খবরের কাগজে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারীদের ছবি দেখে দেখে এত দিনে আমাদের অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আমার মনে হয়, আমরা এখনো অভ্যস্ত হতে পারিনি।
সম্ভবত এর প্রধান কারণ হচ্ছে রোহিঙ্গা শিশু। একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ তার জীবনের সব কিছু পেছনে ফেলে হেঁটে হেঁটে অনিশ্চিত একটা জীবনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, সেই দৃশ্যটি যথেষ্ট হৃদয়বিদায়ক। তার চেয়ে শতগুণ বেশি হৃদয়বিদারক দৃশ্য একটি অবোধ শিশু যখন তার চারপাশে কী ঘটছে তার কিছুই বুঝতে না পেরে তার মা-বাবার পাশে পাশে হেঁটে হেঁটে যায়। তাদের চোখে এক ধরনের বিস্ময়, এক ধরনের অবিশ্বাস ও আতঙ্ক। সেই চোখের দৃষ্টি দেখে বিচলিত না হয়ে নিরাসক্ত দৃষ্টিতে চোখ ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। শিশুগুলো যখন খুব ছোট তখন তারা থাকে তাদের মায়ের কোলে, একটুখানি বড় হয়ে গেলে বাবার কোলে বা কাঁধে। তারা যদি হাঁটতে শেখে, তাহলে নিজেরাই বাবা কিংবা মায়ের পাশে পাশে হেঁটে হেঁটে আসে। আরেকটু বড় হয়ে গেলে অবধারিতভাবে তাদের মাথায় একটা বোঝা থাকে। এই কিশোর কিংবা কিশোরীর চোখের দৃষ্টি দেখে কেন জানি নিজের ভেতরে এক ধরনের তীব্র অপরাধবোধের জন্ম হয়। এই পৃথিবীতে কত সম্পদ, কত ঐশ্বর্য, অথচ এই রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য কিছু নেই। শুধু প্রাণটুকু বাঁচিয়ে রাখতেই তাদের পুরো জীবনীশক্তি ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে।
রোহিঙ্গা শিশুদের দেখে প্রথমেই আমার মনে হয়, এখন তাদের স্কুলে যাওয়ার কথা; কিন্তু সে কথাটি উচ্চারণ করাই মনে হয় একটা উত্কট রসিকতার মতো মনে হবে। আমাদের ছেলে-মেয়েরা এখন পরীক্ষা দিচ্ছে, পরীক্ষা শেষে অনেকেই মা-বাবার সঙ্গে বেড়াতে যাবে, আগ্রহ নিয়ে পরীক্ষার ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করবে। নতুন বছর শুরু হলে তাদের সবার হাতে নতুন বই উঠবে—সেই বই হাতে নিয়ে তাদের মুখে হাসি ফুটে উঠবে। অথচ এই রোহিঙ্গা শিশুদের ভবিষ্যৎ নিয়ে স্বপ্ন দেখার কিছু নেই। শুধু আশ্রয়শিবিরে একটি দিনের পর আরেকটি দিন বেঁচে থাকা।
শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়া পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম মহিলা যখন তাঁর মিলিটারি জেনারেলদের নিয়ে রোহিঙ্গাদের হত্যা-ধর্ষণ করে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়ে দেশছাড়া করেছিল তখন আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী দেশের মানুষদের নিয়ে তাদের আশ্রয় দিয়েছেন। সারা পৃথিবীর মানুষের সামনে ঘোষণা করেছেন, আমরা ১৬ কোটি মানুষ যদি খেতে পারি, তাহলে এই ১০ লাখ লোকও খেতে পারবে। নতুন ও পুরনো মিলিয়ে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারী এখন এ দেশের মাটিতে স্থান পেয়েছে, মাথার ওপর একটুখানি আচ্ছাদন পেয়েছে, দুই বেলা খেতে পারছে, অসুস্থ হলে চিকিত্সা পাচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা, প্রাণের ভয়ে তাদের বনের পশুর মতো বনে-জঙ্গলে ছুটে বেড়াতে হচ্ছে না। এ মুহূর্তে পৃথিবীর কত জায়গায় কত রকম যুদ্ধবিগ্রহ, কত রকম নিষ্ঠুরতা, তার ভেতরে হতদরিদ্র দুঃখী রোহিঙ্গাদের কথা পৃথিবীর মানুষের দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে পারত। কিন্তু বিস্ময়কর হলেও সত্যি, পৃথিবীর সব মানুষ এই রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচারের কথা জানে। (শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়া পৃথিবীর একজন নিষ্ঠুরতম মহিলার সম্মাননা একটি একটি করে প্রত্যাহার করে নেওয়া হচ্ছে, এর চেয়ে বড় লজ্জা আর অপমান কী হতে পারে?)
খবরের কাগজে দেখতে পাচ্ছি আলোচনা চলছে, চুক্তি হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার কথা হচ্ছে। দিনে ৩০০ করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারী প্রক্রিয়া করা সম্ভব হবে বলে দেখেছি, সেটি যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নিতে ১০ বছর সময় লাগবে! সোজা বাংলায় যার অর্থ এই রোহিঙ্গা মানুষগুলোকে আমাদের বছরের পর বছর আশ্রয় দিতে হবে।
যদি তা-ই সত্যি হয়, তাহলে এই রোহিঙ্গা শিশুদের ভবিষ্যৎ কি আমাদের একটু আলাদাভাবে দেখার প্রয়োজন নেই? আমরা আমাদের শিশুদের লেখাপড়ার ব্যবস্থা করে দেব; কিন্তু একই ভূখণ্ডে আশ্রয় নেওয়া অন্য শিশুদের লেখাপড়ার ব্যবস্থা করব না? তাদের ভবিষ্যতের কোনো স্বপ্ন থাকবে না?
আমরা যখন স্কুল-কলেজে লেখাপড়া করেছি তখন চীন দেশের কমিউনিস্ট নেতা মাও জেদংয়ের কথা খুব শুনতে পাওয়া যেত। তাঁর একটা বিখ্যাত উক্তি ছিল এ রকম—একজন মানুষ খাওয়ার জন্য একটি মুখ; কিন্তু কাজ করার জন্য দুটি হাত নিয়ে জন্মায়। আমরা কি এখন রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য সেই কথাটিই ব্যবহার করতে পারি না? তাদের মুখ একটি, হাত দুটি এবং মস্তিষ্কে নিউরন ১০০ বিলিয়ন।
দুই.
একজন মানুষকে ঘরছাড়া কিংবা দেশছাড়া করার সবচেয়ে সহজ এবং কার্যকর পদ্ধতি হচ্ছে তার বাড়িতে আগুন দিয়ে দেওয়া। শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়া পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম মহিলা ও তাঁর জেনারেলরা সেই তথ্যটি খুব ভালো করে জানে। তাই তাঁরা একটি একটি করে রোহিঙ্গা গ্রামের প্রতিটি বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে তাদের ঘরছাড়া করেছে, দেশছাড়া করেছে।
কেউ কী লক্ষ করেছে, আমার নিজের দেশের রংপুরে হিন্দুদের বেলায় হুবহু একই ব্যাপার ঘটেছে। অনেক মানুষ মিলে পুলিশের সামনে হিন্দুদের বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। এটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়ও একই প্রক্রিয়ায় একই ব্যাপার ঘটেছিল। তখন রসরাজ নামে একজন অসহায় নিরীহ মানুষকে ব্যবহার করে কাজটি করা হয়েছিল। এবার টিটু রায় নামে অন্য একজনকে বেছে নেওয়া হয়েছে। পুরো ব্যাপারটির মধ্যে এক ধরনের অচিন্তনীয় নিষ্ঠুরতা রয়েছে। অথচ অবিশ্বাসের কথা হচ্ছে, এই টিটু রায়কে দিনের পর দিন রিমান্ডের অত্যাচার সহ্য করতে হচ্ছে।
আমরা রোহিঙ্গাদের বুক পেতে গ্রহণ করেছি, অথচ হিন্দুদের বুক আগলে রক্ষা করব না—এ কেমন কথা?
তিন.
সবেমাত্র জেএসসি পরীক্ষা শেষ হয়েছে। খবরের কাগজ থেকে জানতে পেরেছি, সব পরীক্ষার সব প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। সারা দেশে যে রকম তুলকালাম কাণ্ড হওয়ার কথা ছিল তার কিছুই হয়নি। প্রশ্নপত্র ফাঁস হলে সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষাটি বাতিল হয়ে যাওয়ার কথা—একটি পরীক্ষাও বাতিল হয়নি। কাজেই ধরে নিচ্ছি, শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিষয়টি মেনে নিয়েছে। যদি শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যাওয়াটি মেনে নেয়, তাহলে ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা ও অভিভাবকরা সেটি কেন মেনে নেবেন না? সবাই মেনে নিয়েছে এবং বিষয়টা একটা উত্সবে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের শিক্ষার ইতিহাসে এর চেয়ে কালো কোনো অধ্যায় কি হওয়া সম্ভব?
জেএসসি পরীক্ষা শেষে পিইসি পরীক্ষা শুরু হয়। জেএসসি পরীক্ষায় ‘ঐতিহ্য’ ধরে রেখে এর প্রশ্নও ফাঁস হতে শুরু হয়েছে। প্রাইমারির ছেলে-মেয়েরা একেবারেই শিশু, তাদের প্রশ্ন ফাঁসে অভ্যস্ত করে দেওয়ার মতো নিষ্ঠুরতা আর কী হতে পারে? জেএসসি, এসএসসি কিংবা এইচএসসি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে যে লাগাম ছাড়া সমস্যার জন্ম হয়েছে, প্রাইমারি পরীক্ষার বেলায় সেটি একেবারেই হওয়ার কথা ছিল না। কারণ পরীক্ষাটিই হওয়ার কথা ছিল না। এ দেশের লেখাপড়া নিয়ে কথা বলা হলে যে শিক্ষানীতির কথা বলা হয়, সেই শিক্ষানীতিতে প্রাইমারি পরীক্ষাটির কথা বলা নেই। শিক্ষানীতিকে সম্মান দেখিয়ে যদি এই পরীক্ষাকে পাবলিক পরীক্ষার মতো একটি বিশাল যজ্ঞদজ্ঞতে রূপান্তর করে ফেলা না হতো, তাহলে এর প্রশ্ন ফাঁসের ব্যাপারটাই থাকত না! যদি পরীক্ষাই না থাকে, তাহলে কোন পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হবে?
এবারের পিইসি পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে সঙ্গে আমরা নতুন আরো একটি বিষয় দেখতে পেয়েছি, সেটি হচ্ছে প্রশ্নপত্রের ভুল। যাঁরা পত্রপত্রিকা পড়েন তাঁদের একজনও নেই, যাঁরা প্রশ্নের ইংরেজিটি দেখে আতঙ্কে শিউরে ওঠেননি। প্রশ্নপত্রের ভুলটি যে রকম অবিশ্বাস্য, এর প্রতিকার হিসেবে যে কাজটি করা হয়েছে সেটি আরো অবিশ্বাস্য। খুঁজে খুঁজে সেই মানুষটিকে বের করা হয়েছে, যিনি প্রশ্নপত্রটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন। এরপর তাঁকে বরখাস্ত করে দেওয়া হয়েছে। যিনি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন তাঁর ইংরেজির জ্ঞান খুব কম, তাঁর পক্ষে এর চেয়ে ভালো ইংরেজি লেখা সম্ভব নয়। তাই তিনি এ রকম একটি অনুবাদ করেছেন। এটি অন্যায় হতে পারে না, এটি হচ্ছে ব্যর্থতা। ব্যর্থতার জন্য কাউকে শাস্তি দেওয়া যায় না। যদি শাস্তি দিতেই হয়, তাহলে শাস্তি দিতে হবে এই প্রশ্ন প্রণয়ন করার দায়িত্বে থাকা কমিটিকে, তার সভাপতিকে, তার সদস্যদের। তাঁরা অনেক বড় অন্যায় করেছেন, তাঁরা এমন একজন মানুষকে প্রশ্ন অনুবাদ করার দায়িত্ব দিয়েছেন, যিনি ইংরেজি জানেন না। শুধু তা-ই নয়, ইংরেজিতে অনুবাদ করার পর সেই কমিটি প্রশ্নপত্রটিতে চোখ বোলানো প্রয়োজন মনে করেনি কিংবা চোখ বুলিয়ে ভুল ইংরেজি দেখার পরও সেটি সংশোধন করা দরকার মনে করেনি।
একটি বিশাল বিপর্যয় ঘটবে। যারা সেই বিপর্যয়টি ঘটাবে তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকবে, খুঁজে পেতে সবচেয়ে নিরীহ ও ক্ষুদ্র মানুষটিকে বের করে তাঁকে শাস্তি দিয়ে সবাই আনন্দে বগল বাজাতে থাকবে—এটি কেমন কথা? একজন মানুষ ইংরেজি না জানলে তাঁকে শাস্তি দেওয়া যায় না। যিনি তাঁকে দিয়ে ইংরেজি অনুবাদ করিয়েছেন, খুঁজে বের করে প্রয়োজন হলে তাঁকে শাস্তি দিতে হবে!
সবচেয়ে বড় কথা, একটা বিপর্যয় ঘটে যাওয়ার পর কাউকে খুঁজে বের করে তাঁকে শাস্তি দিয়ে কোনো লাভ নেই, বিপর্যয় না ঘটলে অনেক বড় লাভ হয় এই সহজ কথাটি কেউ কেন বুঝতে পারছে না?
চার.
সাম্প্রতিক ঘটনার মধ্যে আমার কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে যে ঘটনাটি সেটি হচ্ছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের একটি ঘোষণা। সেটি হচ্ছে তারা এখন স্কুলে স্কুলে ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণা করবে। নিজের কানে শুনেও আমি কথাটি বিশ্বাস করতে পারছি না। বর্তমান ছাত্রলীগ কি আমাকে সারা দেশে একটি ঘটনার কথা বলতে পারবে, যেটি দেখে আমরা সিদ্ধান্ত নেব যে আমার স্কুলপড়ুয়া সন্তানকে ছাত্রলীগের সদস্য করে দিতে হবে? যদি না পারে, তাহলে তাদের এই সর্বনাশা প্রজেক্টে হাত দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।
লেখক : অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও
প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট