প্রবীণ শিক্ষকদের হাহাকার বন্ধ হোক - দৈনিকশিক্ষা

প্রবীণ শিক্ষকদের হাহাকার বন্ধ হোক

অধ্যাপক মো. আলী এরশাদ হোসেন আজাদ |
প্রবীণদের ইংরেজিতে বলা হয় ‘Senior Citizen’। এখন প্রবীণরা তথা পিতামাতা অনেকভাবেই উপেক্ষিত, ‘কঠিন ঝামেলা’। অথচ তারাই জীবন-যৌবনের সর্বস্ব লুটিয়ে দেন সন্তানের জন্য। কিন্তু যখন তাদের নিদান কাল তখন তারাই হন বড় ‘ঝামেলার’। প্রবীণের প্রতি অযত্ন, অবহেলা এখন নির্যাতন পর্যায়ের, বৈশ্বিক সমস্যা। এমনকি তা অনেক সময় প্রবীণদের মৃত্যুর কারণও হয়। ডব্লিউএইচও’র মতে, বিশ্বে বর্তমানে প্রতি ৬ জনে ১ জন প্রবীণ নির্যাতনের শিকার, যার সংখ্যা ১৪ কোটিরও বেশি।
 
এই প্রবীণ যদি হন বেসরকারি স্কুল-কলেজ, মাদরাসার শিক্ষক (এমপিও/নন-এমপিও), তবে তো তারা ‘গোদের ওপর বিষফোড়া’। পাশে থাকেন না তার কর্মস্থলের স্বজন-সহকর্মীরও। তাদের পাশে সমাজের অবহেলা, তাচ্ছিল্য ও করুণাদৃষ্টি ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। কেনোনা, কর্মরত অবস্থায়ই তাদের ‘নুন আনতে পানতা ফুরায়’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরর অধ্যাপক এএসএম আতিকুর রহমান তার চার দশক গবেষণায় দেখিয়েছেন, ‘বার্ধক্য এমন একটা বিষয় যেটা কেউ বুঝতে চায় না, জানতে চায় না, শুনতে চায় না। প্রবীণদের কষ্টের কোনো সীমা নেই...’।
 
আইনজীবী, বিচারক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়র বা অন্যান্য পেশাজীবীর অভিজ্ঞার যেমন মূল্য-মূল্যায়ন শিক্ষকদের বেলায় ঠিক তার উল্টো। বড়ো ডাক্তারের ভিজিট বেশি, প্রবীণ উকিলের মোক্কেল ও ফি দু-ই বেশি। অথচ সমাজে প্রবীণ শিক্ষকদের কেই বা খোঁজ নেন! জীবনচক্রের স্বাভাবিকতায় বয়স শেষে অবসরে-আয় বন্ধ হলেও ব্যয়ে বাড়ে, কমে যায় দৈহিক সামর্থ, তখন? অবসরপ্রাপ্ত বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীরা আছেন অন্তহীন দুঃখ-কষ্টে। অন্যান্য পেশাজীবীদের মতো তাদেরও স্বপ্ন ছিলো, অবসর জীবনে একটু শান্তিতে বেঁচে থাকবার। অবহেলিত সাধারণ শিক্ষকরা গ্রামগঞ্জে নানা প্রতিকূলতার মধ্যে চাকরি করে আলোর পথ দেখিয়েছেন-ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে। অথচ জীবন সায়াহ্নে অবসর সুবিধা প্রাপ্তির বিলম্ব ও অনিশ্চয়তায় নিদারুণ কষ্টে প্রবীণ শিক্ষকদের দিন কাটছে। তাদের অধিকাংশের পথচলা দুর্ভাগ্যের কাদায় আটকে যাচ্ছে! 
 
একদিকে রোগ-ব্যাধি অন্যদিকে পরিবারের ব্যয় নির্বাহ, তাদের জন্য বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। অনেক শিক্ষকই অর্থের অভাবে চিকিৎসা করাতে না পেরে হচ্ছেন মৃত্যুপথযাত্রী। মাঝে মাঝে অনেক বেদনাদায়ক খবর আমাদেরকে দুঃখ ভারাক্রান্ত করে। অবসর সুবিধার পেছনে ঘুরতে ঘুরতে অনেকে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। এ জন্য রয়েছে ঘুষ বানিজ্য, হয়রানির নানান আখ্যান।
 
বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের অবসর সুবিধার অর্থের জন্য অনন্ত অপেক্ষা কখনো কাম্য হতে পারে না। বাংলাদেশ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। তাহলে শিক্ষকরা কেনো অবহেলিত থাকবেন? সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে। প্রয়োজনে পর্যাপ্ত বিশেষ অর্থ বরাদ্দ দিয়ে যথা শিগগির শিক্ষকদের অবসরকালীন কল্যাণ সুবিধা নিশ্চিত করা। কেনোনা,  মনের গভীরে অনুরণিত হচ্ছে ভূপেন হাজারিকার গান: ‘বলো কী তোমার ক্ষতি, জীবনের অথৈ নদী/পার হয় তোমাকে ধরে দুর্বল মানুষ যদি...’।
 
পেশাগত বঞ্চনার করুণ আর্তি
 
এমপিওভুক্ত শিক্ষকের ২৫ শতাংশ উৎসব ভাতা, ‘জাতীয় লজ্জা’! তাদের বাড়িভাড়া ১০০০ টাকা, চিকিৎসাভাতা ৫০০ টাকা। পূর্ণাঙ্গ মেডিক্যাল ভাতা, বদলি সুবিধাসহ অসংখ্য বঞ্চনার শিকার এই প্রবীণ শিক্ষকরা। নেই সেচ্ছায় অবসরের সুযোগও। তাদের পদোন্নতির সুযোগ সীমিত ও শর্তযুক্ত। ‘সহ’ ‘উপ’ ‘যুগ্ম’ ‘সাব’ ‘জুনিয়র’ ইত্যাদি পদবির চূড়ান্ত ধাপে পূর্ণ পদবিধারী থাকেন। এমপিওভুক্ত কলেজে সহযোগী অধ্যাপক বা অধ্যাপকের পদ না থাকায় জিজ্ঞাসা, ‘সহকারী অধ্যাপকরা’ কোন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সহকারী? এমপিওভুক্ত কলেজে অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ হতে হলে প্রার্থীকে নতুন করে চাকরি খুঁজতে হয়। আছে নানা শর্তের জটিল বেড়াজাল। চাকরি পেলে ছাড়তে হয় আগের পদ।
 
শিক্ষকদের নেই গৃহনির্মাণ ঋণ, নেই আবাসনের জন্য কোনো কর্মসূচি। যে দেশে ছিন্নমূল গৃহহীনের জন্য আছে ‘আশ্রায়ণ’, সে দেশেরই মানুষ গড়ার কারিগরের বাড়িভাড়া ১০০০ টাকা! অবসরে গেলে তো ওই ১০০০ টাকাও বন্ধ। অনেক শিক্ষকই নিজ নিজ প্রতিষ্ঠান হতে পান না আবাসন ও অবসরকালীন আর্থিক সুবিধাও। নানা কৌশল-অপকৌশলের কারণে তাদের অনেকের ভাগ্যে জোটে না একটি সম্মানজনক বিদায় অনুষ্ঠানও।
 
ভরণপোষণ আইন ২০১৩
 
দেশের বাস্তবতার পটভূমিতে প্রণীত হয়েছে ‘পিতামাতার ভরণপোষণ আইন ২০১৩’। আইনে, ‘ভরণপোষণ অর্থ খাওয়া-দাওয়া, বস্ত্র, চিকিৎসা ও বসবাসের সুবিধা এবং সঙ্গ প্রদান’ বোঝানো হয়েছে। আইনের ৩ নম্বর ধারার সারসংক্ষেপ হলো: 
• সন্তানকে পিতামাতার ভরণপোষণ নিশ্চিত করতে হবে।
• একাধিক সন্তানের ক্ষেত্রে, সন্তানরা পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে পিতামাতার ভরণপোষণ নিশ্চিত করবেন।
• পিতামাতার ভরণপোষণ নিশ্চিতকল্পে সন্তানের একই স্থানে, একসঙ্গে বসবাস নিশ্চিত করতে হবে।
• পিতামাতার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদেরকে বৃদ্ধনিবাস বা অন্যত্র বসবাসে বাধ্য করা যাবে না।
• সন্তান নিয়মিত পিতামাতার চিকিৎসা সেবা ও পরিচর্যা করবেন।
• পিতামাতা অন্যত্র থাকলেও সন্তান নিয়মিত তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন।
• সন্তান নিয়মিত তার আয়-রোজগার হতে যুক্তিসঙ্গত পরিমাণ অর্থ পিতামাতাকে প্রদান করবেন।
 
‘পিতামাতার ভরণপোষণ আইন ২০১৩’এর ধারা-উপধারা সন্তান কর্তৃক লঙ্ঘন, অপরাধ বলে গণ্য হবে এবং উক্তরূপ অপরাধের জন্য অনূর্ধ্ব এক লাখ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত, অনাদায়ে তিন মাস কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। 
 
পিতামাতার ভরণপোষণে বাধাদান/অসহযোগিতার জন্য সন্তানের স্ত্রী/স্বামী/নিকট আত্মীয়ও উক্তরূপ অপরাধ সংঘটনে সহায়তাকারী হিসেবে গণ্য এবং আইনে বর্ণিত দণ্ডে দণ্ডিত হবে।
 
আমাদের প্রত্যাশা, আইনের কঠোরতম প্রয়োগের মাধ্যমে ‘প্রবীণ শিক্ষকের হাহাকার’ বন্ধ হবে। তবুও কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন না হবার কারণ অপরাধটি আমলযোগ্য, জামিনযোগ্য ও আপসযোগ্য। 
 
প্রবীণ শিক্ষকদের অনেকেই ‘নিদানে’র কালে বড়ই একা 
 
প্রবীণদের প্রত্যাশা থাকে জীবনের শেষ দিনগুলো কাটুক সন্তান-স্বজন পরিবেষ্টিত নিরাপদ আশ্রয়ে। অথচ ‘প্রীতি প্রেমের পূণ্য বাঁধনে’র চিরায়ত ভাবনা বদলে তৈরি হচ্ছে ‘বৃদ্ধাশ্রম’! ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ‘স্বর্গীয়’ সুখের ধারণা। আজ প্রবীণ অসহায় শিক্ষকদের অনেকেই ‘নিদানের কালে বড়ই একা ও অসহায়। সবার কাছ থেকে একা হয়ে ঐ প্র ওই শিক্ষকরা যখন এক আল্লাহর সান্নিধ্যের অপেক্ষায় থেকে থেকে নীরব অভিমানে চলে যান, তখনো তবুও কারো কারো বোধোদয় হয় না। তাই বলি: অভিমানে আপন মানুষ হয়ে যায় পর/অতি কষ্টে ওই মানুষ হয়ে যায় পাথর...। 
 
বাংলাদেশে প্রবীণ শিক্ষক সংখ্যায় নগণ্য নন, তাদের হাহাকার ও দীর্ঘশ্বাস অনন্ত অপেক্ষায়ও অনিঃশেষ। আসলে চিরবঞ্চনাই যেনো বেসরকারি শিক্ষকদের ভাগ্য। পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে মানুষের গড় আয়ু ৭২ দশমিক ৩। আইএমএফের এক রিপোর্টে জানা যায় ২০৫০ এর মধ্যে প্রতি চারজন কর্মক্ষমের বিপরীতে একজন বৃদ্ধ থাকবেন অগ্রসর দেশগুলোতে। যাতে জিডিপির দুই শতাংশ অতিরিক্ত সম্পদের প্রয়োজন হবে। বাংলাদেশে ষাট বছরের বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা এক কোটির বেশি। এ সংখ্যা ২০৫০ এ হবে চার কোটি বা আরো বেশি। এমনই পটভূমিতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা বাড়ানো হয়েছে অনেক আগেই। শিক্ষকদের অবসরের বয়সসীমা অন্তত ৬৫ বছর করা অতীব জরুরি ও সময়ের দাবি। 
 
মানবতার স্খলন ‘বৃদ্ধাশ্রম’ 
 
প্রাচীন চীনের ‘শান রাজবংশ’ খ্রিষ্টপূর্ব ২২০০ পৃথিবীর প্রথম বৃদ্ধাশ্রম বানিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করে। বর্তমানেও আছে ‘বৃদ্ধাশ্রম’ ধারণা। একজন প্রবীণ শিক্ষক পারেন না তার ব্যক্তিত্বের সঙ্গে আপস করতে। ‘বৃদ্ধাশ্রম’ আমাদের সমাজ বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খায় কি? বরং সন্তান সান্নিধ্য; বার্ধক্য পীড়িত, মৃত্যু পথযাত্রীদের একমাত্র সুখ সান্ত্বনা। প্রবীণ ও অবসরপ্রাপ্ত একজন শিক্ষকের মনও সন্তানের জন্য ব্যাকুল থাকে, কিন্তু হায়: ‘নানা রকম জিনিস আর আসবাব দামি দামি/সবচেয়ে কম দামি ছিলাম একমাত্র আমি!!/ছেলে আমার, আমার প্রতি অগাধ সম্ভ্রম/আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম!!! (নচিকেতা)। 
 
শিক্ষকরা সৎচিন্তা-সৎকর্মে নিবেদিত প্রাণ। সাধারণত তারা হয়ে থাকেন দীর্ঘায়ু। অথচ কমে আসে তাদের দৈহিক সামর্থ্য। কাজেই, আমাদের সবার আন্তরিক হতে হবে ও সচেতনতা বাড়াতে হবে। বাস্তবতা হলো, কচুপাতার পানির মতো যৌবন গড়াবে নিশ্চিত বার্ধক্যে। বেঁচে থাকলে বার্ধক্য আসবেই; হয়তো কারো আগে, কারো বা একটু পরে। প্রিয়নবীর (স.) শেখানো নিবেদন: ‘হে আল্লাহ! তোমার কাছে আমি ভীরুতা হতে আশ্রয় চাই, তোমার কাছে কৃপণতা হতে আশ্রয় চাই, তোমার কাছে অতি বার্ধক্যে পৌঁছার বয়স হতে আশ্রয় চাই এবং তোমার কাছে দুনিয়ার ঝগড়া-বিবাদ ও কবরের শাস্তি হতে আশ্রয় চাই’ (বুখারি)।                                                                                    
 
লেখক: বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ, কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ, গাজীপুর

 

 

 

কাল খুলছে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শনিবারও চালু ক্লাস - dainik shiksha কাল খুলছে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শনিবারও চালু ক্লাস সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিমের চাকরি জাতীয়করণ দাবি - dainik shiksha সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিমের চাকরি জাতীয়করণ দাবি উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি - dainik shiksha উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি শিক্ষকের বেতন ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে কাজ চলছে: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকের বেতন ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে কাজ চলছে: শিক্ষামন্ত্রী বিএসসি মর্যাদার দাবিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মাসব্যাপী কর্মসূচি - dainik shiksha বিএসসি মর্যাদার দাবিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মাসব্যাপী কর্মসূচি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে ১৩ বছরের কম বয়সী শিশুদের হাতে স্মার্টফোন নয় - dainik shiksha ১৩ বছরের কম বয়সী শিশুদের হাতে স্মার্টফোন নয় একই স্কুলের দুই ছাত্রীকে বিয়ের পর আরেক ছাত্রীকে ল্যাব সহকারীর অনৈতিক প্রস্তাব - dainik shiksha একই স্কুলের দুই ছাত্রীকে বিয়ের পর আরেক ছাত্রীকে ল্যাব সহকারীর অনৈতিক প্রস্তাব দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে - dainik shiksha এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0067610740661621