নারীর সামাজিক মর্যাদা ও অধিকার - দৈনিকশিক্ষা

নারীর সামাজিক মর্যাদা ও অধিকার

প্রফেসর ড. মো. লোকমান হোসেন |

নারীরা কখনো মা কখনো কন্যা, জায়া, প্রেমিকা ও বন্ধুর ভূমিকা নিয়ে হৃদয় উজাড় করে অন্যদের মাঝে নিজেদের ভালোবাসা বিলিয়ে যাচ্ছেন। তাই নারীর প্রতি রইল আমার সালাম আর অনেক অনেক ভালোবাসা। বিশ্বব্যাপী নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা, তাঁদের কাজের প্রতি প্রশংসা এবং ভালোবাসা প্রকাশ করে প্রতি বছর ৮ মার্চ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নারী দিবস পালন করা হয়। এই দিবসটিকে তাঁদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক সাফল্য অর্জনের উৎসব হিসেবে পালন করা হয়। ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের নারী দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো ‘করোনাকালে নারী-নেতৃত্ব, গড়ব নতুন সমতার বিশ্ব’। মূলত নারীর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের সঙ্গে সঙ্গে কর্মক্ষেত্রে নারীর প্রতি কোনো বৈষম্য না দেখিয়ে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনের সর্বস্তরে নারীর সম-অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নারী দিবসটির সূচনা করা হয়েছিল।

প্রতিটি মানুষই একজন নারীর গর্ভ থেকে জন্ম গ্রহণ করেন। এই নারী কখনো স্ত্রীর ভূমিকা নিয়ে যত্নের সঙ্গে তাঁদের ভালোবাসার সংসার আগলে রাখেন, সন্তানকে নিজের মধ্যে ধারণ করেন, মায়ের ভূমিকা নিয়ে সন্তানকে জন্ম দেন এবং লালন-পালন করেন। আবার এই নারীই কন্যা বা বধুর ভূমিকা নিয়ে বৃদ্ধ বাবা-মা, শ্বশুর-শাশুড়ির সেবাযত্ন করেন। এই পৃথিবীতে যেখানে নারীরা এত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন সেখানে নারীর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য শুধু একটা দিন উৎসর্গ করাই যথেষ্ট নয়। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, এই একবিংশ শতাব্দীতেও বেশির ভাগ নারী তাঁদের পূর্ণ মর্যাদা পান না, সেটা ঘরে হোক কিম্বা বাইরে হোক।

পৃথিবীতে নারী ও পুরুষের সংখ্যা প্রায় সমান। বর্তমানে নারীর ভূমিকার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে সঙ্গে এখন উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও পুরুষের সঙ্গে সঙ্গে নারীরা সব সেক্টরে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছেন, বাংলাদেশের নারীরাও তা থেকে পিছিয়ে নেই। গতানুগতিক পেশা যেমন ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং, আইনজীবী, সাংবাদিকতা, শিক্ষকতা, ব্যাংক-বীমা, ব্যবসা ও সেনাবাহিনী ইত্যাদির সঙ্গে রিকশা চালানো থেকে শুরু করে বিমান চালনায় পুরুষের পাশাপাশি নারীরা সমানভাবে এগিয়ে যেতে শুরু করেছেন। তিন দশক আগেও বাংলাদেশের মেয়েরা কলেজ পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠ পর্যন্ত পৌঁছতে পারত না। মেয়েরা শিক্ষকতা বা ডাক্তারি-নার্সিংয়ের গতানুগতিক পেশার বাইরে কোনো চাকরি করার কথা ভাবতে পারত না। অথচ গত তিন দশকের মধ্যে তারা রাস্তাঘাটে স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরা করতে শুরু করেছে। তবে এটা সত্যি যে, শিক্ষায় এবং অর্থনৈতিকভাবে দেশ অনেক এগিয়েছে, অন্যদিকে নারী-নির্যাতনের হার বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। প্রতিদিন পত্রিকা খুললেই দেখা যায় নারীহত্যা, নারীধর্ষণ, নারীর উপর শারীরিক-মানসিক নির্যাতন এবং যৌন হয়রানির খবর।

গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীর অবস্থান সুদৃঢ় হয়েছে। নারী যেমন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন, তেমনি পালন করছেন বিরোধীদলীয় নেত্রীর দায়িত্ব। যেটা পাশ্চাত্যের অনেক দেশেই বিরল, অথচ এদেশে খুব কম নারীই আছেন যারা কাজ থেকে রাতে স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে ঘরে ফিরতে পারেন। নাম না জানা অনেককেই কাজ থেকে ফেরার পথে ধর্ষণ, যৌন হয়রানি বা ইভটিজিংয়ের শিকার হয়ে থাকেন। যৌতুক না দেওয়ার অপরাধে অনেককেই জীবন্ত অবস্থায় জ্বালিয়ে হত্যা করা হয়। অর্থনীতিতে নারীর অবদান বেড়ে চলেছে, তবে কমসংখ্যক নারীই তাদের নিজের উপার্জিত অর্থের ব্যয় করার স্বাধীনতা ভোগ করে থাকেন।

নারী-পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় গড়ে উঠেছে আজকের এই পৃথিবী। আধুনিক বিশ্বে নারী-পুরুষ সমান অধিকার নিয়েই একসঙ্গে সর্বস্তরে কাজ করছে। নারীর মর্যাদা ও অধিকার সংরক্ষণ বিষয়ে, কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, নারীকে ঘরে আটকে রাখা ঠিক নয়। মেয়েদের আরও বেশি বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে। এভাবেই তারা অচলায়তন ভাঙতে এগিয়ে আসতে পারবে। বাংলাদেশের নারীরা প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় কিছুটা এগিয়েছে বলে তিনি মনে করেন। দেশের মেয়েদের চলার পথে সামাজিক প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি বাধা হয়ে দাঁড়ালেও নারীরা দমে না গিয়ে স্বমহিমায় এগিয়ে গিয়েছেন বলেও তিনি মনে করেন। নারীরা নিজে থেকেই এগিয়ে আসতে হবে তাদের ক্ষমতায়নের জন্য। 

দেখা যায়, একজন নারী শিক্ষিত হলে তিনি তার সন্তানের শিক্ষার জন্য তার সকল সঞ্চয় ব্যয় করেন। নারীরাই সমাজ পরিবর্তনের চাবিকাঠি। বিশিষ্ট এই শিক্ষাবিদের মতে, নারীর কর্মসংস্থান ও সামাজিক অবস্থান সরকারকেই ঠিক করতে হবে। নারীর বিরুদ্ধে কাজ করা সব অপশক্তিকে প্রতিহত করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ বিষয়টি অগ্রাধিকার দিতে হবে। নারীর স্বাধীনতা হিসেবে নারীর শরীরের ওপর তার নিজের নিয়ন্ত্রণ থাকবে। নারীকে আরও এগিয়ে নিতে সরকারি কাঠামোর মধ্যে নারীর কর্মসংস্থান ও সমান অধিকারের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। 

ঢাকা ট্রিবিউনের সম্পাদক জাফর সোবহান বলেন, আমরা নারীদের যথেষ্ট সম্মান করতে চাই না এবং তাঁদের অবদানের স্বীকৃতি দিতে চাই না। শুধু বাংলাদেশই নয়, সারাবিশ্বেই নারীদের অধিকার বিষয়টির তেমন উন্নতি হয়নি। বাংলাদেশে সামাজিক,পারিবারিক ক্ষেত্রে নারীরা নানাভাবে অত্যাচারিত ও বঞ্চিত হচ্ছেন। এর মূল কারণ হিসেবে বিচারহীনতার সংস্কৃতি, আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়া, অপরাধ করেও পার পেয়ে যাওয়া বিষয়গুলো দায়ী। যারা নারী ও শিশু নির্যাতন করছে, তারা ধরা পড়লেও কিছুদিনের মধ্যেই ছাড়া পেয়ে যান অথবা কঠোর বিচারের মুখোমুখি হন না। এতে তাদের মধ্যে যা ইচ্ছা তাই করার মনোভাব তৈরি হয়েছে। এদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জিরো টলারেন্স দেখাতে হবে।

নাট্যব্যক্তিত্ব সৈয়দ হাসান ইমাম বলেন, এদেশে হাজার বছর ধরেই সবাই মিলেমিশে থাকার সংস্কৃতি রয়েছে। তাই আমাদের কোনো দিবসের প্রয়োজন থাকা উচিত না। নারীকে ঘরে ও বাইরে সারাবছরই সম্মান দেখাতে হবে। সবাই মিলে নারীর সম-অধিকারের জন্য কাজ করতে হবে। পরিবার থেকেই নারী-নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। এ দেশে নারীকে সম্মানের চোখে দেখা হতো। পশ্চিমা সংস্কৃতির আগ্রাসনে আজ নারী নির্যাতন বেড়েছে। তাই একদিনের জন্য নারী দিবসের আনুষ্ঠানিকতা নয়, প্রয়োজন সারাবছর নারীকে উপযুক্ত সম্মান দেয়া উচিত, কারণ তাঁরা মায়ের জাত।  

প্রতি বছর ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করা হয়। এই দিবসটি পালনের পেছনে রয়েছে নারী শ্রমিকের অধিকার আদায়ের দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস। ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ৮ মার্চ মজুরি-বৈষম্য, কর্মঘণ্টা নির্দিষ্টকরণ, কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের পোশাক ও টেক্সটাইল কারখানার নারী শ্রমিকেরা রাস্তায় নেমেছিলেন। এই ঘটনার ৫০ বছর উপলক্ষে ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে ৮ই মার্চ নিউইয়র্কে নারীশ্রমিকরা একই দাবিতে বিশাল মিছিলের আয়োজন করে। কথিত আছে ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে নিউইয়র্কে একটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীতে আগুন লেগে অনেকজন নারীশ্রমিক মারা যায়। এই অগ্নিকাণ্ডের প্রতিবাদে নারী শ্রমিকেরা মিছিল করে। পুলিশ সেই মিছিল ছত্রভঙ্গের জন্য নিষ্ঠুরভাবে মহিলাদের ওপর নির্যাতন চালায়। নারী দিবস নিয়ে আলোচনার শুরু হয় মূলত ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকেই। 

ঐ সালেই জার্মান নারীদের কংগ্রেস থেকে প্রথম প্রস্তাব আসে যে, পরবর্তী বছর অর্থাৎ ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে স্টুটগার্টে যে আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হবে, সেখানেই সমাজতান্ত্রিক নারীদেরও আলাদা একটা কনফারেন্স হওয়া উচিত। এই প্রস্তাবের পর একটা আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক নারী সম্মেলনের প্রস্তুতি শুরু হয়। ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ আগস্ট ১৫টি দেশের ৫৮ জন প্রতিনিধি নিয়ে প্রথম আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলন থেকে একটা ‘আন্তর্জাতিক উইমেন ব্যুরো’ গঠন করা হয়। যার প্রধান কার্যালয় হয় স্টুটগার্টে এবং ক্লারা জেটকিন সম্পাদিত পত্রিকা উরব এষবরপযযবরঃ, যার বাংলা অর্থ ‘সমতা’,নামক পত্রিকাটিকে এই সংগঠনের মুখপাত্র করা হয়। ক্লারা জেটকিন সংগঠনের সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন ।

পরবর্তীকালে ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে নিউইর্য়কে বস্ত্রশিল্পের নারীশ্রমিকরা কাজের সুস্থ পরিবেশ, সময় ও ন্যায্য মজুরির দাবিতে আন্দোলন করেন, নারী-নির্যাতন এবং বৈষম্য পরিবর্তনের মতো সমালোচনামূলক বিতর্কটির জন্য নারীদের প্রচারাভিযান শুরু হয়। ঐ খ্রিষ্টাব্দের ৩ মে, আমেরিকার নিউইয়র্কে গ্যারিক থিয়েটারে প্রায় ১৫০০ নারী শ্রমিকের অংশগ্রহণে মিটিং অনুষ্ঠিত হয়, যার সভাপতিত্ব করেন লরি এস. ব্রাউন। এই মিটিংয়ে নারীদের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সমানাধিকারের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে দিনটিকে নারীদের প্রতি উৎসর্গ করা হয়। একই খ্রিষ্টাব্দের ২৮ ফেব্রুয়ারি, রোববার সোশ্যালিস্ট পার্টি অব আমেরিকার নারী সংগঠন ওম্যান’স ন্যাশনাল কমিটির উদ্যোগে প্রথমবারের মতো সারা দেশে জাতীয় নারী দিবস পালন করা হয়। 

এই দিনটাকে বলা হয় আন্তর্জাতিক নারী দিবসের পূর্বপুরুষ। ২৪ নভেম্বর ক্লারা লেমলিচের নেতৃত্বে শার্টওয়েস্ট কারখানায় কর্মরত শ্রমিকেরা ধর্মঘট শুরু করে। ধর্মঘটরত শ্রমিকদের ৮০ শতাংশই ছিল নারী।  ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ ফেব্রুয়ারি নিউইয়র্কে থেরেসা মালিকেলের প্রস্তাবে ‘সোশ্যালিস্ট পার্টি অব আমেরিকা’ দ্বারা সংগঠিত ‘জাতীয় নারীবাদী দিবস’ নামে পরিচিত প্রথম নারী দিবস পালন করা হয়। নারীর কাজের অধিকার, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ এবং কাজের বৈষম্যের অবসানের জন্য প্রতিবাদ করেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। একই সঙ্গে রাশিয়ান মহিলারাও প্রথমবার ২৮ ফেব্রুয়ারি ‘রুটি ও শান্তি’র দাবিতে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিরোধিতা করেন।

ইউরোপের নারীরা ৮ মার্চ শান্তি বিষয়ক কার্যক্রমকে সমর্থন করে বিশাল মিছিলে নামেন। ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দের ২৬-২৯ আগস্ট দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় কোপেনহেগেন-এ। ১৭টি দেশের ১০০ জন প্রতিনিধি এই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। এখানেই জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী লুন্ডুসি জিটয্ আমেরিকায় জাতীয় নারী দিবসের ঘটনা থেকে প্রস্তাব করেন যে, মে দিবসের মতো করে আন্তর্জাতিকভাবে নারী দিবস পালন করা হোক, ক্লারা জেটকিন এই প্রস্তাবের সমর্থন করেন। মূলত ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ রবিবার থেকে শুরু করে ১লা মে পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে সুবিধামতো দিনে নারী দিবস পালন করা হয়ে থাকে। 

১৯১১ সালে কোপেনহেগেন প্রস্তাবের ফলস্বরূপ প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করা হয় ১৯ মার্চ ১৯১১। এই খ্রিষ্টাব্দের ২৫ মার্চ নিউ ইয়র্ক ট্রায়াঙ্গেল ওয়েস্ট কোম্পানিতে আগুন লেগে ১৪৬ জন মৃত্যুবরণ করেন, তন্মধ্যে ১৪৩ জন নারীশ্রমিক।  ১৯১১ খ্রিষ্টাবে অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক, জার্মানি, সুইজারল্যান্ডসহ প্রভৃতি দেশগুলোতে প্রায় ১০ লক্ষ নারী-পুরুষ নারী দিবসের মিছিলে অংশগ্রহণ করে। একই সঙ্গে এগিয়ে আসে পুরুষরাও, তারা নারীদের ভোটদান ও সরকারি অফিসে কাজ করার অধিকার আদায়ের দাবি জানান। সংগঠিত হয় ৩০০টিরও বেশি মিছিল। নারীর অধিকার নিশ্চিত করতে ১৯১১ সাল থেকে ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা করা হয়। এ ঘোষণা বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে আলোড়িত করে। ধীরে ধীরে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে যেতে থাকে নারী অধিকার বিষয়ক সচেতনতা।

১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে ৮ মার্চ দিনটা ছিল রবিবার। কালো জামা পরা একজন নারী দুহাতে একটা লাল পতাকা নাড়ছে আর পোস্টারে লেখা ছিল - ‘নারী দিবস ৮ মার্চ - নারীদের সর্বজনীন ভোটাধিকারের দাবিতে এগিয়ে চলুন’। ১৯১৩-১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে আন্তর্জাতিক নারী দিবস প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রতিবাদ জানানোর একটি প্রক্রিয়া হয়ে ওঠে। জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে সেবছর সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দ মধ্যে রাশিয়া ফেব্রুয়ারির শেষ রবিবার আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করে। ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দের ৮ মার্চ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেওয়ার দাবিতে ইউরোপে নারীরা র‌্যালি বের করে। সেবছর বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশেই দিনটি পালন করা হয়।

১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসে মস্কোতে অনুষ্ঠিত হয় কমিউনিস্ট উইম্যানস্ কংগ্রেস-এর দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলন এবং সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ক্লারা জেটকিন। এখানে বেলজিয়ামের একজন নারী-কমরেড প্রস্তাব করেন যে রাশিয়ান নারীদের বীরত্বের স্মরণে ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে নিয়মিত পালন করা হোক এবং ১৯২২ সাল থেকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করা শুরু হয়। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম পালিত হয় নারী দিবস। ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে  জাতিসংঘ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে আন্তজার্তিক নারী দিবস স্বীকৃতি পায়। 
 
নারী দিবস প্রতিষ্ঠা, এর ধারাবাহিকতা বজায় রাখা এবং মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করাজনপ্রিয় করা সবগুলো কাজই করেছে সমাজতন্ত্রীরা। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সারা পৃথিবীতে আমেরিকা এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে শীতল যুদ্ধ শুরু হয় এবং দুটো দেশই নিজেদের প্রভাব তা সামরিক, অর্থনৈতিক, আদর্শিক যাই হোক না কেন, বৃদ্ধি করার চেষ্টা করতে থাকে। পৃথিবীর প্রথম যে দেশ নারী দিবসকে জাতীয় দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে সেটা হলো সোভিয়েত ইউনিয়ন। বর্তমান বিশ্বে নারীর অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে দিবসটির তাৎপর্য ও গুরুত্ব অপরিসীম। সর্বক্ষেত্রে নারী-পুরুষের অংশীদারত্ব নিশ্চিত করার মাধ্যমে দেশের সার্বিক চিত্র পরিবর্তন করা সম্ভব, যা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সহায়ক।

নারীর ওপর বহুকাল ধরেই শোষণ চলছে। মালিকরা যেভাবে শ্রমিকের ওপর শোষণ করে, নারীর ওপরও একইরকম সামাজিক ও অর্থনৈতিক শোষণ চলছে। বর্তমান সমাজে দুর্বলদেরক শোষণ করে সম্পদ তৈরি করার চেষ্টা করা হয়। নারীরা যেহেতু অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল ও পুরুষের ওপর নির্ভরশীল, তাই তাঁদের ওপর অত্যাচার করা সহজ। আর নারীকে অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে পিছিয়ে রাখা হয়েছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর বাণীতে বলেছেন, বর্তমান সরকারের সময়োপযোগী পদক্ষেপে রাজনীতি, বিচার বিভাগ, প্রশাসন, শিক্ষা, চিকিৎসা, সশস্ত্র বাহিনী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সর্বক্ষেত্রে নারীরা যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখছেন। জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস তাঁর বাণীতে বলেন, নারীর অধিকার হচ্ছে মানবাধিকার। কিন্তু বর্তমান বিশ্বের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতে নারী ও কন্যাশিশুদের অধিকার হ্রাস পাচ্ছে, পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণও করা হচ্ছে। আইনের শাসন প্রয়োগসহ জনসচেতনতা বৃদ্ধি করার মাধ্যমে এই অবস্থার অবসান হওয়া আবশ্যক। 

লেখক: প্রফেসর ড. মো. লোকমান হোসেন, পরিচালক, জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি (নায়েম), শিক্ষা মন্ত্রণালয়

ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0038530826568604