নতুন শিক্ষকরা জিম্মি : ঘুষ না দিয়ে উপায় নেই - দৈনিকশিক্ষা

নতুন শিক্ষকরা জিম্মি : ঘুষ না দিয়ে উপায় নেই

রুম্মান তূর্য |

ঘুষ-দুর্নীতি যেন ঠেকানোই যাচ্ছে না। শিক্ষকতার মহান পেশার শুরুতেই প্রতিষ্ঠান প্রধানের কাছ থেকে শুনতে হচ্ছে ঘুষের খবর গুণতে হচ্ছে  টাকা। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মানসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ ও ঘুষ বন্ধ করতে আওয়ামী লীগ সরকারের সর্বশেষ উদ্যোগ হচ্ছে, প্রার্থী বাছাইয়ের দায়িত্ব পরিচালনা কমিটির হাত থেকে নিয়ে এনটিআরসিএকে দেয়া। ঘুষ ঠেকাতে আরো নতুন কিছু যুক্ত করতে পরামর্শ দিচ্ছেন শিক্ষাবিদ ও শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা।

দৈনিক আমাদের বার্তার অনুসন্ধানে জানা যায়, তিন দফায় পরীক্ষা নিয়ে প্রার্থী বাছাইয়ের কাজটি ঠিক মতোই করছে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) কিন্তু যোগদান ও নিয়োগের পর এমপিওভুক্ত হতে ঠিকই টাকা গুণতে হচ্ছে। তবে, টাকার পরিমাণ আগের তুলনায় অনেক কম। কমিটির হাতে নিয়োগ থাকাকালে পদভেদে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত লাগতো। সেখানে এখন মাত্র ১০ থেকে ৩০/৪০ হাজার টাকা। এমনটাই দৈনিক আমাদের বার্তাকে জানাচ্ছেন গত সপ্তাহে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকদের অনেকেই। তারা বলছেন, এনটিআরসিএর সুপারিশ পেয়ে প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক পদে যোগদান করতে গিয়ে নানা ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানে যোগদান ও এমপিওভুক্তির জন্য তাদের কাছে টাকা দাবি করা হচ্ছে। প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ যোগদানের জন্য যেমন টাকা চাচ্ছেন, এমপিওভুক্তির জন্যও নতুন শিক্ষকদের কাছে টাকা দাবি করা হচ্ছে। এমপিওভুক্তি নিয়ে তাই শঙ্কায় আছেন নতুন শিক্ষকরা। প্রার্থীরা বলছেন, বেশিরভাগ উপজেলায় নতুন শিক্ষকদের কাছ থেকে এমপিওর আবেদনের নাম করে টাকা চাওয়া হচ্ছে। জেলা শিক্ষা অফিস ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের খরচ বাবদ প্রতিষ্ঠান প্রধানরা এ টাকা চাচ্ছেন।

এদিকে নতুন শিক্ষকরা এসব বিষয় দৈনিক আমাদের বার্তাকে জানালেও তাদের বেশিরভাগই ভয়ে আছেন। সুপারিশপ্রাপ্তরা কিছু টাকা দিয়ে আপসে এমপিওভুক্ত হতে চাচ্ছেন। তারা সুস্পষ্টভাবে অভিযুক্তদের নাম বলতে ভয় পাচ্ছেন। যদিও নতুন শিক্ষকদের এমপিওভুক্তিতে হয়রানি করলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সভাপতি ও শিক্ষা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার বিধান আছে। কিন্তু সে নির্দেশনার বাস্তবায়ন না থাকায় অনেক প্রার্থী জটিলতায় পড়ছেন। 

এমপিওভুক্ত হতে নিজ প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে জেলা উপজেলা শিক্ষা অফিস, এমনকি আঞ্চলিক উপ-পরিচালকের কার্যালয়ের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হাতে শিক্ষকদের হয়রানির শিকার হওয়ার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এক শ্রেণির অসাধু প্রতিষ্ঠান প্রধান ও কমিটির সভাপতি  এবং কোনও কোনও কর্মকর্তা শিক্ষকদের কাছ থেকে ঘুষ নেন। অনেক সময় এমপিওর আবেদনও অযৌক্তিক বা তুচ্ছ কারণে বাতিল করে দেয়া হয়।  আবার প্রতিষ্ঠান প্রধান বা সভাপতিরা এমপিওভুক্তির আবেদনের অনুমোদন দেয়ার জন্য ঘুষ দাবি করেন। রেজুলেশনে সই করা ও সভা আহ্বান করতেও টাকা আদায় করার অভিযোগ রয়েছে। এদিকে কমিটি না থাকা মাদরাসায় নতুন শিক্ষকদের যোগদান প্রাশসনিক কর্মকর্তাদের স্বাক্ষরে করার নির্দেশনা জারি হওয়ার পর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় সংশ্লিষ্টরাও শিক্ষকদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের চেষ্টা করছেন। 

প্রার্থীরা বলছেন, প্রথমে যোগদানের জন্য টাকা দাবির পর এবার এমপিওভুক্ত হতেও টাকা চাচ্ছেন । বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রতিষ্ঠান প্রধান টাকা চাচ্ছেন। তারা উপজেলা ও জেলা শিক্ষা অফিস এবং উপপরিচালকের কার্যালয় থেকে এমপিও আবেদনের ফাইল প্রক্রিয়াকরণের জন্য টাকা চাচ্ছেন। আবার রেজুলেশন ও আবেদনের কাগজপত্র সংগ্রহের জন্যও টাকা নেয়া হচ্ছে। 

কেনো অভিযুক্তদের নাম বলতে ভয় পাচ্ছেন জানতে চাইলে ঝালকাঠী জেলার একটি মাদরাসায় নতুন সুপারিশ পাওয়া একজন প্রার্থী বলেন, ‘প্রতিষ্ঠান প্রধান টাকা দাবি করছেন। মাদরাসারটির পরিচালনা কমিটি নেই। ইউএনও অফিস থেকে যোগদান করাতেও নাকি টাকা লাগবে।  এখন বুঝতে পারছিনা কী করবো। এমপিওর জন্যও টাকা দিতে হবে। মোট ২৫ হাজার টাকা খরচ বাবদ চাওয়া হয়েছে। যারা টাকা চাচ্ছেন তাদের সঙ্গেই তো চাকরি করতে হবে। চাকরির শুরুতেই প্রতিষ্ঠান প্রধানের রোষানলে পড়তে চাই না। তাই কোথাও লিখিত অভিযোগ দিতে চাই না। আর উপজেলার নাম প্রকাশ পেলে এমপিওভুক্তিও আটকে যেতে পারে। তখন বড় কষ্টের চাকরিটা মাত্র ২৫ হাজার টাকায় মাটি হয়ে যাবে।’ 

তিনি আরও বলেন, নিজ জেলা থেকে বেশ দূরের জেলায় সুপারিশ পেয়েছি, তাই কষ্ট হলেও ঝামেলায় যেতে চাচ্ছি না। মায়ের কষ্টে জমানো টাকা থেকে প্রতিষ্ঠান প্রধানকে টাকা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।  

একটি স্কুলে সুপারিশ পেয়ে যোগদান করা হাবিবুল্লাহ রাজু দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, অর্ধেকের বেশি প্রার্থী এরকম জটিলতায় আছেন। তাদের কারো কাছ থেকে ১০ থেকে ৩০ হাজার টাকা দাবি করা হচ্ছে। তবে কেউ মুখ খুলতে চাচ্ছেন না। সব প্রতিষ্ঠান প্রধান এমনটি করছেন তা নয়। অনেকে জায়গায় উপজেলা শিক্ষা অফিস থেকে প্রতিষ্ঠান প্রধানদের কাছে টাকা চাওয়া হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষা অফিস টাকা না চাইলেও প্রতিষ্ঠান প্রধান টাকা তুলছেন। কোথাও তৃতীয় পক্ষের একটি চক্র সক্রিয়া আছে। 

টাকা না দিলে এমপিওর আবেদনে অসহযোগিতা :

প্রতিষ্ঠান প্রধান টাকা না দিলে এমপিওভুক্তির আবেদনে অসহযোগিতা করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ তুলেছেন নতুন শিক্ষকরা। তারা বলছেন, এমপিওর আবেদনের জন্য অনেকগুলো কাগজপত্র প্রয়োজন। এ জন্যও টাকা দাবি করা হচ্ছে। রেজুলেশন, প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র, শিক্ষার্থীর সংখ্যার প্রমাণকের জন্যও টাকা চাওয়া হচ্ছে।   

একজন প্রার্থী দৈনিক আমাদের বার্তাকে জানান, যোগদানের জন্য টাকা দেয়া না লাগলেও প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ কাগজপত্রের জন্য টাকা চাচ্ছেন। তারা বলছেন, খরচ দিতে হবে এসব কাগজপত্রের জন্য। খরচ না দিলে অহেতুক ঘোরানো হয়। 

হয়রানির করলে শাস্তির বিধান থাকলেও বাস্তবায়ন নেই :

এদিকে নতুন শিক্ষকদের এমপিওভুক্তিতে হয়রানি করলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়ে আদেশ জারি করেছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু মাঠপর্যায়ের তদারকি না থাকায় হয়রানি করা হলেও অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না। এদিকে প্রার্থীরাও সুস্পষ্ট অভিযোগ তুলতে ভয় পাচ্ছেন। ফলে, নতুন শিক্ষক সুপারিশ পেলে তার কাছ থেকে টাকা আদায় করার বিষয়টি একটি  নিয়মিত চর্চায় রূপান্তরিত হয়েছে। 

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ থেকে ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে জারি হওয়া এক আদেশে বলা হয়, এমপিওভুক্ত হতে শিক্ষকদের হয়রানি করলে সভাপতি বা মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়া শিক্ষকদের হয়রানি করলে সভাপতির পদ শূন্য ঘোষণা করা হবে। আর এমপিওর আবেদন অগ্রায়নে দেরি করলে মাঠ পর্যায়ের শিক্ষা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

তৃতীয় পক্ষও সক্রিয় :

নিবন্ধিত প্রার্থীদের নেতা ও নতুন সুপারিশপ্রাপ্ত শিক্ষক শান্ত আলী অভিযোগ করে দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, শুধু প্রতিষ্ঠান প্রধান ও শিক্ষা অফিস নয়, তৃতীয় পক্ষের দালালরাও নতুন শিক্ষকদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের চেষ্টা করছেন। অনেক শিক্ষক নেতা ও শিক্ষা অফিসের প্রভাবশালীরা এতে জড়িত। 

এদিকে শিক্ষা কর্মকর্তাদের দাবি এমপিওভুক্ত হতে নতুন শিক্ষকদের কাছ থেকে টাকা নেয়া হয়না বলে জানিয়েছেন শিক্ষা কর্মকর্তাদের সংগঠনের উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সমিতির নেতারা। তারা বলছেন, কেউ শিক্ষা অফিসের নাম ভাঙিয়ে টাকা তুলছে। 

উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সমিতির নেতা লিয়াকত আলী বলেন, এমপিওভুক্তির জন্য হয়রানি করা হলে ব্যবস্থা নেয়ার বিধান আছে। তা শিক্ষা কর্মকর্তারা জানেন। শিক্ষা কর্মকর্তাদের নাম ভাঙিয়ে অনেক সময় অনেক কিছু হয়ে যায়, কিন্তু শিক্ষা কর্মকর্তারা তা জানেন না। তাই সার্বিকভাবে বিষয়টি নিয়ে যাচাই বাছাই করে তবেই অভিযোগ তোলা উচিত হবে।

জটিলতার সমাধান হতে পারে যেভাবে :

এমপিওভুক্তির জন্য শিক্ষকদের হয়রানি বন্ধের দীর্ঘস্থায়ী উপায় খুঁজে বের করার তাগিদ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এ জটিলতা কিভাবে নিরসন হতে পারে তা জানতে চাইলে শিক্ষা বিষয়ক ডিজিটাল পত্রিকা দৈনিক শিক্ষাডটকমের উপদেষ্টা সম্পাদক ও সাবেক শিক্ষাসচিব  মো. নজরুল ইসলাম খান বলেন, এনটিআরসিএ প্রার্থীদের সব তথ্য নিয়ে আবেদন গ্রহণ করে। আবার এমপিও প্রক্রিয়াকরণের সফটওয়্যার ইএমআইএস ও মেমিসে প্রতিষ্ঠানের তথ্য আছে। এনটিআরসিএর নিয়োগ সুপারিশের সফটওয়্যার ও এমপিও প্রক্রিয়াকরণের সফটওয়্যারগুলো মধ্যে সমন্বয় করা হলে এ জটিলতা নিরসন সম্ভব। 

ইএমআইএস সেল নামে পরিচিত এমপিও প্রক্রিয়াকরণের শাখা সংশ্লিষ্টরাও এমন পরামর্শই দিয়েছেন। জানতে চাইলে সেলে নিয়োজিত এক কর্মকর্তা বলেন, এনটিআরসিএ তারা নিয়োগ দিয়ে একটি তথ্য আমাদের কাছে পাঠাতে পারে। সে তথ্য ও আমাদের কাছে থাকা প্রতিষ্ঠানের তথ্য যাচাই করে তারা সুপারিশকৃত প্রার্থীদের তথ্য ইএমআইসকে দিতে পারেন। তা হলে শিক্ষকদের বারবার এমপিওর আবেদন করতে হতো না। সফটওয়্যারগুলোর সমন্বয় করতে পারলে ভোগান্তি অনেকটাই কমানো যেতো। 

মাধবীলতা নয়, স্কুলের নাম কচুগাড়ি পুনর্বহালের দাবি - dainik shiksha মাধবীলতা নয়, স্কুলের নাম কচুগাড়ি পুনর্বহালের দাবি খুদে শিক্ষার্থীর হাতে অস্ত্র কেনো! - dainik shiksha খুদে শিক্ষার্থীর হাতে অস্ত্র কেনো! এইচএসসির ফরম পূরণ শুরু আজ - dainik shiksha এইচএসসির ফরম পূরণ শুরু আজ মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা হতে পারে জানুয়ারিতে - dainik shiksha মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা হতে পারে জানুয়ারিতে মুজিবনগর দিবসে সব স্কুল-কলেজে আলোচনা - dainik shiksha মুজিবনগর দিবসে সব স্কুল-কলেজে আলোচনা মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষক নিবন্ধন সনদের ফটোকপি পোড়ানো কেমন প্রতিবাদ! - dainik shiksha মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষক নিবন্ধন সনদের ফটোকপি পোড়ানো কেমন প্রতিবাদ! কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0066409111022949