নতুন শিক্ষাক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত শিক্ষকদের জীবনমান - দৈনিকশিক্ষা

নতুন শিক্ষাক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত শিক্ষকদের জীবনমান

অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী |

আর মাত্র কিছুদিন পর ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে দেশে নতুন জাতীয় শিক্ষাক্রম চালু হতে যাচ্ছে। এতে শিক্ষা ক্ষেত্রে বেশ কিছু মৌলিক পরিবর্তন আসছে। শিক্ষা ব্যবস্থাকে নতুনভাবে আধুনিক ও যুগোপযোগী করে তোলার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। শুক্র ও শনিবার-সাপ্তাহিক দু'দিন ছুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রথম সংযোজন। অবশ্য গত কিছুদিন থেকে দেশে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্য শুক্র-শনি দু'দিন করে স্কুল-কলেজে সাপ্তাহিক ছুটি চলছে। উন্নত দেশসমূহে আগে থেকে শিক্ষায় এই ছুটি দু'দিন। আমাদের দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া সর্বত্র দু'দিনের ছুটি চালু রয়েছে। শিক্ষা প্রশাসনে আগে দু'দিনের সাপ্তাহিক ছুটি। কেবল শিক্ষক-কর্মচারীদের এই ছুটি একদিন ছিলো। আপাতত একটি বৈষম্যের অবসান হতে চলেছে। 

এমনিতে বৈষম্যের পাহাড়ের নীচে এদেশে শিক্ষকদের বসবাস। দু'দিন সাপ্তাহিক ছুটি শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরাসরি সংশ্লিষ্ট সকলকে সপ্তাহান্তে একঘেঁয়েমি মুক্ত করে নতুন উদ্যমে কাজ করতে শক্তি যোগাবে। সপ্তাহে একদিন ছুটি দেখতে দেখতে কেটে যায়। ক্লান্তি কিছুটা যেতে না যেতে নতুন সপ্তাহ শুরু হয়ে যায়। পরিবার-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব ও স্বজনদের এতটুকু সময় দেয়া সম্ভব হয়না। টুকটাক পারিবারিক কাজ কাম করা যায় না। এসব ঘাটতি এখন কিছুটা পূরণ হবে। নতুন শিক্ষাক্রমে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা থাকছে না।

পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির পাবলিক পরীক্ষা উঠিয়ে দেয়া হয়েছে। চতুর্থ শ্রেণি থেকে লিখিত পরীক্ষার সঙ্গে শেখন কার্যক্রমের ওপর মূল্যায়নের ব্যবস্থা থাকছে। চতুর্থ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ৪০ শতাংশ এবং একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে ৩০ শতাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শেখন কার্যক্রমের ওপর মুল্যায়ন করা হবে। মাধ্যমিক স্তরে মানবিক, বিজ্ঞান কিংবা বাণিজ্য বিভাগ থাকছেনা। এসএসসির পর থেকে এই সব বিভাগ শুরু হবে। কেবল দশম শ্রেণির সিলেবাসের আলোকে এসএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে দুটি আলাদা পাবলিক পরীক্ষা। এই দুই পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে এইচএসসির চুড়ান্ত ফল দেয়া হবে। 

এখন থেকে প্রাক্ প্রাথমিক শ্রেণিতে অধ্যয়নকাল দুই বছরের হবে এবং এই শ্রেণিতে কোনো পাঠ্যপুস্তক থাকবে না। শিক্ষক নিজের মতো করে শিক্ষার্থীদের পড়াবেন। প্রাথমিকে ৮টি ও মাধ্যমিকে ১০টি বিষয় থাকবে। নতুন শিক্ষাক্রমের বিশেষত্ব এই যে, এতে বই ও পরীক্ষা অনেকটা কমিয়ে দেয়া হয়েছে। ফলে নতুন প্রজন্ম বইয়ের বোঝা ও পরীক্ষার টেনশন থেকে কিছুটা ফ্রি থাকতে পারবে। নতুন এই শিক্ষাক্রম উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত কার্যকর হবে। এ শিক্ষাক্রমে উন্নত দেশের কারিকুলাম কিছুটা অনুসরণ করা হয়েছে। সেটি বাস্তবায়নে তাদের কলাকৌশল কতটুকু অনুসরণ করা হয়, সেটিই এখন দেখার বিষয়। উন্নত দেশগুলোর মতো শ্রেণিকক্ষের আয়তন, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত, শিক্ষার পরিবেশ এবং শিক্ষকদের সামাজিক ও আর্থিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত না করে কেবল তাদের অনুসরণে কারিকুলাম প্রণয়ন করে কোনো লাভ হবে না। অতীতেও হয়নি। 

আমাদের দেশে বিভিন্ন সময় শিক্ষাক্রম পরিবর্তন হয়েছে। আমার শিক্ষকতা জীবনে বহুবার এই পরিবর্তন দেখেছি। ছাত্রজীবনেও দেখেছি। শিক্ষায় এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। সিলেবাস ও কারিকুলামের বাঞ্চিত পরিবর্তন আমাদের সকলের কাম্য। এটিই শিক্ষার রূপান্তর। পৃথিবীর সব দেশে শিক্ষাব্যবস্থা, কারিকুলাম ও সিলেবাস বদল হয়ে থাকে। এর মাধ্যমে শিক্ষাকে যুগোপযোগী ও আধুনিক করার প্রয়াস চালানো হয়। কিন্তু আমাদের দেশে শিক্ষাব্যবস্থা, সিলেবাস, কারিকুলাম ইত্যাদি পরিবর্তনের আসল উদ্দেশ্য কতটুকু হাসিল হয়, সেটি এক বড় প্রশ্ন। আমার শিক্ষকতা জীবনে সিলেবাস, কারিকুলাম ও পাঠ্যপুস্তক কয়েকবার পরিবর্তন হতে দেখেছি। কিন্তু লাভ কতটুকু হয়েছে, তা' আজ পর্যন্ত বুঝে উঠতে পারিনি। যতবার সিলেবাস, কারিকুলাম ও পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তন হয়েছে ততবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর, এনসিটিবি ও শিক্ষাবোর্ডের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা লাভবান হয়েছেন। তারা এই সুযোগে রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে উঠেন। নতুন বই, সিলেবাস, প্রশ্নপত্র ছাপানো এবং শিক্ষকদের ট্রেনিং দেয়ার নামে টাকা আত্মসাতের অবারিত সুযোগ তারা পেয়ে থাকে। পক্ষান্তরে এসবের মূল চালিকাশক্তি শিক্ষক সমাজ বরাবর একইভাবে অবহেলিত থেকে যান। বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীরা চরম এক উপেক্ষিত জীবন- যাপন করে থাকেন। পৃথিবীর আর কোথাও শিক্ষকদের এত অবহেলিত জীবন-যাপন করতে হয় না। 

আমাদের মতো অনগ্রসর দেশ ছাড়া অন্য সব দেশে শিক্ষকরা রাজকীয় জীবনযাপন করেন। সর্বসাধারণের চেয়ে তাঁদের আলাদা মর্যাদা। আমলা-কামলা সকলে তাঁদের নিচে থাকে। সবার ওপরে শিক্ষকের অবস্থান। রাষ্ট্র ও সরকার তাঁদের সেই সুযোগ-সুবিধা ও মর্যাদার বিষয় আগে থেকে প্রস্তুত করে রাখে। আর আমাদের দেশে? শিক্ষক অনেকের কাছে ছা পোষা কেরানি মাত্র। তাঁদের ওপর সকলে মাতব্বরি জাহির করতে চায়। অথচ জাতি বিনির্মাণ ও সমাজ গঠনের মতো কঠিন এক মহৎ কাজ একমাত্র শিক্ষকেরাই করে থাকেন। নতুন শিক্ষাক্রমে আমরা আশার আলো দেখতে পাই বটে। কিন্তু, এর পাশাপাশি শিক্ষকদের জীবনমান বৃদ্ধি করার কোনো পরিকল্পনা না থাকায় শিক্ষক হিসেবে আমি নিজে বিস্মিত হয়েছি। একই সঙ্গে এর যথাযথ বাস্তবায়নের বিষয়ে আমি সন্দিহান হয়ে পড়েছি। সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতির ন্যায় নতুন শিক্ষাক্রমের সুফল আমরা কতটুকু ঘরে তুলতে পারবো, এ নিয়ে আমার মনে শুরুতেই অনেক প্রশ্ন জেগে উঠেছে।

সময়ের বিবর্তনে মানুষের জীবনযাত্রা যেমন পরিবর্তন হয়, তেমনি শিক্ষার রুপরেখা অপরিহার্যভাবে ভিন্ন রুপ লাভ করে। শিক্ষা কোনো স্থবির কিংবা স্তব্ধ জিনিস নয়। সময়ের পরিবর্তনে শিক্ষা ব্যবস্থার রূপান্তর বা পরিবর্তন এক অনিবার্য বিষয়। প্রয়োজনে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যে জাতি যত দ্রুত শিক্ষা ব্যবস্থার রুপান্তর ঘটাতে পারে, তারা তত বেশি আপটুডেট বলে বিবেচিত। প্রত্যেক দেশে শিক্ষা ব্যবস্থার এই রুপান্তর শিক্ষকদের হাত ধরেই শুরু হয়। শিক্ষকদের মাধ্যমে এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ সম্পন্ন হয়। অন্য যে কোন ভিন্ন পেশার লোকজন দিয়ে করানো সম্ভব। কিন্তু, শিক্ষার রূপান্তর কিংবা শিক্ষা বিস্তরণ অন্য কাউকে দিয়ে সম্ভব নয়। এ কাজে শিক্ষকের কোনো বিকল্প নেই। এই চিরন্তন সত্য কথাটি এবারের বিশ্ব শিক্ষক দিবস এবং আমাদের দেশে সদ্য পালিত শিক্ষক দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয়ে সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। 'The transformation of education begins with teachers'. (শিক্ষকদের হাত ধরে শিক্ষা ব্যবস্থার রুপান্তর শুরু)। এই প্রতিবাদ্য বিষয়টি দ্বারা কী বুঝানো হয়েছে, তা আমাদের সকলকে অনুধাবন করতে হবে। শিক্ষার রুপান্তর, বাস্তবায়ন এবং পুরোপুরি সুফল ঘরে তোলার  মাধ্যম হচ্ছেন শিক্ষক। উপযুক্ত শিক্ষক ছাড়া শিক্ষায় যে কোনো আয়োজন ব্যর্থ ও অসাড়। এই সত্যটি রাষ্ট্র তথা সরকারকে উপলব্ধি করতে হবে। কর্তা ব্যক্তিরা এই সত্যটি যত তাড়াতাড়ি বুঝে উঠতে পারবেন, ততই দেশ ও জাতির মঙ্গল নিশ্চিত হবে।

শিক্ষকদের এক হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া আর পাঁচশ' টাকা চিকিৎসা খরচ দিয়ে এই নতুন কারিকুলাম কতটুকু ফলপ্রসূ হবে, জানি না। শিক্ষক যাতে উৎফুল্ল মনে, প্রাণ খুলে আন্তরিকতা নিয়ে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করত পারেন, সে বিষয়টি আগে নিশ্চিত করা অপরিহার্য।শিক্ষকদের প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা ও মর্যাদা থেকে বঞ্চিত রেখে সিলেবাস, কারিকুলাম, পাঠ্যপুস্তক ও পরীক্ষা পদ্ধতি সংস্কারের নামে টাকা আত্মসাতের অনেক আয়োজন দেখেছি। নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্নকে বহুনির্বাচনী আর কাঠামোবদ্ধ প্রশ্নকে সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি নাম দিয়ে কত টাকা অপচয় করা হয়েছে, সে হিসেব কে জানে? দেশ ও জাতি নৈর্ব্যক্তিক বনাম বহুনির্বাচনী এবং কাঠামোবদ্ধ বনাম সৃজনশীল পদ্ধতি থেকে কতটুকু উপকৃত হয়েছে, সেটি আজ জানতে খুব ইচ্ছে করে। 

নতুন জাতীয় শিক্ষাক্রমের ওপর শিক্ষকদের অনলাইন প্রশিক্ষণ ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। অনলাইন প্রশিক্ষণে শিক্ষকদের ট্রেনিং ভাতার ব্যবস্থা থাকা দরকার ছিল। তাঁরা ঘরে বসে যে সময়টাতে অনলাইন প্রশিক্ষণ করেন, সেটি একান্ত তাঁদের নিজেদের সময়। সেই সময়ের কী কোনো মুল্য নেই? সামনের মাসে প্রত্যক্ষ প্রশিক্ষণ শুরু হবে। আগে মাস্টার-ট্রেনারদের প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। নতুন শিক্ষাক্রমের ওপর মাস্টার ট্রেইনার প্রশিক্ষণ সম্ভবত চলতি মাসে শুরু হয়েছে। তাদের পাঁচদিনের ট্রেনিং আমার কাছে পর্যাপ্ত মনে হয়নি। অন্তত পনের দিনের একটি প্রশিক্ষণ দেয়া উচিত। 

শিক্ষক প্রশিক্ষণের নামে সরকারের প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা খরচ হয়। কিন্তু, শিক্ষায় স্বল্পমেয়াদি এসব প্রশিক্ষণের ইতিবাচক কোনো প্রভাব নেই। এ নিয়ে আমার কিছু অভিজ্ঞতা  শেয়ার করতে চাই। শিক্ষকতা জীবনে বহু প্রশিক্ষণ নেয়ার সুযোগ আমার হয়েছে। এছাড়া মাস্টার ট্রেইনার হিসেবে বেশ কয়েক বছর দেশের বিভিন্ন জেলায় কাজও করেছি। আমি দেখেছি, এ জাতীয় প্রশিক্ষণের মেয়াদ খুব কম দিন থাকে। বেশিরভাগ তিনদিন মাত্র। তিনদিনে একটা প্রশিক্ষণের আগামাথা কতটুকু বুঝে উঠতে পারা যায়, তা' আমার বোধগম্য হয় না। প্রথম দিন বেশিরভাগ প্রশিক্ষণার্থী বাড়ি থেকে জেলা সদরের ভেন্যুতে আসেন। অনেকে দূর-দূরান্ত থেকে আসতে অর্ধেক দিন চলে যায়। শেষের দিন বাড়ি ফেরার তাড়া থাকে। গড়ে শেষদিনও প্রথম দিনের মতো অর্ধেকদিন ট্রেনিং চলে। আসা আর যাওয়ায় তিনদিন শেষ। ট্রেনিংয়ে কি রকম ব্যাগ বা ফাইল দেবে? ভাতা কত টাকা পাওয়া যাবে? ইত্যাদি বলাবলিতে অনেকের বেশিরভাগ সময় কেটে যায়। ট্রেনিং কার্যক্রম দেখভাল করতে শিক্ষা প্রশাসনের যেসব কর্মকর্তা আসেন বা থাকেন, তাদের বড় অঙ্কের সম্মানী ভাতা দিতে হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণার্থীদের নিম্নমানের ব্যাগ, ফাইল, খাতা-কলম সরবরাহ করা হয়। 

ট্রেনিংয়ের শুরুতে যে ম্যানুয়্যাল দেয়ার কথা সেটি ট্রেনিংয়ের শেষে এসে দেয়া হয়। কখনো-কখনো সেটি আর পাওয়াই যায় না। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ভাতা তুলনামূলক কম থাকে। কর্মকর্তাদের পেছনে প্রশিক্ষণের জন্য বরাদ্দ টাকার সিংহভাগ খরচ হয়ে যায়। খুব সম্ভব নতুন শিক্ষাক্রমে সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি আর থাকছে না। এ প্রশ্ন পদ্ধতিতে প্রশিক্ষণের নামে বিগত বছরগুলোত কোটি কোটি ব্যয় করা হয়েছে। কিন্তু শতকরা কতজন শিক্ষক সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি বুঝে উঠতে পেরেছেন, সেটি এখন বড় প্রশ্ন। আমাদের শিক্ষার্থীরা সৃজনশীলতা কতটুকু শিখেছেন, তাও ভেবে দেখতে হবে। সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতির সুফল আমরা কতটুকু ঘরে তুলতে পেরেছি? প্রকল্প কর্মকর্তাদের পেছনে বরাদ্দকৃত টাকার সিংহভাগ ব্যয় হয়ে থাকে, সেই খবর আমরা অনেকে জানি না। এভাবে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এবং শিক্ষা প্রশাসনের লোকজন মিলে সরকারের ঋণের টাকা লুটেপুটে খেয়ে থাকে। এদের বিরুদ্ধে কারো কিছু বলার সাহস নেই। এভাবে শিক্ষার সবকিছু এরা খেয়ে ফেলছে।

বিদেশে শিক্ষক প্রশিক্ষণের নামে শিক্ষা প্রশাসনের কর্মকর্তারা বিদেশ ভ্রমণে যান। মামুর খুঁটির জোর কিংবা রাজনৈতিক পরিচয় থাকলে দু'-চারজন মাত্র শিক্ষক এদের সঙ্গে যেতে পারেন। যোগ্য শিক্ষকেরা কদাচিত বিদেশে গিয়ে ট্রেনিং নেয়ার সুযোগ পান। আরেকটি বিষয় লক্ষ্য করার মতো যে, আমাদের দেশে শিক্ষক প্রশিক্ষণ সচরাচর জুন ও ডিসেম্বর মাসে আয়োজন করা হয়। জুন হলো অর্থ বছরের শেষ মাস আর ডিসেম্বর শিক্ষাবর্ষের শেষ মাস। এই দুই মাসে তাড়াহুড়ো করে প্রকল্পের সব টাকা জায়েজ করার জন্য শিক্ষা প্রকল্পের কর্মকর্তারা ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। 

কখনো কখনো স্কুল-কলেজ খালি করে বেশিরভাগ শিক্ষককে ট্রেনিংয়ে ডেকে নিয়ে আসেন। এ সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নানা পরীক্ষা ও বিভিন্ন একাডেমিক কাজ থাকে। শিক্ষকরা পরীক্ষা ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ রেখে ট্রেনিংয়ে চলে যেতে বাধ্য হন। সারা বছর প্রশিক্ষণের নাম-গন্ধ থাকে না। জুন মাসের ভেতরে ট্রেনিং শেষ করে প্রকল্পের অবশিষ্ট সব টাকা মারার শেষ উৎসবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মেতে উঠেন।
একেকটা নতুন শিক্ষাক্রম যখন আসে, তখন শিক্ষকদের সবচেয়ে বেশি কষ্ট ও পরিশ্রম করতে হয়। নতুন কারিকুলামে দ্রুততম সময়ে নিজেকে পরিচিত করে তুলতে হয়। বেশ কিছুদিন বই পুস্তকের সঙ্গে  দিনরাত লেগে থাকতে হয়। একজন আদর্শ শিক্ষক নতুন কারিকুলাম, সিলেবাস ও পাঠ্যপুস্তকের বিষয়ে দ্রুততম সময়ে নিজেকে অভিজ্ঞ করে তুলতে সচেষ্ট হন। তা না হলে তিনি শ্রেণিকক্ষে অস্বস্তি বোধ করেন। শিক্ষার্থীরাও পাঠে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। শিক্ষাদান ও গ্রহণ কোনটিই সার্থক কিংবা সফল হয় না। শ্রেণি কার্যক্রম তখন আনন্দদায়ক হয়, যখন সিলেবাস ও কারিকুলামে শিক্ষক পারদর্শী হন। একটা সময় শিক্ষক যখন সিলেবাস ও কারিকুলামের বিষয়ে বিশেষ পারদর্শী হয়ে উঠেন, তখন আবার কারিকুলাম পরিবর্তনের তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়। এভাবে সময়ে সময়ে শিক্ষক নিজের হাড় জল করে কারিকুলাম, সিলেবাস, পাঠ্যপুস্তক ও পরীক্ষা পদ্ধতি আগে নিজে রপ্ত করেন, পরে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিলিয়ে দেন। তাদের দক্ষ ও যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে প্রাণান্ত প্রয়াস চালান। কিন্তু, শিক্ষকের জীবনমান উন্নত ও সমৃদ্ধ করার বিষয়ে কারো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না।

বেসরকারি শিক্ষকদের মাথার ওপরে কমিটির খড়গ হস্ত। কখন কার চাকরি চলে যায়, কে জানে? প্রাইমারি স্কুলের সভাপতি বিএ পাস হতে হয়। অথচ হাইস্কুল ও কলেজের সভাপতির কোনো শিক্ষা লাগে না। কী আশ্চর্য সেলুকাস ! শিক্ষকেরা যে বেতন পেয়ে থাকেন, তা দিয়ে বর্তমান দুর্মূল্যের দিনে দু'বেলা শাক ভাত খেয়ে বাঁচা কঠিন। ডাল-ভাত তো সম্ভবই নয়। এক কেজি ডালের দাম দুইশ’ টাকার মত। বেসরকারি একজন শিক্ষকের প্রারম্ভিক বেতন ১২ হাজার টাকা। কোনোমতে নিজে খেয়ে পরে বাঁচতে পারবেন। বউ-বাচ্চার কী হবে? এদের কে বাঁচাবে? শিক্ষক যদি নিজে আত্মমর্যাদা নিয়ে বাঁচতে না পারেন, তাহলে তিনি কীভাবে আত্মপ্রত্যয়ী নাগরিক তৈরি করবেন? শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকের মনে দায়-দেনার দুশ্চিন্তা থাকলে পুরো ক্লাসই মাটি হয়ে যেতে বাধ্য। মুদি দোকানির বকেয়া টাকার চিন্তা শিক্ষকের শ্রেণি পাঠদানকে নিরানন্দ করে তুলবেই। তাই সবকিছুর আগে শিক্ষকের জীবনমান উন্নত ও সমৃদ্ধ করা একান্ত অপরিহার্য। নতুন জাতীয় শিক্ষাক্রম চালু করার সঙ্গে সঙ্গে স্কুল-কলেজ সরকারিকরণ করে শিক্ষকদের জীবনযাত্রা সহজতর করার জন্য সদাশয় সরকারের প্রতি সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাই। আর তাহলে নতুন জাতীয় শিক্ষাক্রমের সুফল আমরা নিশ্চিতভাবে অর্জন করতে সক্ষম হবো। অন্যথায় সব আয়োজন আগের মত আবারো একদিন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে।

লেখক  : প্রাক্তন অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট এবং যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত দৈনিক শিক্ষাডটকম ও দৈনিক আমাদের বার্তার আবাসিক সম্পাদক।

মাধবীলতা নয়, স্কুলের নাম কচুগাড়ি পুনর্বহালের দাবি - dainik shiksha মাধবীলতা নয়, স্কুলের নাম কচুগাড়ি পুনর্বহালের দাবি খুদে শিক্ষার্থীর হাতে অস্ত্র কেনো! - dainik shiksha খুদে শিক্ষার্থীর হাতে অস্ত্র কেনো! এইচএসসির ফরম পূরণ শুরু আজ - dainik shiksha এইচএসসির ফরম পূরণ শুরু আজ মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা হতে পারে জানুয়ারিতে - dainik shiksha মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা হতে পারে জানুয়ারিতে মুজিবনগর দিবসে সব স্কুল-কলেজে আলোচনা - dainik shiksha মুজিবনগর দিবসে সব স্কুল-কলেজে আলোচনা মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষক নিবন্ধন সনদের ফটোকপি পোড়ানো কেমন প্রতিবাদ! - dainik shiksha মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষক নিবন্ধন সনদের ফটোকপি পোড়ানো কেমন প্রতিবাদ! কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0063278675079346