দুদকের অভিযান: শুধু শিক্ষকেরাই দুর্নীতিবাজ? - দৈনিকশিক্ষা

দুদকের অভিযান: শুধু শিক্ষকেরাই দুর্নীতিবাজ?

মাছুম বিল্লাহ |

২০১৭ সালের মার্চ মাসে রাজধানীর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ‘সততা সংঘের’ এক অনুষ্ঠানে কোচিং বাণিজ্য নিয়ে দুদক চেয়ারম্যান বলেছিলেন, ‘সেদিন খুব কাছে, যেদিন শিক্ষা বাণিজ্যিকীকরণের অবৈধ কোচিং সেন্টার বন্ধ হবে। একই সঙ্গে গাইড বইও থাকবে না।

শিক্ষকরাই হবেন শিক্ষার্থীদের গাইড। শিক্ষকদের উদ্দেশে তিনি বলেছিলেন, আমাদের সন্তানদের আপনাদের কাছে আমানত রেখেছি, আমানতের খেয়ানত করবেন না। তাদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলুন। ’ চমৎকার কথাই বলেছেন দুদক চেয়ারম্যান। দুদক টিমের সদস্যরা গোপনে অনুসন্ধান চালিয়ে কিছুসংখ্যক কোচিং সেন্টারের নাম, সেখানকার শিক্ষক, শিক্ষকদের স্কুল বা কলেজ, আয়-ব্যয়, নামে-বেনামে সম্পদ, সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীদের নাম ও তাঁদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম সংগ্রহ করেছেন। যেকোনো খাতের দুর্নীতি বন্ধে দুদক বদ্ধপরিকর। এর মধ্যে শিক্ষা খাতে দুর্নীতি বন্ধে বিশেষ গুরুত্বসহকারে কাজ করা হচ্ছে বলে দুদক থেকে মন্তব্য করা হয়। কারণ এখান থেকেই ভবিষ্যৎ নাগরিকদের চরিত্র গঠন শুরু হয়।

কোচিং বাণিজ্যের বিষয়টি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নজরে এলে কোচিং নিয়ন্ত্রণে মন্ত্রণালয় নীতিমালা তৈরি করে প্রজ্ঞাপন জারি করে ২০১২ সালের মাঝামাঝি। নীতিমালায় বলা হয় যে নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কোচিং অথবা প্রাইভেট পড়াতে নিষেধ করা হয়েছে। তবে কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ ১০ জন শিক্ষার্থীকে নিজ বাসায় পড়ানোর সুযোগ দেওয়া হয়েছে। কোচিং সেন্টারের নামে বাসা ভাড়া নেওয়ার ক্ষেত্রে বিধি-নিষেধের কথা বলা হয়েছে। দুদক বলছে, ওই ১০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে যদি একজনও নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী হয়, তাহলেও শিক্ষককে অভিযুক্ত করা হবে। নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের পড়ানো যাবে না, এটি যদি ঠিকই কার্যকর করতে পারত দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো, তাহলে শিক্ষাক্ষেত্রে অনেকটাই পরিবর্তন আসত। কিন্তু আমরা তা করতে পারলাম না কেন?

দুদক চেয়ারম্যান বলেন, কোচিং বাণিজ্য নিয়ে জনসাধারণের মধ্যে এক ধরনের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আছে। এই কোচিং বাণিজ্যের জন্যই অনেক অভিভাবক শিক্ষার্থীদের স্কুলে পড়াতে আগ্রহী হন না। শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটা সমতা আনতেই কোচিং বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত শিক্ষকদের চিহ্নিত করার কাজ শুরু করা হয়েছে। রাজধানীর ১৫টি নামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভর্তি বাণিজ্যের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছিল এ বছরের জানুয়ারি মাসে। আর মে মাসে শুরু হয়েছে কোচিং বণিজ্যের বিরুদ্ধে অভিযান। শিক্ষার্থীদের মধ্যে সমতা আনতেই কোচিং বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত শিক্ষকদের চিহ্নিত করার কাজ শুরু করেছে দুদক। তারই ধারাবাহিকতায় কোচিং বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে ঢাকা মহানগরের আট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৯৭ জন শিক্ষকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার সুপারিশ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন। কথা হচ্ছে ক্লাসের বাইরে শিক্ষার্থীদের পড়ার প্রয়োজন হচ্ছে কেন? আমাদের বিদ্যালয়গুলোতে কি পর্যাপ্ত এবং প্রয়োজনীয়সংখ্যক শিক্ষক আছেন? যাঁরা শিক্ষকতায় আছেন তাঁরা কি কঠিন বিষয়গুলো পড়াতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, অর্থাৎ তাঁদের কয়জন কঠিন বিষয় পড়ানোর সঙ্গে আছেন? আমরা কি সঠিক শিক্ষক নিয়োগ নিশ্চিত করতে পেরেছি? না করতে পারলে সে জন্য কে বা কারা দায়ী, আমরা কি তাদের চিহ্নিত করতে পেরেছি? আমাদের মনে রাখতে হবে, সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতি চালু করার পর কোচিং ব্যবসা যেন আরো বেড়ে গেছে, কারণ বেশির ভাগ শিক্ষক এই পদ্ধতি এখনো ঠিকমতো বোঝেন না। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা দ্বারস্থ হচ্ছেন কোচিং কিংবা প্রাইভেট শিক্ষকদের কাছে, যাঁরা বিষয়টি একটু বোঝেন তাঁদের কাছে। এর সমাধান কী?

আমাদের দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে নানামুখী ও নানা ধরনের সমস্যা ও সংকট রয়েছে, যেগুলোর সঙ্গে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন তো রয়েই গেছে। কিন্তু শিক্ষার দুর্নীতি তো শুধু কিছু শিক্ষকের প্রাইভেট পড়ানোর মধ্যে নয়। মাউশি—যেখানে শিক্ষকদের যেতে হয় সব কাজের জন্য, সেখানে তো দুর্নীতির আখড়া। সরকারি বিনা মূল্যের বই আনতেও মাঠপর্যায়ে অত্যন্ত গোপনে ঘুষ দিতে হয়। এগুলোও দুদকের দেখা উচিত। ক্লাসরুমে শিক্ষার্থীর অনুপস্থিতি, পাঠাভ্যাসে অমনোযোগ, শিক্ষকের পাঠদানে নিরুৎসাহ, শ্রেণিকক্ষের বাইরে প্রাইভেট পড়ানোর সবই শিক্ষা বিস্তারের অন্তরায়। কোচিং সেন্টারগুলো দখল করে নিয়েছে শিক্ষাঙ্গনের স্বাভাবিক কার্যক্রম। অনেক ক্ষেত্রে নেমে এসেছে অনিয়ম-অরাজকতা। কেন এগুলো হচ্ছে?

একসময় শুরু হয়েছিল নকলের মহোৎসব। বর্তমানে নকলপ্রণতা কমে গেলেও শুরু হয়েছে প্রশ্নপত্র ফাঁসের জয়জয়কার। এ থেকে বাদ যাচ্ছে না দেশের সর্বোচ্চ প্রতিযোগিতামূলক বিসিএস পরীক্ষাও। এর সঙ্গে শুধু শিক্ষকরাই কি জড়িত? যেসব শিক্ষক জড়িত তাঁদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। শ্রেণিকক্ষে যথাযথভাবে শিক্ষাদানের বদলে আজকাল অনেক শিক্ষক প্রাইভেট টিউশনির দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। সারা দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা কোচিং সেন্টারগুলোর সঙ্গে সরকারি বা বেসরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে, এমনকি শিক্ষকরাও অনেক কোচিং সেন্টারের মালিক বলে জানা যায়। শিক্ষকতাকে তাঁরা নিচ্ছেন এক লাভজনক বাণিজ্য হিসেবে। আর সে কারণে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে লেখাপড়া বাদ দিয়ে কোচিং সেন্টারে ছুটছে। শিক্ষার নামে সহজলভ্য পণ্য ক্রয় করছে সেখান থেকে।

আমরা এমন সময়ের কথা জানি, আমাদের জীবদ্দশায়ই আমরা অনেকে দেখেছি যে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকরা রীতিমতো ক্লাস নিতেন। শিক্ষার্থীরা কতটুকু শিখেছে তা আদায় করে নিতেন। তাঁরা সবাই ক্লাসের বাইরে সহশিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণে উদ্ধুদ্ধ করতেন। সে আমলে কোনো শিক্ষকের কাছে অর্থের বিনিময়ে প্রাইভেট পড়ার কথা কেউ চিন্তাও করতেন না। প্রয়োজনে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের রুমে এসে বিনা পারিশ্রমিকে পড়া বুঝিয়ে দিতেন। শিক্ষকতা পেশাকে তাঁরা গ্রহণ করেছিলেন এক মহান ব্রত হিসেবে। আমরা ভুলে যাইনি, আমাদের আবু তাহের মজুমদার স্যার, যিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কামালউদ্দিন হলের প্রভোস্ট ছিলেন। আমরা ছিলাম শহীদ সালাম-বরকত হলের শিক্ষার্থী। তিনি অফিশিয়াল কাজ শেষ করে চলে আসতেন আমাদের হলে এবং শুরু করে দিতেন আলফ্রেড টেনিশন পড়ানো। আমরা কয়েকজন শিক্ষার্থী একটি রুমে স্যারের ক্লাস করতাম। কোথায় সেই দিন?

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে দুপুরের পর শিক্ষার্থী আর থাকছে না। মাঝেমধ্যে পত্রিকায় এ নিয়ে বড় বড় প্রতিবেদন বের হয়। এ নিয়ে যদিও তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য গবেষণা নেই, তবে কারণগুলো হচ্ছে, দুপুরে শিক্ষার্থীদের যে ক্ষুধা লাগে ওই সময় পড়া বা অন্য কোনো কিছু করা তাদের কাছে ভালো লাগে না। যাদের বাড়ি কাছে তারা বাড়িতে চলে যায় খাওয়ার জন্য। খেয়ে হয়তো ক্লাসে আসে। যাদের বাড়ি দূরে তারা একবার গেলে আর আসে না। তারপর অনেকেই কোচিংয়ের সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে দোকানে কিছু একটা খেয়ে ফ্রি ঘোরাঘুরি করে কিছুক্ষণ, তারপর কোচিংয়ে ঢুকে আড্ডা মারে, পড়ে। কারণ তারা জানে যে ক্লাসে চাপাচাপি করে বসে থাকার চেয়ে কোচিং গিয়ে গালগল্প করা অনেক ভালো। এখন হয় বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ভালো টিফিনের ব্যবস্থা করতে হবে, নয়তো স্কুল টাইমিং এমন করতে হবে, যাতে তারা দুপুরের খাবার বাড়িতে গিয়ে খেতে পারে। এগুলো চিন্তা না করে দুদকের আশ্রয় নেব সেটি কেমন কথা!

লেখক: মাছুম বিল্লাহ, লেখক শিক্ষা বিশেষজ্ঞ, গবেষক ও ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত।

[মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন]

পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ - dainik shiksha পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী - dainik shiksha ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ - dainik shiksha প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন - dainik shiksha জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন কলেজ পরিচালনা পর্ষদ থেকে ঘুষে অভিযুক্ত সাংবাদিককে বাদ দেওয়ার দাবি - dainik shiksha কলেজ পরিচালনা পর্ষদ থেকে ঘুষে অভিযুক্ত সাংবাদিককে বাদ দেওয়ার দাবি পছন্দের স্কুলে বদলির জন্য ‘ভুয়া’ বিবাহবিচ্ছেদ - dainik shiksha পছন্দের স্কুলে বদলির জন্য ‘ভুয়া’ বিবাহবিচ্ছেদ জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন - dainik shiksha জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা - dainik shiksha হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে - dainik shiksha সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0068111419677734