পরীক্ষকদের বাসায় খাতা পাঠানো বন্ধ হচ্ছে - দৈনিকশিক্ষা

পরীক্ষকদের বাসায় খাতা পাঠানো বন্ধ হচ্ছে

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

পুরনো আমলের পরীক্ষা পদ্ধতির কারণে ফেঁসে গেছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি)। সময়মতো খাতা জমা না দেওয়ায় ৪১তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশ করতে পারছে না সাংবিধানিক এ সংস্থাটি। খাতা জমা হওয়ার পরও নানা অনিয়মের জন্য পরীক্ষকদের ঢাকায় পিএসসির সদর দপ্তরে ডেকে এনে তা সংশোধন করাতে হচ্ছে। এসব কারণে এক বছরের মধ্যে একটি বিসিএস শেষ করার যে রোডম্যাপ করেছিল সংস্থাটি তা হোঁচট খেয়েছে।

পিএসসির চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইন বলেন, ‘শুধু পরীক্ষা পদ্ধতিই নয়, সামগ্রিক বিষয়েই সংস্কার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। আমরা কাজ শুরু করেছি।’

৪১তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা শেষ হয়েছে গত বছর ৭ ডিসেম্বর। লিখিত পরীক্ষার পর প্রায় ৯ মাস পার হয়ে গেলেও ফল প্রকাশ করতে পারেনি পিএসসি। ৩১৮ জন পরীক্ষক সময়মতো খাতা জমা দেননি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষককে ১০০ খাতা দেওয়া হয়েছিল। নির্ধারিত সময়ে তিনি মাত্র ১৫টি খাতা দেখেছেন। কিছু পরীক্ষক চাকরিপ্রার্থীদের অনেক প্রশ্নের উত্তরের জন্য কোনো নম্বরই দেননি। উত্তরপত্রের প্রাপ্ত নম্বরের যোগফল নির্ণয়ে ভুল করেছেন কিছু পরীক্ষক। খাতার শেষদিকে থাকা উত্তর অনেকে এড়িয়ে গেছেন। আবার অনেকে এমন দায়সারাভাবে নম্বর দিয়েছেন যা পুনর্মূল্যায়নের জন্য তৃতীয় পরীক্ষকের কাছে পাঠাতে হয়েছে। উত্তরপত্রের এসব ত্রুটি সংশোধনের জন্য এখন পরীক্ষকদের ডেকে আনা হচ্ছে পিএসসিতে।

সোহরাব হোসাইন বলেন, ‘এটা খুব দুঃখজনক ঘটনা। পরীক্ষকরা খাতা নিয়েছেন, সময়মতো ফেরত দেওয়া তাদের দায়িত্ব। তারা সেই দায়িত্ব পালন করেননি। আমরা তাদের ওপর নির্ভর করতে না পারলে কাদের ওপর নির্ভর করব। যাই হোক, বিষয়টি থেকে আমরা শিক্ষা নিয়েছি।’

পিএসসির সাবেক একাধিক সদস্যের সঙ্গে কথা বলেছেন এ প্রতিবেদক। তারা জানিয়েছেন, সনাতন পরীক্ষাপদ্ধতি থেকে পিএসসির বের হয়ে আসা উচিত। প্রশ্নপত্র প্রণয়ন থেকে শুরু করে মডারেশন সব জায়গায় সংস্কার আনা দরকার। পিএসসির সিলেবাসও আধুনিক নয়। এ সিলেবাসে একশ্রেণির চাকরিপ্রার্থী সুবিধা পাচ্ছে, আরেক শ্রেণির চাকরিপ্রার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছে। এমনভাবে প্রশ্ন করা উচিত যেন চাকরিপ্রার্থী সবাই সমান সুযোগ পায়। কারণ পিএসসি স্নাতক পাস সবার জন্য আবেদনের সুযোগ রাখে।

সদস্যরা বলেছেন, একজন পরীক্ষকের বাসায় খাতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নানা কারণে ঝুঁকিপূর্ণ। যদিও কার খাতা পরীক্ষক মূল্যায়ন করছেন তা নির্ণয় করা সম্ভব নয়। কিন্তু পরীক্ষকের পরিবারের সদস্যরা এসব খাতা দেখছেন। পরীক্ষকদের গাড়িচালক থেকে শুরু করে বাসার কাজের লোকজনের সামনে এসব খাতা উন্মুক্ত থাকছে। তাদের কারণে এসব খাতা যেকোনো সময় ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। খাতা নিয়ে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে যাতায়াতের সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

একজন সাবেক সদস্য বলেছেন, পরীক্ষা পদ্ধতিতে প্রতিবেশী ভারতকে অনুসরণ করতে পারে পিএসসি। ক্যাডার সার্ভিসের খাতা মূল্যায়নে ভারতের সব পরীক্ষক ইন্ডিয়া ইউনিয়ন সিভিল সার্ভিসে চুক্তিবদ্ধ। তারা পরীক্ষার উত্তরপত্র বাসায় নিতে পারেন না। ইউনিয়ন সিভিল সার্ভিসের অফিসে বসেই খাতা মূল্যায়ন করেন। একজন পরীক্ষক সর্বোচ্চ ১০০টি খাতা দেখেন। তার সিনিয়র পরীক্ষক দেখেন ওই ১০০টির মধ্যে ১৫টি। আর যিনি এ বিভাগের প্রধান তিনি দেখেন ৫টি খাতা। এভাবে পুরো খাতা মূল্যায়ন করা হলে একই সঙ্গে নিরীক্ষার কাজটিও হয়ে যায়। বাংলাদেশের পিএসসিও এ নীতি অনুসরণ করতে পারে।

ইন্ডিয়া ইউনিয়ন সিভিল সার্ভিসের বিষয়টি সম্পর্কে অবগত আছেন পিএসসির অনেক সদস্য। তারা বলেছেন, খাতা মূল্যায়নের এটা সেরা বিকল্প হতে পারে। তাছাড়া তেজগাঁওয়ের পিএসসির পুরাতন অফিসে জায়গার সংকট ছিল। আগারগাঁওয়ের বর্তমান অফিসে এ সংকট নেই। পিএসসিতে এসে খাতা দেখার ব্যবস্থা করা হলে টপসিটের বৃত্ত ভরাটের কাজটিও পরীক্ষকদের করতে হবে না। এ কাজটি পিএসসির কর্মীরা করবে।

চাকরিপ্রার্থীদের খাতা মূল্যায়নে বিলম্ব বা নানা ধরনের ভুলভ্রান্তির বিষয়ে জানতে চাইলে একজন পরীক্ষক জানান, সাধারণত অধ্যাপকদের খাতা মূল্যায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তার নিচের স্তরেও খাতা যায়। এছাড়া প্রশাসনের বাছাই করা কিছু কর্মকর্তাও খাতা দেখেন। বিসিএস চাকরিপ্রার্থীদের খাতার টপসিট পূরণ করতে হয় খাতা মূল্যায়নকারীদের। একজন বয়স্ক শিক্ষকের পক্ষে বৃত্ত ভরাট করা জটিল একটা কাজ। একাধিক বৃত্ত ভরাট করতে গিয়েই বেশিরভাগ শিক্ষক ভুল করেছেন। কিছু শিক্ষক আছেন নিজের ছেলেমেয়েদের দিয়ে খাতা দেখান। বিসিএস পরীক্ষার খাতা গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত। একসময় পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নে কম টাকা পাওয়া যেত। কিন্তু এখন যথেষ্ট টাকা দেওয়া হয়। সবকিছু মিলে অবহেলার বিষয়টিই আসল কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ৪১তম বিসিএসের ক্ষেত্রে।

পিএসসির এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, নিয়োগ পরীক্ষা নেওয়া, তার আগে প্রশ্নপত্র তৈরি করা, খাতা দেখা, মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া এসব কাজের প্রত্যেকটি ধাপে আলাদা আলাদা সম্মানী পেয়ে থাকেন সরকারি, আধাসরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত কর্মকর্তারা। এসব বিষয়ে দায়িত্ব পালনকারী সরকারি কর্মচারীদের সম্মানী ৬৬ শতাংশ বাড়িয়েছে সরকার। কোনো কোনো বিষয়ে বাড়ানো হয়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। ক্যাডার পদের পূর্ণ উত্তরপত্র পরীক্ষণ ফি ২৫০ থেকে বাড়িয়ে ৩৭৫ টাকা করা হয়েছে। প্রার্থীরা ২০০ নম্বরের জন্য চার ঘণ্টায় এ পরীক্ষা দেন। পূর্ণ উত্তরপত্র পরীক্ষণে এখানে লিথোকোডে গৃহীত পরীক্ষায় বৃত্ত ভরাট করতে হয়। ১০০ নম্বরের তিন ঘণ্টার পরীক্ষার উত্তরপত্র পরীক্ষণ ফি ১০০ টাকা বাড়ানো হয়েছে। আগে এ খাতার পরীক্ষণ ফি ছিল ২০০ টাকা। এখন তা ৩০০ টাকা করা হয়েছে। নন-ক্যাডার পদের জন্য ১০০ টাকা বাড়ানো হয়েছে। ক্যাডার ও নন-ক্যাডার পদের জন্য ৫০-এর কম নম্বরের উত্তরপত্র মূল্যায়ন ফি ১৫০ থেকে বাড়িয়ে ২২৫ টাকা করা হয়েছে। এখানেও লিথোকোডে নেওয়া পরীক্ষার ক্ষেত্রে বৃত্ত ভরাট করতে হয়।

সময়মতো খাতা না জমা দেওয়ায় বা খাতায় ভুল সংশোধনের কাজ কতটা গুছিয়ে আনা হয়েছে জানতে চাইলে পিএসসির এক সদস্য জানান, সর্বোচ্চ আর এক সপ্তাহ লাগবে। এরপরই ৪১তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা যাবে।

যারা সময়মতো খাতা জমা দেননি বা নানা ভুলভ্রান্তি করেছেন তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ পিএসসির আছে কি না জানতে চাইলে চেয়ারম্যান সোহরাব হোসাইন বলেন, ‘পিএসসি এসব পরীক্ষককে তালিকা থেকে বাদ দেবে। অনেক পরীক্ষককে সতর্ক করা হচ্ছে। একই সঙ্গে যারা সময়মতো খাতা জমা দিয়েছেন তাদের উৎসাহিত করা হচ্ছে।’

চাকরিপ্রার্থী খাতা মূল্যায়নে কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন কি না জানতে চাইলে চেয়ারম্যান বলেন, ‘তাদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। যতক্ষণ আমরা নিশ্চিত না হচ্ছি ততক্ষণ আমরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিচ্ছি না। কাজেই চাকরিপ্রার্থীরা এ বিষয়ে নিশ্চিত থাকতে পারেন।’

পিএসসির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, পিএসসি এক বছরের মধ্যে একটা বিসিএস শেষ করার চ্যালেঞ্জ নিয়েছে। এজন্য একটি রোডম্যাপও অনুসরণ করা হচ্ছে। খাতা মূল্যায়নে এ অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটায় রোডম্যাপে পিএসসি একটু পিছিয়ে পড়বে।

পিএসসির চেয়ারম্যান বলেছেন, ‘আমরা এ ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি। তাছাড়া যে রোডম্যাপ অনুসরণ করা হচ্ছিল তা বহাল রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি প্রতি বছর ৩০ নভেম্বর বিসিএসের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হবে। যেটুকু বা যেসব পদের জন্য জনপ্রশাসন চাহিদা দেবে তার ওপর ভিত্তি করেই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হবে। প্রিলিমিনারি, লিখিত ও ভাইভা কতদিনের মধ্যে নেওয়া হবে তাও চূড়ান্ত করার কাজ চলছে।’

সাবেক শিক্ষা সচিব নজরুল ইসলাম খান  বলেন, ‘এক বছরের মধ্যে বিসিএস শেষ করতে হলে প্রিলিমিনারিতে প্রার্থীর সংখ্যা কমাতে হবে। এখন কমবেশি চার লাখ প্রার্থী প্রিলিমিনারিতে অংশ নেয়। এটা অর্ধেকে নামিয়ে আনতে হবে। এখন স্নাতক হলেই বিসিএস দিতে পারে। সেটা আরও কঠোর করতে হবে। শিক্ষাজীবনে নির্ধারিত নম্বরের প্রার্থীরাই শুধু বিসিএস দেবে এ নিয়ম করতে পারলে এক বছরের মধ্যে বিসিএস শেষ করা যাবে।’

পিএসসির সাবেক সদস্য আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘সংস্কার একটা চলমান বিষয়। পিএসসিকে সবসময়ই পরীক্ষা নিতে হবে আবার সংস্কারের কাজও চালিয়ে যেতে হবে। তাহলে অচলাবস্থা তৈরি হবে না।’

প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ - dainik shiksha প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার - dainik shiksha তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার - dainik shiksha স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন - dainik shiksha নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0032930374145508