নব চেতনায় উদীপ্ত হোক নতুন বছর - দৈনিকশিক্ষা

নব চেতনায় উদীপ্ত হোক নতুন বছর

শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ |

বাঙালি ঐতিহ্যের প্রাণের উৎসব বাংলা নববর্ষ। ঋতুরাজ বসন্তের রেশ কাটতে না কাটতেই সবার অপেক্ষা নতুন বছরকে ঘিরে। বৈশাখের প্রথম দিনটিকে বরণ করে নিতে প্রকৃতি যেনো সেজেছে অপরূপ রূপে। সবারই প্রাণে বেজে ওঠে ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো...’। 

প্রকৃতির সেই উজ্বল রঙে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই উন্মুখ। সব পেশার প্রতিটি মানুষের মনে জেগে ওঠে বাংলার হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যের পরশ। সবাই নতুন বছরের শুরুর দিনটিকে অন্তত বাঙালির চেতনার তুলিতে অঙ্কন করে ধরে রাখতে চেষ্টা করেন। ১৪৩১ খ্রিষ্টাব্দের পহেলা বৈশাখের এই মহেন্দ্রক্ষণে সব পাঠকের প্রতি রইলো নববর্ষের আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। 

বাংলা নববর্ষ শুরুর ইতিহাস নিয়ে রয়েছে নানান বির্তক। ইতিহাস বিশ্লেষণে জানা যায়, বাংলা নববর্ষের প্রর্বতন হয় মূলত ষোড়শ শতকে, মোগল সম্রাট আকবরের শাসনকালে। সম্রাটের নির্দেশে তার বিজ্ঞ রাজ-জ্যোতিষী আমির ফতেহউল্লাহ সিরাজীর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলেই প্রধানত বাংলা খ্রিষ্টাব্দের উৎপত্তি। 
তিনি ‘হিজরী চান্দ’ বছরকে অত্যন্ত সুকৌশলে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে সৌর বছরে রূপান্তরিত করেন। ফলে, হিজরি ৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে বাংলা খ্রিষ্টাব্দের জন্ম হয়। বাংলা বছরকে এক সময় ফসলি অব্দ বলা হতো। বৈশাখের প্রথম প্রহর পালনের রেওয়াজ চালু হয় ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে। এই রেওয়াজ পালনের মূল প্রবক্তা সম্রাট আকবর। তার মূল উদ্দেশ ছিলো বাংলা মুল্লুকের জনসাধারণের

তথা কৃষিজীবীদের থেকে ‘কর’ পরিপূর্ণভাবে আদায় করা। ঘরে নতুন ফসল এলে কৃষিজীবীদের পক্ষে রাজকর পরিশোধ করা সুবিধাজনক। কৃষকেরা এদিন জমিদার-সামন্ত প্রভুদের কর দিতে এলে তারা খুশি হয়ে করদাতাদের কিছু দান করতেন। ক্ষেত্রবিশেষ কর লাঘবও করে দিতেন। 

দিনটি রাজা-প্রজা দুইয়ের কাছেই বেশ আনন্দ ও উৎসবের আমেজে পালিত হতো। সেই রেশ ধরে আজো পহেলা বৈশাখ বাঙালি সম্প্রদায়ের কাছে আলাদা ধরনের আবেদন রাখে। আবার এক সময় পহেলা বৈশাখকে ‘আমনি’ বলা হতো। আমনি শব্দের অর্থ অন্ন ও পানীয়। সহজ কথায় পান্তাভাত।

চৈত্র সংক্রান্তির রাতে রান্না করা ভাত রাতের আহার শেষে বাদ-বাকি অংশে পানি দিয়ে তার ভেতর শাখা সমেত ছোট আম দিয়ে রাখা হতো। পরদিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখের প্রথম প্রহরে সেই আমপাতা ভেজানো পানি ছিটিয়ে দেয়া হতো ঘরের উঠানে। 

প্রাচীন প্রথা অবম্বনে মানুষের বিশ্বাস ছিলো-এর ফলে অমঙ্গলের হাত থেকে রেহাই মিলবে। হয়তো সেই বিশ্বাসের ফলশ্রোতে পহেলা বৈশাখের প্রভাতে পান্তা ভাত দিয়ে প্রাত:রাশের রেওয়াজ চলছে অদ্যাবধি। 

এরপর বহু শ্রোত গড়ালো পদ্মা-যমুনায়। এক পর্যায়ে ব্যবসায়ীরাও এগিয়ে এলেন পহেলা বৈশাখের আয়োজনে অংশ নিতে। নিয়মিত ক্রেতাদের বিশেষত যারা বাকিতে কেনাকাটা করেন, তাদের নিমন্ত্রণ করে অয়োজন করা হতো উপাদেয় খানা-পিনার। 

বিদায়কালে আমন্ত্রিতরা তাদের সাধ্যমতো কর্জ চুকিয়ে দিতেন। যাদের ঋণ পরিশোধ হয়ে যেতো তাদের নাম উঠতো নতুন খাতায়। চালু হলো হালখাতা পর্ব। 
পহেলা বৈশাখের প্রথম প্রহরে সমগ্র বাঙালি জাতির প্রাণে জেগে ওঠে সাজসাজ রব। বলা হয়, বাংলার নারী লোকজ উৎসবের ধারক ও বাহক। পহেলা ফাল্গুনে বাংলার নারীরা হলুদ শাড়ি পরে বসন্তকে স্বাগত জানায়। অনেকটা একইভাবে পহেলা বৈশাখে বাংলার তরুণীরা লাল-সাদা শাড়ি, হাতভর্তি লাল চুড়ি, কপালে টিপ দিয়ে এক অপরূপ মহিমায় বরণ করে নেয় বাংলা বছরের প্রথম দিনটিকে। 

অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদীপ্ত হয়ে যেকোনো বয়সের ছেলে-মেয়ে এক হয়ে সৃষ্টি করে এক উৎসবমুখর আমেজের। জানা যায়, ১৩০৯ খ্রিষ্টাব্দের পহেলা বৈশাখের প্রথমবারের মতো শান্তিনিকেতনের ছাতিমতলায় বৈশাখকে স্বাগত জানানোর ভিন্ন ধর্মী আয়োজনের সূচনা করেছিলেন কাবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। 

কবিগুরুর সেই প্রেরণাকে পুঞ্জিভূত করে রমনার বটমূলে ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে ছায়ানট আয়োজন করেছিলো পহেলা বৈশাখের প্রথম প্রভাতী অনুষ্ঠান। 
ছায়ানটের সেই কার্যক্রম এখন অনেক বেশি প্রসারিত। এরসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নানান অনুষঙ্গ সংযুক্ত হয়ে রমনায় আয়োজন করা হয় নানাবিধ অনুষ্ঠানের। 

উৎসব মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত প্রাণের প্রকাশ। উৎসব কখনো একা একা হয় না, করা যায় না। সেটা একটা সম্মিলিত অংশগ্রহণের মাধ্যমেই ঘটে। আর তা মানুষের সম্মিলনের একটা উপলক্ষও বটে। যে মানুষরা উৎসব করে তারা একই ধরনের বিষয়ে আনন্দিত হয়, সাধারণ কিছু আচরণ, প্রথা তৈরি করে। 

বাংলাদেশে গ্রামেগঞ্জে এ উৎসব বহুকাল থেকেই পালিত হয়ে আসছে মেলা আর হালখাতা হিসেবে। পাহাড়ে এই উৎসবের নাম বৈসাবি। আর পুরো উৎসবের সঙ্গেই যেহেতু ভালো খাওয়া-দাওয়ার একটা সম্পর্ক থাকে, বৈশাখই বা তা থেকে বাদ যাবে কেনো? হালখাতার সময় দই, মিষ্টি খাওয়ানোটা ছিলো রেওয়াজ। বাড়িতে হতো পায়েস, মাংস, মাছের বিশেষ পদ। 

জানা যায়, রমনার অশ্বত্থতলায় ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে ছায়ানটের বৈশাখী বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সূচনা এবং পরবর্তীকালে-এর ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা উল্লেখ করার মতো। ওই সাংস্কৃতিক ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলো গণসংস্কৃতির প্রকাশ। ‘ক্রান্তি’ নামক গণসংস্কৃতি সংগঠনের জনপ্রিয় যাত্রাও বিশেষ ঘটনা। 

আর সত্তরের দশকে রমনার অশ্বত্থতলার আবেগ দ্রুতবেগে এগিয়ে চারুকলার বকুলতলায় গিয়ে ঠাঁই নেয়, যা রাজনৈতিক ভিন্ন বাঁকফেরা সত্বেও বৈশাখী আবেগের প্রকাশে পিছু হটতে দেয়নি, এখনো হটেনি। পহেলা বৈশাখে ঢাকার রাজপথে মানুষের ঢল ও নানা চরিত্রের সংগঠনের উপস্থিতি তেমনই প্রমাণ দেয়। ঐতিহ্যের সঙ্গে, পূর্বপুরুষের স্মৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক জোর করে নাই করে দেয়া যায় না, পাকিস্তানি শাসকরাও তা পারেনি।

বাংলাদেশ হওয়ার পর এই উৎসব উদযাপন ক্রমশ বিস্মৃত হয়েছে। চারুকলায় বর্ষবরণের শোভাযাত্রা একে নতুন রূপ দিয়েছে। কিন্তু একটা দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো, যে গ্রাম এই উৎসবের সূতিকাগার সেখানে এই উৎসব ক্রমশ ক্ষীণ হতে-হতে হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। গ্রামীণ অর্থনীতির রক্তশূন্যতা নিশ্চয়ই-এর একটি বড় কারণ।
অর্থাৎ যে জাতীয় বিকাশ আমাদের হচ্ছে সেখানে এই সংস্কৃতির উৎস গ্রামসমাজই বাদ পড়ে যাচ্ছে। এই অর্থনৈতিক বিকাশের সঙ্গে-সঙ্গে পহেলা
বৈশাখের সংগঠিত আয়োজন আমাদের মানুষের জীবন ও প্রকৃতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণভাবে বিকশিত হয়েছে কি-না, সে প্রশ্নও এসে পড়ে! জাতীয় সংস্কৃতি গড়তে হলে জাতীয় উৎসবের গুরুত্ব অপরীসীম। 

সেই উৎসবে গ্রাম থেকে শহর সর্বত্রই সমসত্বা না হোক সামঞ্জস্যতা প্রয়োজন। সে ক্ষেত্রে গ্রামের ওপর সেটা চাপিয়ে দিলে চলবে না, বরং শাসক নগরকেই তার দায় নিতে হবে। আর সর্বজনীন, অসাম্প্রদায়িক উৎসব হিসেবে পহেলা বৈশাখের চেয়ে ভালো বিকল্প আমাদের হাতে নেই। 

ঢাকার পহেলা বৈশাখ যদি গোটা দেশকে ধারণ করতে পারে কেবল তাহলেই তা জাতীয় সংস্কৃতি হয়ে উঠতে পারে। বিভেদ-বৈষম্য মানুষের মধ্যের সৃজনশীলতাকে বাধাগ্রস্থ করে।
লোভ-ক্ষোভ-অভিমান মানুষের চিন্তা- চেতনাকে পঙ্গু করে দেয়। ১৪৩১ খ্রিষ্টাব্দ নব চেতনায় উদীপ্ত হয়ে মানব প্রাণ করে তুলুক আলোকিত, করে তুলুক ভালোবাসাময়-সেটাই প্রত্যাশা। সর্বশেষে ১৪৩০ খ্রিষ্টাব্দে বিভিন্ন অঙ্গন থেকে হারিয়ে যাওয়া সবার প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি। তাদের সৃজনশীল প্রেরণা আমাদের সবার চলার পথের প্রদীপ শিখা হোক সেটাই কামনা!

লেখক: সাংবাদিক

স্কুল-মাদরাসা বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বন্ধ রাখার নির্দেশ হাইকোর্টের - dainik shiksha স্কুল-মাদরাসা বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বন্ধ রাখার নির্দেশ হাইকোর্টের ঢাকাসহ ১৩ জেলার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কাল বন্ধ - dainik shiksha ঢাকাসহ ১৩ জেলার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কাল বন্ধ প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপের মৌখিক পরীক্ষা শুরু ৯ মে - dainik shiksha প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপের মৌখিক পরীক্ষা শুরু ৯ মে বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি নীতিমালা প্রণয়নের নির্দেশ হাইকোর্টের - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি নীতিমালা প্রণয়নের নির্দেশ হাইকোর্টের প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের নতুন নির্দেশনা টেম্পু চাপায় কলেজছাত্রী নিহত - dainik shiksha টেম্পু চাপায় কলেজছাত্রী নিহত কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.003687858581543