ঢাকা-পিরোজপুর-ঢাকা রুটের (সড়কপথের) ‘দোলা পরিবহন’-এর চালক মো. আতিয়ার রহমান। এক বছর ধরে দোলা’র বাস চালান তিনি; গত ২২ বছর দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বাস চালিয়েছেন। রক্তের সুগার, রক্তচাপ, চোখের পাওয়ার ঠিক আছে কিনা তা কখনো পরীক্ষা করাননি তিনি। শরীরে কোনো জটিলতা আছে কিনা তার জানা নেই।
আতিয়ার রহমানের মতোই অবস্থা মিরপুর ও কেরানীগঞ্জ সড়কের দিশারী পরিবহনের চালক মো. আমিনের। তিনিও কখনো শরীরে জটিলতা আছে কিনা তা পরীক্ষা করাননি। বুধবার (২৮ সেপ্টেম্বর) দেশ রুপান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন ইমন রহমান।
প্রতিবেদনে আরও জানা যায় দেশের পরিবহন-চালকদের ৩৯.৩৩ ভাগ মাত্রাতিরিক্ত রক্তের সুগার ও উচ্চ রক্তচাপে ভুগছে এমন তথ্য উঠে এসেছে চালকদের স্বাস্থ্য পরীক্ষায়। সড়ক দুর্ঘটনার বড় কারণ এটা। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ও ঢাকা আহছানিয়া মিশনের (ডিএএম) ইয়ুথ ফর হেল্থ অ্যান্ড ওয়েলবিয়িংয়ের যৌথ উদ্যোগে এই পরীক্ষার আয়োজন করা হয়।
গত ২২ আগস্ট রাজধানীর খিলক্ষেত জোয়ারসাহারা বাস ডিপো ও ট্রেনিং সেন্টারে এই স্বাস্থ্য পরীক্ষায় ১৫০ জন চালক অংশ নেন। তাদের মধ্যে বাস, ট্রাক, প্রাইভেট কার ও সিএনজি অটোরিকশাচালক ছিলেন। তাদের স্বাস্থ্যের ব্যাপারে মালিক বা শ্রমিক কোনো পক্ষেরই সচেতনতা নেই।
চালকদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার ফল ঘেঁটে দেখা গেছে, ৩৬ ভাগ চালকের রক্তে মাত্রাতিরিক্ত সুগার আর ২৪ ভাগের উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে। ১১ ভাগ চালকের মাত্রাতিরিক্ত সুগার ও উচ্চ রক্তচাপ উভয়ই রয়েছে। ৬০.৬৭ ভাগ চালকের রক্তের সুগার ও রক্তচাপ স্বাভাবিক ছিল।
স্বাস্থ্য পরীক্ষার ওই আয়োজনে উপস্থিত বিআরটিএর চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, ‘আমাদের দেশের চালকরা তাদের স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন নয়। বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যসমস্যা নিয়ে তারা গাড়ি চালান। এটি সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ।’ চালকদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৬০.৬৭ ভাগ চালকের রক্তে সুগার ও রক্তচাপ স্বাভাবিক সীমার মধ্যে থাকলেও কারও কারও রক্তে সুগারের মাত্রা অনেক কম ছিল। খালি পেটে সুগার সর্বোচ্চ ৬.১ আর খাওয়ার পরে ১১.১ থাকার কথা। পরীক্ষার আগে চালকদের একটি করে মিষ্টি খাওয়ানোর পরও কারও কারও রক্তে সুগারের পরিমাণ ছিল ৪.০।
চিকিৎসকরা বলেছেন, কারও রক্তে সুগার মাত্রাতিরিক্ত কমে গেলে সেই ব্যক্তি হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে ফেলতে পারে। রক্তচাপের সমস্যা থাকলে মাথা ঘুরতে পারে ও দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায়। রক্তচাপ খুব বেশি হলে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ পর্যন্ত হতে পারে।
ঢাকা আহছানিয়া মিশনের অ্যাডভোকেসি অফিসার (পলিসি) চিকিৎসক তাসনিম মেহবুবা বাঁধন বলেন, ‘যে ৩৬ ভাগ চালকের ডায়াবেটিসের (মাত্রাতিরিক্ত সুগার) সমস্যা ধরা পড়েছে তাদের চোখ-দাঁতসহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। যাদের সুগার অনেক কম তারা গাড়ি চালানো অবস্থায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলতে পারে। আবার নিম্ন রক্তচাপও মারাত্মক। চালক হঠাৎ মাথা ঘুরিয়ে অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে। তখন দুর্ঘটনার সম্ভাবনা প্রায় ১০০ ভাগ।’
তিনি বলেন, ‘শারীরিক জটিলতার কথা এসব চালক পরীক্ষার আগে জানতই না। তারা জানত না কী সমস্যায় তারা ভুগছে। তারা না জেনেই গাড়ি চালাচ্ছে।’
রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের পরিবহন চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের শরীরে জটিলতা দেখা দিলে বিশেষ করে ঘাড়-মাথাব্যথা করলে তাদের ঘুম ভালো হয় না। গাড়ি চালানো অবস্থায় তাদের অনেকের ঝিম ধরে। অনেক চালক গাড়ি চালানো অবস্থায় ক্লান্ত হয়ে দুর্ঘটনায়ও পড়েছে।
দোলা পরিবহনের চালক মো. আতিয়ার রহমান গত রবিবার দুপুরে রাজধানীর গুলিস্তানে এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘গাড়ি চালাতে শুরু করার পর কখনো শরীর পরীক্ষা করা হয়নি। আমার বিশ্বাস, কোনো সমস্যা নেই শরীরে।’
ঢাকা-ফরিদপুর রুটের বিআরটিসি-বাসের চালক তারা চাঁদ বলেন, ‘তিন মাস অন্তর নিজের টাকায় শরীরের বিভিন্ন পরীক্ষা করাতে হয়। এখনো কোনো জটিলতা দেখা দেয়নি।’
রাজধানীর মগবাজার মোড়ে কথা হয় ‘জরুরি ওষুধ সরবরাহ’ লেখা একটি কাভার্ড ভ্যানের চালক মো. ইউনুস আলীর সঙ্গে। তিনি জানান, ‘সাত বছর ধরে গাড়ি চালাচ্ছি। প্রথমে সিরাজগঞ্জে, পরে ঢাকায়। কখনো রক্তের সুগার ও রক্তচাপ পরীক্ষা করাইনি।’
প্রতিদিনই সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনা ঘটছে। এসবে প্রাণ ও অঙ্গহানির তথ্য উদ্বেগজনক। কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না সড়ক দুর্ঘটনা। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, শুধু গত আগস্ট মাসে সারা দেশে ৪৫৮টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ৫১৯ জন ও আহত হয়েছে ৯৬১ জন।
সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ চালকের অসুস্থতা হলেও বিষয়টি বরাবর উপেক্ষিত। শুধু প্রাণহানি নয়, কোটি কোটি টাকার গাড়িও নষ্ট হচ্ছে। তারপরও পরিবহন-মালিকদের এই বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেই। চালকদের স্বাস্থ্যগত বিষয়ে খোঁজ রাখেন না তারা। শ্রমিক নেতারা দায় চাপান সরকার ও গাড়ির মালিকদের ওপর।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, ‘চালকদের শরীর গাড়িচালানোর উপযোগী আছে কিনা তা দেখার কোনো সিস্টেম নেই। কারণ তারা কোনো হেলথ সার্টিফিকেট নিয়ে গাড়ির মালিকের কাছে আসে না।’ তিনি বলেন, ‘বিষয়টি দেখে বিআরটিএ ও শ্রমিক ফেডারেশন।’
বিআরটিএ পরিচালক (রোড সেফটি) শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই-রব্বানী বলেন, ‘আমরা চালকের লাইসেন্স দেওয়ার সময় ডোপটেস্ট করি। শরীর সুস্থ থাকার মেডিকেল টেস্টের রিপোর্ট জমা নিয়ে লাইসেন্স দিই। লাইসেন্স নবায়নের সময়ও মেডিকেল টেস্টের রিপোর্ট নিই। কারও রিপোর্ট নেগেটিভ হলে তার লাইসেন্স নবায়ন করি না।’
জাতীয় সড়ক পরিবহন মোটর শ্রমিক ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট মোস্তাকুর রহমান বলেন, ‘কোনো শ্রমিক দুর্ঘটনায় অসুস্থ হলে আমরা চিকিৎসার ব্যবস্থা করি। তবে শ্রমিকদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা বাংলাদেশে এখনো গড়ে ওঠেনি। সরকার বা গাড়ির মালিকরা এই বিষয়ে কখনো ব্যবস্থা নেয়নি। আমরা দাবি তুলেছি। সংবাদ-সম্মেলনও করেছি; লাভ হয়নি।’