‘পরিমার্জিত’ শিক্ষাক্রমে প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত শতভাগ ধারাবাহিক মূল্যায়ন হবে। এই তিন শ্রেণীতে দৈনিক শিখন ঘণ্টা বাড়ছে। এই স্তরে দৈনিক শিখন সময় সাড়ে তিন ঘণ্টা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা বর্তমানে তিন ঘণ্টারও কম।
তবে চতুর্থ থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত মৌলিক বিষয়গুলোতে ৬০ শতাংশ ধারাবাহিক এবং ৪০ শতাংশ সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে। এই দুই শ্রেণীতে দৈনিক শিখন সময় বাড়ছে না, চার ঘণ্টাই থাকছে। সোমবার (১৬ মে) দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন রাকিব উদ্দিন।
প্রতিবেদনে আরও জানা যায় ‘পরিমার্জিত জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষাক্রম’র পাইলটিং (পরীক্ষামূলক বাস্তবায়ন) চলতি বছরের আগস্টে শুরু হচ্ছে। আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে পুরোপুরি বাস্তবায়নের কথা রয়েছে।
নতুন শিক্ষাক্রমে সবমিলিয়ে বছরে ৩৬৫ দিনের মধ্যে কর্মদিবস থাকবে ১৮৫ দিন। সাপ্তাহিক ছুটি দু’দিন থাকছে। বছরে মোট ছুটি থাকছে ১৮০ দিন।
এ হিসেবে পরিমার্জিত শিক্ষাক্রমে প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণীতে বছরে মোট ৬৪৭.৫ ঘণ্টায় শিখন কার্যক্রম হবে। চতুর্থ থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত-এই শ্রেণীতে বছরে মোট শিখন সময় থাকছে ৭৪০ ঘণ্টা।
শিশু শিক্ষার্থীদের শিখন সময় বৃদ্ধির বিষয়ে জানতে চাইলে ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মশিউজ্জামান বলেন, ‘বিদেশের...বিশেষ করে ইউরোপের দেশগুলোর তুলনায় প্রাথমিক শিক্ষায় আমাদের এখানে সময় অনেকটাই কম আছে। তাদের দেশে অভিভাবকরা সন্তানদের স্কুলে রেখে চাকরিতে চলে যায়, ফেরার পথে নিয়ে যায়। এ কারণে ইউরোপের স্কুলগুলোতে বাচ্চারা একটু বেশি সময় পায়। এতে মুখস্থ বিদ্যারও প্রয়োজন হয় না।’
এই বিবেচনায় বাংলাদেশে সময় ‘একটু বাড়লে’ শিক্ষকদের সঙ্গে শিশুদের সর্ম্পকও একটু বেশি হবে-মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘তবে শিশুদের ওপর কোন চাপ থাকবে না। কারণ পরীক্ষা থাকছে না, শিশুদের অ্যাক্টিভিটিসের ওপরই সবকিছু মূল্যায়ন করা হবে।’
বর্তমানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সকাল ৯টা ১৫ মিনিটে শ্রেণী কার্যক্রম শুরু হয়। এক শিফটের বিদ্যালয়ে বিকেল সাড়ে ৩টা এবং দুই শিফটের বিদ্যালয়ে বিকেল ৪টা ১৫ মিনিট পর্যন্ত শ্রেণী কার্যক্রম চলে। এর মধ্যে দুপুর ১২টা থেকে সাড়ে ১২টার মধ্যে শ্রেণী কার্যক্রম শেষ হয়ে যায়।
তবে দাপ্তরিক কার্যক্রমের পাশাপাশি সরকারি নানা দায়িত্বপালন করতে হয় প্রাথমিক শিক্ষকদের। এজন্য এক শিফটের বিদ্যালয় বিকেল সাড়ে ৩টা এবং দুই শিফটের বিদ্যালয় বিকেল ৪টা ১৫ মিনিট পর্যন্ত খোলা রাখতে হয়।
জানতে চাইলে ব্রাক্ষণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার ‘১৯নং লোপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের’ প্রধান শিক্ষক তাজুল ইসলাম বলেন, ‘প্রথম ক্লাস ৪৫ থেকে ৫০ মিনিট হয়। কারণ প্রথম ক্লাসে ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতি যাচাই করা হয়। এরপর দিনের বাকি ক্লাশগুলো ৪০ মিনিট করে নেয়া হয়।’
প্রাথমিকের কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীতে বর্তমানে মৌলিক বিষয় তিনটি- বাংলা, ইংরেজি ও গণিত। এছাড়া শারীরিক শিক্ষা বা সংগীত বা পরিবেশ পরিস্থিতি- এর যেকোন একটি বিষয়ের ক্লাস নেয়া হয়। এ হিসেবে বর্তমানে দৈনিক (১৬০ মিনিট বা ৩ ঘণ্টার কম) ক্লাস হয়।
আর তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণীতে বর্তমানে ৩টি মৌলিক বিষয়ের (বাংলা, ইংরেজি ও গণিত) পাশাপাশি আবশ্যিকভাবে বাংলাদেশ ও বিশ^ পরিচয় এবং ধর্ম বা নৈতিক শিক্ষা বিষয়ের ক্লাস নেয়া হয়। এছাড়া শিল্পকলা বা শ্রুতি শিখন বা সংগীত, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য শিক্ষা বিষয়ে যেকোন একটি ক্লাস নেয়া হয়।
ধারাবাহিক ও সামষ্টিক মূল্যায়ন :
পরিমার্জিত শিক্ষাক্রমে প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত ১০০ ভাগ ধারাবাহিক মূল্যায়নের কথা বলা হয়েছে। তবে চতুর্থ থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত বাংলা, ইংরেজি, গণিত, সামাজিক বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানে ধারাবাহিক মূল্যায়ন ৬০ শতাংশ এবং সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে ৪০ শতাংশ। আর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য শিক্ষা, ধর্ম শিক্ষা এবং শিল্পকলা বিষয়ে ধারাবাহিক মূল্যায়ন হবে ১০০ ভাগ।
করোনা সংক্রমণের কারণে ২০২০ সাল থেকে পঞ্চম শ্রেণীর প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী, অষ্টম শ্রেণীর জেএসসি ও সমমান মাদ্রাসার জেডিসি পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে না। করোনা মহামারী ও নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নকে সামনে রেখে প্রাথমিক থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত বার্ষিক পরীক্ষাও নেয়া সম্ভব হয়নি। এই পরিস্থিতিতে ২০২৩ শিক্ষাবর্ষ থেকে পরিমার্জিত শিক্ষাক্রমের বাস্তবায়ন শুরু করার কথা রয়েছে।
৬৫টি বিদ্যালয়ে পাইলটিং :
আগামী আগস্টে সারাদেশের ৬৫টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ‘পরিমার্জিত জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষাক্রম’ এর পাইলটিং বা ট্রাই আউটের কার্যক্রম শুরু হচ্ছে। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের (ডিপিই) মহাপরিচালককে সম্প্রতি এনসিটিবির পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়েছে।
গত ২০ এপ্রিল ডিপিই মহাপরিচালকে দেয়া এক চিঠিতে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান (রুটিন দায়িত্ব) অধ্যাপক মশিউজ্জামান বলেন, ‘অনুমোদিত জাতীয় শিক্ষাক্রম (প্রাথমিক)-২০২১ অনুযায়ী, পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষক সহায়িকার প্রণয়ন কাজ চলমান রয়েছে।’
ওই চিঠিতে প্রাথমিক পর্যায়ের শিখন-শেখানো সামগ্রী প্রণয়ন ও বিতরণ সর্ম্পকিত পূণবিন্যাসকৃত কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী ৬৫টি বিদ্যালয়ের তালিকা ‘সদয় অনুমোদন’ ও প্রয়োজনীয় কার্যক্রমের জন্য ডিপিইতে প্রেরণ করা হয়।
ট্রাই আউটের জন্য মনোনীত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ৪০টি, কিন্ডার গার্টেন (কেজি) ১৫টি, ইবতেদায়ী মাদ্রাসা ৮টি এবং উচ্চবিদ্যালয় সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে দুটি। এগুলোর মধ্যে শহর এলাকার ৩২টি এবং গ্রামাঞ্চল থেকে ৩৩টি প্রতিষ্ঠান বাছাই করা হয়েছে।
প্রাথমিকের নতুন শিক্ষাক্রমের বিষয়ে জানতে চাইলে এনসিটিবির সদস্য (প্রাথমিক শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক ড. একেএম রিয়াজুল হাসান বলেছেন, ‘ট্রাই আউটের জন্য ইতোমধ্যে ৬৫টি বিদ্যালয়ের নাম চূড়ান্ত করা হয়েছে। আগামী আগস্টে পরিমার্জিত শিক্ষাক্রমের ট্রাই আউট শুরু হবে।
এনসিটিবির তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশে সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে মোট এক লাখ ৯ হাজার ৭৩৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও সমস্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছ। এর মধ্যে ৬৫ হাজার ৬২০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ২৮ হাজার ৯৫০টি কিন্ডার গার্টেন, ১৩ হাজার ২৬৫টি ইবতেদায়ী মাদ্রাসা এবং এক হাজার ৮৯৯টি উচ্চবিদ্যালয় সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে।