয়টা হয়ে দাঁড়িয়েছিল অনিরাপদ।

বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের ছাত্রকালের বিভাগীয় পাঠ্যসূচী সম্পর্কে একটু বলি। পাঠ্যসূচী ছিল খুবই সঙ্কীর্ণ, বলা যায় দরিদ্র। ধরা যাক, আধুনিক ইংরেজি সাহিত্যের তিনজন প্রধান ঔপন্যাসিক- কনরাড, ফরস্টার ও লরেন্সের কথা, তাঁরা কেউই কিন্তু আমাদের সময়কার পাঠ্যসূচিতে স্থান পান নি। কারণ হতে পারে দু’টো; একটি ভিক্টোরীয় নীতিবোধের অবশেষের উপস্থিতি; অন্যটি হয়তো মফস্বলের শিক্ষার্থীদের প্রতি কর্তৃপক্ষের করুণা। তা শিক্ষার্থীদের অবমূল্যায়ণ কর্মক্ষেত্রেও ঘটেছে। প্রথম দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটদের তেমন একটা পাত্তা দেওয়া হতো না, বিশেষভাবে চাকরীবাকরীর ক্ষেত্রে; পরে অবশ্য সেটা কেটে গেছে। তবে আমার মনে পড়ে ফুলব্রাইট স্কলার হিসেবে একজন অধ্যাপিকার পড়ানোর কথা। তিনি আমাদের পড়িয়েছেন ‘দি রেইপ অব লক্’ নামের দীর্ঘ কবিতাটি। এমন ভাবে পড়ালেন যেন আমরা স্কুলের ছাত্রছাত্রী।

আমরা টের পাচ্ছিলাম যে আমেরিকার চোখ পড়েছে পূর্ববাংলার ওপরে। তাদের ভয় ছিল কমিউনিজমের। শুরুতে পাঠ্যসূচীতে কোনো আমেরিকান লেখকের উপস্থিতি ছিল না; কিছুদিন পরে দেখা গেল আমেরিকান সাহিত্য বলে একটি বিকল্প পত্র এসে গেছে। বইপত্র সব আমেরিকার দূতাবাস থেকে আসছে। বৃত্তিও দেওয়া হচ্ছে আমেরিকায় যাবার। আরও পরে দেখেছি বরিস পাস্তারনেকের ড. জিভাগো উপন্যাসটির কপি বিনামূল্যে বিতরণ করা হচ্ছে শিক্ষকদের মধ্যে, কংগ্রেস ফর কালচারাল ফ্রিডমের বেনামিতে।

আগে বৃত্তি পাওয়া যেত ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে, উচ্চশিক্ষার জন্য আমি যে বিদেশে গিয়েছিলাম সেটা ব্রিটিশ বৃত্তিতেই; পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে যুক্ত হলো আমেরিকায় যাবার সুযোগ। ততোদিনে রাষ্ট্রীয় ভাবে আমেরিকা পাকিস্তানের ঘাড়ে বেশ ভালো ভাবেই সওয়ার হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাদের চোখ তো পড়বেই। মুনীর চৌধুরীকে নিয়ে যাওয়া হলো আমেরিকায়, ভাষাতত্ত্ব পড়বার জন্য। তিন মাসের লীডারশিপ এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামে শিক্ষকদের কেউ কেউ গেলেন শিক্ষাভ্রমণে। সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েনও গিয়েছিলেন এবং আমেরিকা থেকে কয়েকটি চিঠি লিখেছিলেন পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকায়।

১৯৫৮ সালে রকফেলার ফাউন্ডেশন আমাদের ইংরেজি বিভাগকে বেশ বড় অঙ্কের একটা অনুদান দিয়েছিল সাম্প্রতিক বাংলা সাহিত্যের ওপর আটটি সেমিনার করবার জন্য। ওদিকে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরে ইংরেজদের দৃষ্টিভঙ্গিতে একটা পরিবর্তন দেখা গেল, তারা সাহিত্যপাঠের জন্য বৃত্তি না দিয়ে ভাষার পঠন-পাঠন লেখার জন্য বৃত্তি দেওয়াতে আগ্রহী হয়ে উঠলো। ধারণাটা হয়তো এই ছিল যে সাহিত্য হলো গিয়ে উপরকাঠামোর ব্যাপার, ভাষা শেখাতে পারলে সংস্কৃতির গভীরে প্রবেশ করা যাবে, এবং বাণিজ্যিক ভাবেও ওই শিক্ষাদান লাভজনক হবে।

আমরা যখন ছাত্র তখন রেডিওর প্রচার কেন্দ্রটি ছিল কলাভবনের খুব কাছে, নাজিমুদ্দিন রোডে। ওই ভবনটি আমাদেরকে খুব টানতো; সেখানে শিক্ষকরা যেতেন, আমরা ছাত্ররা যাদের অল্পস্বল্প লেখার অভ্যাস তারাও যাতায়াত করতাম। সেটা ছিল একটি বিশেষ সুযোগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে আমার ঋণ অপরিশোধ্য; সে-ঋণ যতো বেড়েছে বহন করে ততোই আমি সাবালক হয়েছি।

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

স্কুল-মাদরাসা বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বন্ধ রাখার নির্দেশ হাইকোর্টের - dainik shiksha স্কুল-মাদরাসা বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বন্ধ রাখার নির্দেশ হাইকোর্টের ঢাকাসহ ১৩ জেলার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কাল বন্ধ - dainik shiksha ঢাকাসহ ১৩ জেলার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কাল বন্ধ প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপের মৌখিক পরীক্ষা শুরু ৯ মে - dainik shiksha প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপের মৌখিক পরীক্ষা শুরু ৯ মে বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি নীতিমালা প্রণয়নের নির্দেশ হাইকোর্টের - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি নীতিমালা প্রণয়নের নির্দেশ হাইকোর্টের প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের নতুন নির্দেশনা টেম্পু চাপায় কলেজছাত্রী নিহত - dainik shiksha টেম্পু চাপায় কলেজছাত্রী নিহত কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0042510032653809