যারা প্রশ্ন ফাঁস করছে কিংবা ভুয়া প্রশ্ন সামাজিক নেটওয়ার্কে ছড়িয়ে দিচ্ছে তারা কারা? তারা কি শুধুই শিক্ষক, নাকি প্রশ্নপত্র কম্পোজ, মুদ্রণ ও বিতরণ চেইনের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারী, নাকি অন্য কেউ? কারা এ দুর্বৃত্তায়নের কাজটি বারবার করে যাচ্ছে এবং কেন করছে, এ বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য কোনো গভীর অনুসন্ধান এবং পারিপার্শ্বিক তথ্য-উপাত্ত কি বিশ্লেষণ করা হয়েছে? আমার জানা মতে কোনোটিই হয়নি। বসে থাকার সুযোগ নেই। সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষাব্যবস্থার সুনাম বিনষ্ট হওয়ার আগেই জোরেশোরে কাজে নেমে পড়তে হবে। তা এখনই। প্রথমেই শিক্ষা-জগতের দেশপ্রেমী নিবেদিত কয়েকজনকে দিয়ে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি গঠন করা যেতে পারে। শিক্ষা সংক্রান্ত কাজ শিক্ষাজগতের লোকদের দিয়েই করাতে হবে।
তারা তাদের জগত্টা অন্যদের তুলনায় অবশ্যই বেশি ভালো বোঝেন। গঠিত কমিটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তদন্ত কাজ সমাপ্ত করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে রিপোর্ট জমা দেবে। কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে মন্ত্রণালয় অনতিবিলম্বে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। চিহ্নিত ব্যক্তিদেরকে ‘জাতীয় দুর্বৃত্ত’ ঘোষণা করে তাদের ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশ করে সমগ্র জাতির কাছে গণমাধ্যমে প্রকাশ্যে ক্ষমা প্রার্থনার জন্য বাধ্য করতে হবে। তাদেরকে প্রোটেকশন বা আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়ার জন্য কেউ চেষ্টা করলে, তাদের সামাজিক বা রাজনৈতিক পরিচয় যা-ই থাকুক না কেন, তাদেরকেও ‘জাতীয় দুর্বৃত্ত লালনকারী’ ঘোষণা করতে হবে।
শিক্ষার পরিবেশ নিয়ে আমাদের দেশটা বড় বেশি উদাসীন। স্কুল-কলেজে শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য বাস্তবায়নযোগ্য পদক্ষেপ নিতে হবে এবং ভীতিহীন আনন্দঘন পরিবেশে পরীক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। পরীক্ষা যে ভীতিজনক কিছু নয় তা শিক্ষার্থীদের নিকট স্পষ্ট করতে হবে। শিক্ষার্থীরা যদি বিভিন্ন বিষয়ের বিষয়বস্তু সঠিকভাবে বুঝেশুনে শিখতে পারে, তাহলে তারা পরীক্ষাকে ভয় পাবে না, নকল করার বা পরীক্ষার আগে প্রশ্ন পাওয়ার জন্য আকুলিত হবে না। আমরা দেখতে পাচ্ছি বর্তমান সরকার শিক্ষাবান্ধব, শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে শিক্ষকদেরকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে এবং হচ্ছে। অথচ পরীক্ষা শিক্ষার্থীবান্ধব হচ্ছে না। ভীতিকর পরিবেশে পরীক্ষা নেয়া হলে শিক্ষার্থীরা অসদুপায় অবলম্বন করতে চাইবে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। পরীক্ষা পদ্ধতিতেও পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। আরেকটি বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব দেয়া জরুরি। তাহলো, শিক্ষক হওয়ার মতো যোগ্য লোকদেরকে লিখিত পরীক্ষা ও নিয়োগ-পূর্ব ক্লাস-ডেমোনেস্ট্রেশনের মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করে শিক্ষ্ক হিসেবে নিয়োগ দেয়া এবং স্কুল-কলেজে ক্লাসগুলো নিয়মিত মনিটরিং-এর ব্যবস্থা করা। শোনা যায়, অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই নিয়মিত ক্লাস হয় না, শিক্ষকরা ক্লাসে আসেন না, ছাত্রছাত্রীরাও আসে না।
শুধু পরীক্ষার সময় দু’পক্ষের দেখা-সাক্ষাত্ হয়। এসব কীভাবে করা যাবে তা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পর্যালোচনা করে দেখার জন্য শিক্ষাক্ষেত্রের বোদ্ধাদের নিয়ে টাস্কফোর্স গঠন করে কর্মপন্থা নির্ধারণ করা প্রয়োজন। বহু-নির্বাচনী প্রশ্ন বা এমসিকিউ প্রশ্নের কিছু ভালো দিক থাকলেও বর্তমান প্রেক্ষাপটে এটি উঠিয়ে দেয়াটা দরকার বলে মনে হয়। এর পরিবর্তে থাকতে পারে সংক্ষিপ্ত-উত্তর বিশিষ্ট বেশি সংখ্যক প্রশ্নমালা। অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়ার বিষয়টি গুরুত্বের সাথে চিন্তা করা যায়। অনলাইন পরীক্ষা ব্যবস্থায় একটি প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য নির্ধারিত সময় পার হওয়ার পর ওই প্রশ্নের জন্য উত্তরের জায়গায় আরও কিছু লেখার সুযোগ লক্ করার ব্যবস্থা করার ব্যবস্থা করা যেতে পারে— যাতে সুবিধামতো নকল করার সুযোগ না থাকে। অনলাইনে পরীক্ষা নেয়ার ব্যাপারটা তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার কারণে আইটি বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নেয়ার প্রয়োজন হবে।
বাংলাদেশে এখন এ ধরনের বিশেষজ্ঞের অভাব নেই। বিগত কয়েক বছরে সরকারের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ ভিশনের আলোকে গৃহীত সৃশৃঙ্খল কর্মকাণ্ডের ফলে বিপুল সংখ্যক আইটি বিশেষজ্ঞ তৈরি হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীরও অনলাইন পরীক্ষার ব্যাপারে আগ্রহ রয়েছে বিধায় আমি মনে করি এ বিষয়ে রাজনৈতিক সাপোর্ট পাওয়া যাবে। তবে অনলাইন পরীক্ষা নেওয়ার জন্য সরকারকে প্রচুর বিনিয়োগ করতে হবে। প্রত্যেক পরীক্ষা কেন্দ্রে যথোপযুক্ত সংখ্যক কম্পিউটার সরবরাহ করার পাশাপাশি কেন্দ্রে ইন্টারনেট সংযোগ নিশ্চিত করতে হবে।
অনলাইন পরীক্ষার ব্যবস্থা করার বিষয়টি সময়সাপেক্ষ বিধায় এ মুহূর্তে যা করা যেতে পারে তাহলো: প্রথমত, পরীক্ষা শুরুর দুইঘন্টা আগে থেকে পরবর্তী একঘন্টা পর্যন্ত ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে রাখা। এতে জনগণের কিছুটা অসুবিধা হবে বটে, তবে বৃহত্তর স্বার্থে এটি করা খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। দ্বিতীয়ত, পরীক্ষা কেন্দ্রে দায়িত্বরতদের জন্য পরীক্ষার সময়ে মোবাইল ফোন বহন নিষিদ্ধ করা এবং তা সঠিকভাবে মনিটরিং করা। তৃতীয়ত, প্রশ্নপত্র বোর্ড কর্তৃক নির্ধারিত স্থান থেকে পরীক্ষা কেন্দ্রে নেওয়ার ব্যবস্থাটি পুরোপুরি ডিজিটাল করা। আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সার্ভিস কোম্পানিগুলোর মতো ট্র্যাকিং সিস্টেম তৈরি করে পুরো রাস্তায় ডিজিটাল সার্ভেল্যান্স ব্যবস্থা থাকবে— কোথাও কেউ প্রশ্নবাহী ডিজিটাল ট্রাংক খোলার অপচেষ্টা করলে সাথে সাথে কন্ট্রোল রুমে সংকেত চলে যাবে এবং কর্তৃপক্ষ তাত্ক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নিতে পারবেন।
এ ব্যবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং আরও কয়েকটি বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার আদলে পরীক্ষা শুরুর পাঁচ মিনিট আগে ডিজিটাল ট্রাংকের ডিজিটাল-চাবি ও পাসওয়ার্ড/পিন-নম্বর কেন্দ্র-প্রধানের কাছে দেয়া হবে। এ ক্ষেত্রে প্রশ্নপত্রের প্যাকেটগুলো আগেভাগে বিভিন্ন কক্ষের বা সাব-সেন্টারের জন্য বিন্যস্ত করা থাকবে বিধায় শুধু কক্ষে গিয়েই কক্ষের দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিদর্শক সকল পরিদর্শকের সামনে প্যাকেট খুলবেন। চতুর্থত, বিটিআরসিকে পরীক্ষার অন্তত একদিন আগে থেকে সামাজিক নেটওয়ার্কগুলো মনিটরিং-এর দায়িত্ব দিতে হবে। কেউ এ নেটওয়ার্কে সন্দেহজনক কিছু করলেই সাথে সাথে তাকে ট্র্যাক করে পাকড়াও করার ব্যবস্থা করতে হবে। এরূপ করা যে সম্ভব তা ইতোমধ্যেই অন্যান্য ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সরকারি এজেন্সিগুলো প্রমাণ করে দিয়েছেন।
পঞ্চমত, প্রশ্ন ফাঁসকারী বা প্রশ্ন ফাঁসের গুজব রটানোকারীদের অপরাধ জামিন-অযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা এবং সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান রাখা। স্মর্তব্য, কয়েক বছর আগে এসিড নিক্ষেপকারীদের ব্যাপারে এমনতরো বিধান করার কারণে এখন এ জঘন্য অপরাধ নির্মূল হয়েছে। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে কী না করা যায়! মনে রাখা জরুরি, প্রশ্ন ফাঁসকারীরা কোনো মানুষের চেহারা এসিড মেরে বিকৃত করছে না কিন্তু তারা প্রশ্ন ফাঁসের মতো জঘন্য অদৃশ্য এসিড মেরে পুরো শিক্ষাব্যবস্থার চেহারা-শরীর বিকৃত করে দিচ্ছে। সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র সরকারকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে এ ন্যক্কারজনক কাজটি করে যাচ্ছে।
একই সাথে প্রশ্ন ফাঁস রোধের লক্ষ্যে পরিকল্পিত উপায়ে জনসচেতনতা সৃষ্টি ও শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নৈতিক মান উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। অভিভাবকদেরও বুঝতে হবে যে, নিজের সন্তানদেরকে গুজবে কান দিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে দিলে কিংবা ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা দেয়ার ব্যাপারে উত্সাহ দিলে নিজের পায়ে কুড়াল মারা হবে। এতে শুধু দেশের ক্ষতিই হবে না, বিদ্যাহীন ‘শিক্ষিত’ সন্তানদের অকর্মণ্যতা পরিবারকেও ধ্বংসের মুখে টেনে নিয়ে যাবে। এরা সম্পদ হবে না, হবে একশ’ ভাগ দায়, পরিবার এবং দেশ উভয়ের জন্য।
লেখক : উপাচার্য, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়