গতবছর আমার এক কৃতী ছাত্র সৌমিত্র উৎস আমার কাছে নবম- দশম শ্রেণির ব্যাকরণ বইটি পড়ার সময় বইটির বিভিন্ন অসঙ্গতি বা ত্রুটি সম্পর্কে জানতে পারে। এ ব্যাপারে সে চিঠি লিখে বইটিকে ত্রুটিমুক্ত করার জন্য কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। এজন্য সৌমিত্রকে আন্তরিক সাধুবাদ ও অভিনন্দন। তো, তারই পরিপ্রেক্ষিতে এনসিটিবি কর্তৃপক্ষ বইটি সংশোধন বা পরিমার্জনের উদ্যোগ নেয়, যার ফসল নবম -দশম শ্রেণির পরিমার্জিত ও পরিবর্তিত নতুন বই।
কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, এ নতুন বইটিও অসংখ্য অসঙ্গতিতে ভরপুর। স্বল্প সময়ে বইটির যেসব অসঙ্গতি আমার চোখে পড়েছে, তা এখানে তুলে ধরলামঃ
১. পৃষ্ঠা ১। এখানে ভাষাভাষী জনসংখ্যা বিবেচনায় বাংলা ভাষার অবস্থান দেখানো হয়েছে ষষ্ঠ। কিন্তু ভাষা নিয়ে তথ্য সংগ্রহকারী সংস্থা এথনোলগ এর ২০১৭,২০১৮ ও ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলা ভাষার অবস্থান পঞ্চম। কেবল ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা ভাষার অবস্থান ছিলো ষষ্ঠ।
২.পৃষ্ঠা ৫-৭, লেখ্য ভাষা রীতির প্রকারভেদ। এখানে লেখ্য ভাষারীতিকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে - কাব্য রীতি, সাধু রীতি ও প্রমিত রীতি। কাব্য রীতিকে আবার গদ্য ও পদ্য - এ দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। তাহলে গদ্য ও পদ্যের রীতিকে যদি আমরা কাব্য রীতি বলি, সেখানে কি সাধু/ প্রমিত রীতি ব্যবহৃত হয় না? যদি হয়ে থাকে,সেটাকে 'কাব্য রীতি' নাম দিলে আলাদা করে সাধু ও প্রমিত রীতির নামকরণটা তখন বাহুল্য হয়না কি? আবার আগে থেকে বাংলা ভাষা রীতিতে সাধু, চলিত থাকলেও 'কাব্য রীতি' বলে কোনো শ্রেণিকরণ ছিলো না। পৃথিবীর অন্য কোনো ভাষায় আছে বলেও মনে হয় না।
৩. পৃষ্ঠা ২০। এখানে উষ্ম বর্ণের মধ্যে 'ষ' অনুপস্থিত। সর্বত্র এর তালব্য উচ্চারণ হওয়াই সম্ভবত এটাকে বাদ দেয়ার কারণ। যদি তাই হয়ে থাকে, সেটা উল্লেখ করলে ভালো হতো। একই আলোচনায় স, শ-কে শিস ধ্বনি বলার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে - শ্বাস অনেকক্ষণ ধরে রাখা যায়। কিন্তু শ্বাস অনেকক্ষণ ধরে রাখা যায় বলে এদের উষ্মবর্ণ বলা হয়। কারণ 'উষ্ম' অর্থ 'শ্বাস'। এদের উচ্চারণে শিস বাজানোর মতো আওয়াজ হয় বলে এগুলো শিস ধ্বনি।
৪. পৃষ্ঠা ২৩-২৫- এ বর্ণের উচ্চারণে সংবৃত-বিবৃত প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। অথচ এটা একটা প্রয়োজনীয় আলোচনা ছিলো।
৫. পৃষ্ঠা ৩৭-৩৯। এখানে সমাসের আলোচনায় সমাসকে চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে - দ্বন্দ্ব, কর্মধারয়, তৎপুরুষ, বহুব্রীহি। বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে দ্বিগু সমাস কর্মধারয়ের অন্তর্গত আবার কর্মধারয়ও একইভাবে তৎপুরুষের অন্তর্গত হতে পারে। সে হিসেবে সমাস হয় দ্বন্দ্ব, তৎপুরুষ, বহুব্রীহি, অব্যয়ীভাব -এই চার প্রকার। কিন্তু এখানে অব্যয়ীভাবকে পুরোপুরি বাদ দেয়া হয়েছে, যা অনভিপ্রেত। কেউ কেউ বলতে চান যে, অব্যয়ের জন্য আলাদা সমাস থাকলে উপসর্গের জন্যও আলাদা সমাস থাকতে হবে। তাদের বোঝা উচিত যে, উপসর্গও এক ধরনের অব্যয়। কাজেই 'উপসর্গজাত' বলে আলাদা কোনো সমাসের প্রয়োজন পড়ে না।
মনে রাখতে হবে, সাধিত শব্দগুলো অবশ্যই কোনো না কোনো একটা প্রক্রিয়ায় গঠিত। যদি অব্যয়ীভাব সমাস তুলে দেয়া হয়, তাহলে আপাদমস্তক, যথাসাধ্য শব্দগুলোকে কোন প্রক্রিয়ায় গঠিত বলা হবে? তৃতীয়া, চতুর্থী, পঞ্চমী বিভক্তি বাদ দেওয়ায় তৎপুরুষ সমাস থেকে যেসব শব্দ বাদ পড়ল; যেমন- মধুমাখা, বিয়ে পাগলা, বিলাতফেরত ইত্যাদি ; এগুলোকেই বা কোন প্রক্রিয়ায় গঠিত বলা হবে? ভুলে যাওয়া যাবে না যে, কোনো শব্দের ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ বা গঠন পদ্ধতি নির্ধারণে ব্যাকরণ ব্যর্থ হলে সে ব্যাকরণ ত্রুটিমুক্ত হতে পারে না।
৬. পৃষ্ঠা ৪১-৪২। আলোচ্য বিষয়- সন্ধি। বাংলা সন্ধি এখানে পুরোপুরি উপেক্ষিত হয়েছে, যা অনাকাঙ্ক্ষিত।
৭. পৃষ্ঠা ৫১-৫২। শব্দের শ্রেণিবিভাগ। এখানে শব্দকে ভাগ করা হয়েছে উৎস, গঠন ও পদ বিবেচনায়।
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে শব্দকে উৎস, গঠন ও অর্থ - এই তিন দিক থেকে ভাগ করা যায়। পদ বিবেচনায় শ্রেণিকৃত শব্দগুলো কিন্তু উৎস, গঠন ও অর্থগতভাবে শ্রেণিকৃত শব্দগুলোর মধ্যেই পড়ে। একই অধ্যায়ে 'হালুয়া' শব্দটিকে হিন্দি বলে উল্লেখ করা হয়েছে ; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি আরবি শব্দ।
৮. পৃষ্ঠা ৯৬। আলোচ্য বিষয় -কারক। সবাই জানে ক্রিয়ার সাথে সম্বন্ধযুক্ত পদই কারক। এখানে সম্বন্ধ পদকে কারক বলে অভিহিত করা হয়েছে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, ক্রিয়ার সাথে সম্বন্ধ পদের সম্পর্ক পরোক্ষ। কিন্তু "আমার ভাই ঢাকা গেছে। "- বাক্যে ঢাকা যাওয়ার সাথে আমার পরোক্ষ সম্পর্কটা কোথায়? আমি কি পরোক্ষভাবে ঢাকা গেলাম? হাস্যকর!
বইটি ভালো ভাবে লক্ষ করলে হয়তো আরও অনেক অসঙ্গতি ধরা পড়বে। আমার কথা হলো- যে ভাষার জন্য আমরা রক্ত দিয়েছি, সেই প্রিয় ভাষার ব্যাকরণ বই রচনায় ছেলেখেলা বা অবহেলা কখনোই কাম্য নয়। আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে কখনোই ভুল শিক্ষার দিকে ঠেলে দিতে পারি না। তাই আমি নবম-দশম শ্রেণির এই নতুন বইটি সংশোধন অথবা এর পূর্ববর্তী সংস্করণের বইটি ( মুনীর চৌধুরী ও মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী রচিত) পুনরায় চালু করার জন্য এনসিটিবি কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
লেখক : গোপাল চন্দ্র রায়, সহকারী শিক্ষক, দেবীগঞ্জ অলদিনী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, দেবীগঞ্জ, পঞ্চগড়।