দ্বিজেন শর্মা আমাদের চোখ খুলে দিয়েছিলেন - দৈনিকশিক্ষা

দ্বিজেন শর্মা আমাদের চোখ খুলে দিয়েছিলেন

মোকাররম হোসেন |

মৃত্যুর তৃতীয় বার্ষিকীতে এসেও বেশ গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারছি বৃক্ষাচার্য দ্বিজেন শর্মা আমাদের জীবনে কতটা প্রভাব বিস্তার করে আছেন। অসংখ্য বিশেষণে বিভূষিত মহিরুহসম সরল এই মানুষটি কখনো বুঝতেই পারেননি, নিজের অলক্ষ্যে কতটা বিপ্লব ঘটিয়েছেন তিনি। প্রকৃতি রক্ষা ও ভালোবাসায় তিনি যে হৃদয়ছোঁয়া আহ্বান রেখে গেছেন, তা দেশের অজস্র মানুষকে এখনো বিমোহিত করে চলেছে। দেশের প্রকৃতিবিমুখ মানুষদের নতুন করে উজ্জীবিত করার ক্ষেত্রেও সফল তিনি। তিনি এমন একজন মানুষ, যাঁর জন্য পরিবেশ, প্রকৃতি ও উদ্ভিদজগতের অজানা অধ্যায়গুলো আমাদের সামনে সুন্দরভাবে উন্মোচিত হয়েছে। আজ মঙ্গলবার (১৫ সেপ্টেম্বর) প্রকাশিত প্রথমআলো পত্রিকায় এই মতামতটি প্রকাশিত হয়েছে। মতামতটি লিখেছেন প্রকৃতি ও পরিবেশ বিষয়ক লেখক মোকাররম হোসেন।

উদ্ভিদবিজ্ঞানের একাডেমিক পাঠের বাইরে যে আরেকটি বিশাল জগৎ আছে, তা আমরা কেবল দ্বিজেন শর্মার লেখা থেকেই জানতে পেরেছি। তাঁর এই ভাবনা সত্যিকার অর্থেই বিচিত্র ও বহুমুখী। তিনি ছিলেন অনুসন্ধানী লেখক। অন্তর্দৃষ্টি, দূরদর্শিতা ও ভাবনার গভীরতার দিক থেকে তিনি দার্শনিক পর্যায়ের। এ কারণেই তাঁর লেখায় আমরা খুঁজে পাই উপমহাদেশের ঐতিহাসিক উদ্যানচর্চার সূত্র। একই সঙ্গে ব্রিটিশ-ভারতের অরণ্যতরু সন্ধানীদের অজানা অধ্যায়ও। রমনা নিসর্গের স্থপতি বিস্মৃতপ্রায় রবার্ট লুইস প্রাউডলক তাঁর লেখাতেই আবার নতুন করে ফিরে আসেন। ১৯০৮ সালের দিকে রমনাসহ ঢাকা শহরের নিসর্গ পরিকল্পনার কাজ শুরু করেছিলেন লন্ডনের কিউ বোটানিক গার্ডেনের অন্যতম এই কর্মী রবার্ট লুইস প্রাউডলক। তাঁর তত্ত্বাবধানেই গড়ে ওঠে রমনাকেন্দ্রিক নিসর্গশোভা, রমনাগ্রিন। তিনি বিশ্বের অন্যান্য উষ্ণমণ্ডলীয় অঞ্চলের সুদর্শন বৃক্ষগুলো ঢাকায় এনে রোপণের ব্যবস্থা করেন। বর্তমান রমনা পার্ক অবশ্য অনেক পরের সৃষ্টি।

আমাদের উদ্ভিদবিজ্ঞানের ভিত্তি কীভাবে তৈরি হয়েছিল, তার মূল ইতিহাস সাধারণ মানুষের কাছে ছিল অজানা। এমনকি যাঁরা উদ্ভিদচর্চা করেন, তাঁদের অনেকেরই এ বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা ছিল না। দ্বিজেন শর্মা তাঁর ‘নিসর্গ নির্মাণ ও নান্দনিক ভাবনা’ গ্রন্থে একঝাঁক ব্রিটিশ উদ্ভিদবিজ্ঞানীর সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরেছেন। যাঁরা ব্রিটিশ ভারতের অরণ্যতরু সন্ধানী হিসেবে সুপরিচিত। যোসেফ ডাল্টন হুকার, ডেভিড প্রেইন, জর্জ কিং প্রমুখের হাত ধরেই মূলত আমাদের উদ্ভিদবিদ্যার গোড়াপত্তন। কিন্তু প্রায় ২০ বছর আগে যখন বইটির পাণ্ডুলিপি তৈরি হয়, তখন আমাদের চারপাশে এমন অবাধ তথ্যপ্রবাহ ছিল না। সেই অর্থে অসাধ্যসাধন করেছিলেন তিনি। 

ব্রিটিশ ভারতের উদ্ভিদবিজ্ঞানীদের মধ্যে যোসেফ ডাল্টন হুকার অগ্রগণ্য। তিনি বৃক্ষানুরাগীদের জন্য শুধু সাত খণ্ডের ‘দ্য ফ্লোরা অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়া’ই রচনা করেননি, লিখেছেন ‘দ্য হিমালয়ান জার্নাল’–এর মতো অসাধারণ একটি গ্রন্থও। কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ণ বইটি দীর্ঘদিন আমাদের অগোচরেই ছিল। দ্বিজেন শর্মা বিচ্ছিন্ন কিছু সূত্র থেকে বইটি সম্পর্কে জানতে পারেন। ১৮৯১ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত এই সুবিশাল ও দুর্লভ ভ্রমণবৃত্তান্ত মাধুর্যমণ্ডিত ভাষায় তিনি আমাদের সামনে নতুন করে আনেন। ২০০৪ সালে বইটি প্রকাশিত হয়। উদ্ভিদপ্রেমীদের জন্য এটি একটি বিস্ময়কর গ্রন্থ। ভাষা এবং বর্ণনাশৈলির চমৎকারিত্বে, দীর্ঘ পটভূমিতে রচিত একটি উদ্ভিদতত্ত্বীয় গ্রন্থকে তিনি সুখপাঠ্য করে তুলেছেন। বইটি আমাকে নানাভাবে ঋদ্ধ করেছে।

বাগান করার শখ ছিল দ্বিজেন শর্মার। কিন্তু এর মধ্যে একধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষাও ছিল। আবার অতৃপ্তিও ছিল। শৈশবে দেখা পাথারিয়া পাহাড়ের নান্দনিক বিন্যাস অণুক্ষণ তাঁর সঙ্গী ছিল। পৃথিবীর কোথাও তিনি নিজের গ্রামের মতো এমন প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরা বর্ণিল প্রকৃতির সন্ধান পাননি। উদ্যান রচনায় এমন হাহাকার খোদ মোগল সম্রাটদের ছিল। ‘নিসর্গ নির্মাণ ও নান্দনিক ভাবনা’ গ্রন্থে দ্বিজেন শর্মা লিখেছেন, ‘এ জন্যই হিন্দুস্থানের অঢেল সোনারূপায় সম্রাট বাবর তৃপ্ত হননি, অনুক্ষণ মনে পড়ত কাবুলে তাঁর বাগান কখন বসন্তে লাল-হলুদ অর্গানে ঢেকে গেছে, ডালিম দুলছে ডালে ডালে। তিনি এর তুলনা খুঁজে পাননি পৃথিবীর আর কোন দেশে।’ কিন্তু এ ক্ষেত্রে নিজের অতৃপ্তিও কম নয়। সহধর্মিণী দেবী শর্মার লেখায় তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, ‘...সুতরাং আমাদের বাড়ি এলো হাজার রকমের গাছপালা; কিন্তু সমস্যা দেখা দিল অন্যত্র। গাছগুলো থিতু হওয়ার সুযোগ পেত না। আজ এখানে তো কাল ওখানে। তুঘলকি কাণ্ড। ...আসলে দ্বিজেন শর্মা বড় হয়েছেন পাহাড়ি এলাকায়, ওখানকার নিসর্গ তাঁর অস্থিমজ্জায়, তেমন একটি শোভা সৃষ্টি করতে চাইতেন আমাদের সমতল বাংলায়, সেটা হয়ে উঠতো না, যে জন্য এই উচাটন।’ 

দ্বিজেন শর্মা প্রথম বাগান করেছেন বাড়িতে। তাঁর অগ্রজের সবজি আর ফুলের বাগান করার শখ ছিল। তবে সত্যিকারে প্রথম বাগান ১৯৫৮ সালে বরিশাল বিএম কলেজে। বর্তমানে অল্প কয়েকটি বড় গাছ ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট নেই। তাঁর বাগান তৈরির হাতেখড়ি নটর ডেম কলেজে ফাদার ভেনাসের কাছে। এখনো বাগানটি বেশ ভালোই আছে। সেন্ট্রাল উইমেন্স কলেজেও বাগান করেছেন। কিন্তু তা এখন লুপ্তপ্রায়। এসব ছাড়াও মহানগর পাঠাগার, রমনা পার্ক, শিশু একাডেমি, চারুকলা অনুষদ ও বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বিপন্ন ও দুর্লভ প্রজাতির অনেক গাছ লাগিয়েছেন। জীবনের সর্বশেষ গাছগুলো লাগিয়েছেন বাংলা একাডেমিতে। তিনি চাইতেন, তাঁর ভাবনাগুলো আমাদের মধ্য দিয়ে সঞ্চারিত হোক। তাঁর ছায়ামায়া আমাদের সবুজ পৃথিবী নির্মাণের পথকে আরও সুগম করবে। 

তৃতীয় প্রয়াণবার্ষিকীতে দ্বিজেন শর্মাকে অনেক শ্রদ্ধা। 

 লেখক: সাধারণ সম্পাদক, তরুপল্লব।

জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন - dainik shiksha জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন পছন্দের স্কুলে বদলির জন্য ‘ভুয়া’ বিবাহবিচ্ছেদ - dainik shiksha পছন্দের স্কুলে বদলির জন্য ‘ভুয়া’ বিবাহবিচ্ছেদ হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা - dainik shiksha হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে - dainik shiksha সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন - dainik shiksha জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো - dainik shiksha ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা - dainik shiksha তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0039360523223877