প্রাথমিক শিক্ষকদের অনশন: প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি - Dainikshiksha

প্রাথমিক শিক্ষকদের অনশন: প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি

মো. সিদ্দিকুর রহমান |

মানুষের জীবনে প্রত্যাশা থাকা স্বাভাবিক। প্রত্যাশার মাঝে তারা বেঁচে থাকে। যৌক্তিক প্রত্যাশা পূরণে অস্বাভাবিক বিলম্ব হলে ক্ষোভ ও হতাশার সৃষ্টি হয়। পেশাজীবী হিসেবে প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রত্যাশা হওয়ার কথা বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোর সাথে সামঞ্জস্য রেখে মর্যাদা ও বেতন প্রাপ্তি। অথচ স্বাধীনতার দীর্ঘ সময় পরে তাদের ভাগ্যে ঝুলে আছে মর্যদাহীন বৈষম্যের লিখন। স্বাধীন হলেও পাকিস্তানী অনুচররা আজও শিক্ষাক্ষেত্রে চরম বৈষম্য সৃষ্টি করে রেখেছে। দীর্ঘদিন সময় বৈষম্য থেকে প্রাথমিক শিক্ষকরা দলে দলে আমরন অনশনে যোগ দেয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিশ্বাসী সরকার হলেও বঙ্গবন্ধুর মতো শিক্ষা জাতির উন্নতি মুল সোপান বাস্তবতাটি উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়নি।

দীর্ঘ ৩ বছর যাবৎ আশ্বাসে আশ্বাসে প্রক্রিয়াধীন বলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় বিষয়টিকে গুরুত্বহীন মানষিকতায় সময়ক্ষেপন করে চলেছে। এতে সংশ্লিষ্টরা প্রাথমিকের সহকারীদের কাছে অনেকটা বিশ্বাস যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে। তারা পেরেছে প্রধান ও সহকারীদের মধ্যে চরম দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করতে। শিক্ষকেরা সর্বমহলে সম্মানের পাত্র। শিক্ষাবান্ধব সরকার তাদের ৩য়/২য় শ্রেণির মর্যাদা দিয়ে হেয়-প্রতিপন্ন আসছে। যেখানে সকল শিক্ষক থাকবে ১ম শ্রেণির মর্যাদা। যথাযথ মর্যাদা ও বেতন না দিয়ে স্কেলের চরম বৈষম্যে প্রাথমিক শিক্ষকদের সকল সংগঠনকে ঐক্যবদ্ধভাবে শহীদ মিনারে আসতে বাধ্য করেছে। নেতৃবৃন্দের মাঝে হিংসা, নিজেদের অস্তিত্ব জাহির করা প্রবণতা দেখা গেলেও সকল শিক্ষকদের মাঝে বৈষম্য নিরসণের সংগ্রামের ঐক্যবদ্ধ ভুমিকা পরিলক্ষিত হয়। এ আন্দোলনে প্রশাসনের দালালরা তেমন ভুমিকা রাখতে পারেননি। সহকারী শিক্ষকদের এ বৈষম্যের চ্যালেঞ্জ নেতৃবৃন্দের অনঐক্য।

এ প্রসঙ্গে ১৯৭৭ সালের একটা ঘটনা কথা মনে পড়ছে। তখন মরহুম মির্জা গোলাম হাফিজ ছিল একাধারে জাতীয় সংসদের স্পিকার ও ঢাকার মতিঝিল, সবুজবাগ ও খিলগাঁও থানার ঢাকা-৬ এর জাতীয় সংসদের সদস্য। তখন সারা দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নাজুক অবস্থা। বিদ্যালয়ের বার্ষিক কন্টিজেন্সি ছিল সর্বমোট ২৪ টাকা। ১৫জন ওয়ার্ড কমিশনার ও তৎকালীন জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শক, ঢাকা মরহুম আজিজুল হক প্রাথমিক শিক্ষক প্রতিনিধি হিসেবে আমি স্পিকার মহোদয়ের কক্ষে এলাকার প্রাথমিক শিক্ষার সমস্যা নিয়ে আলোচনা সভায় উপস্থিত ছিলাম। তৎকালীন ওয়ার্ড কমিশনারবৃন্দ বিদ্যালয়ের আনুসাঙ্গিক খরচের টাকা মাসে ২ টাকা দেওয়ার জন্য জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শক, ঢাকাকে চরমভাবে নাস্তানাবুদ করেন। বিদ্যালয় পরিদর্শক মহোদয় তার বক্তব্য সিনেমার একটা গানের কলি দিয় শুরু করেন, “আমরা পুতুল, যেমনে নাচায় তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ”। তার মানে সরকার ২টা টাকা বরাদ্দ দেয়।

আমরা তা দেই। এখানে সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে আমার অপরাধ কোথায়? প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকদের মাঝে তফাৎ ছিল ১-৭-৭৩ থেকে ১০ টাকা দায়িত্ব ভাতা। এস্বল্প দায়িত্বভাতা নিয়ে আমার ১৯৭৫ সনে দৈনিক ইত্তেফাকে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া প্রকাশিত হয়। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমনের সময়ে শুরু হয় বৈষম্যের ১ম ধাপ। প্রধান শিক্ষক ৩২৫ টাকা, সহকারী শিক্ষক ৩০০ টাকা। প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার আমলে ২০০৬ সালে প্রাথমিকের ননট্রেইন্ড শিক্ষকেরা এম.এল.এস.এসের স্কেল থেকে মুক্তি পেলেও সহকারীদের বেতনের বৈষম্য বেড়েছে ২য় বার। সে আন্দোলনে আমাকে জেলে যেতে হলেও প্রাথমিক শিক্ষকেরা কাঙ্খিত স্কেল পায়নি।

বর্তমান সরকারের আমলে বৈষম্য বেড়েছে ৩য় বার। আমাদের সময়ে সরকারসহ সংশ্লিষ্টরা বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে ভীত ছিল। গভর্ণর মোনায়েম খানের আমলে বঙ্গভবন ঘেরাও করে ১ম স্কেল আদায় করে পূর্ব পাকিস্তান প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি। বঙ্গবন্ধু শিক্ষা ও শিক্ষকদের প্রতি ভালোবাসায় নিদর্শনস্বরুপ ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে ১ম প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ করেন। বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে শিক্ষকদের থানার বাইরে বদলীরোধ, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের প্রাথমিক শিক্ষা সময়ে বেসরকারিকরণের প্রতিবাদে প্রাথমিক শিক্ষকেরা ১জন সাথী নিয়ে ৩ লক্ষ শিক্ষকের ঢাকা অবরোধ, ঐতিহাসিক মহাসমাবেশে বৃষ্টিতে কাঁদা পানিতে বসে ওসমানী উদ্যানসহ পাকশীতে প্রেসিডেন্ট এরশাদ তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, সমাবেশ-মহাসমাবেশ কাকে বলে আপনাদের নেতা আযাদ আমাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়ে দিলেন।

সরকারী কর্মচারী টাইমস্কেল, ঈদ বোনাস, সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ন কল্যাণ ট্রাস্ট, পৌষ্য কোটা, উপজেলার সরকারি নিয়ন্ত্রণমুক্ত, বেসরকারী চাকুরী ৫০% গণনা করা, বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্রাক বিরোধী আন্দোলনসহ অসংখ্য অর্জন। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় গড়ে উঠেছে অসংখ্য প্রাথমিকের সংগঠন। সহকারী শিক্ষকদের এ বৈষম্য নিরসণে তাদের আন্তরিকতা প্রশ্নবদ্ধ। সকল বৈষম্যের জন্য দায়ী সরকারের সংশ্লিষ্টরা। এখানে প্রধান শিক্ষকদের দোষারূপ করা নেতৃত্বের বিচক্ষণতার লক্ষণ নয়। সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসারদের বেতন বাড়লে প্রধান শিক্ষকদের বাড়ানোর দাবী করা যায়। আর প্রধান শিক্ষকদের বেতন বাড়লে সহকারীদের দাবী করা যৌক্তিকতা খুঁজে পায়।

আজকে প্রাথমিকে প্রধান শিক্ষকদের বেতন দশম গ্রেডে যাওয়ায় সহকারীরা নিচের স্কেল দাবী যৌক্তিক। প্রধান শিক্ষকদের ১০ম গ্রেডের দাবী আপাতত স্থগিত ঘোষণার দাবি নিছক নেতৃত্বের মানসিকতা। আমরা শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দেই বড়দের শ্রদ্ধা করিও। শ্রদ্ধার মাধ্যমে বড়রা ছোটদের ভালবাসা, ¯েœহ ও মমতা না করলেও এ শ্রদ্ধা তাদের মনে পরিবর্তন আনতে বাধ্য। আজকে শিশুরা যেমন আগামী দিনে অনেক বড় হবে, তেমনি সহকারীরাও আগামী দিনে প্রধান হবে। আজকের দিনে প্রাথমিক শিক্ষক পরিবারের সংশ্লিষ্টদের সৃষ্টি এ বৈষম্যের দায়ে নিজদের মধ্যে হিংসা বিদ্বেষ মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা ব্যহত করবে। পরিবারের মাঝে শান্তি না থাকলে সবই অন্ধকার। আসুন আমরা প্রধান, সহকারী সকলে একই পরিবারের সদস্য হিসেবে হাতে হাত রেখে নিজেদের অধিকার, নাস্ত পাওনা আদায়ে এগিয়ে যাই।

মাননীয় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী ২৫-১২-২০১৭ তারিখে তার বক্তব্যে বলেছিলেন আন্দোলন করে দাবী আদায় করা যায় না। দাবি আদায়ের পথ হলো আলাপ আলোচনা, অথচ ২৬-১২-২০১৭ তারিখে মন্ত্রী মহোদয় নিজেই স্বীকার করেছেন, এ অনশন সারাদেশে সকল মহলে সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়েছে। বিগত ৩ বছরে মন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের মাঝে আলোচনা সবই যেন শুভঙ্করের ফাঁকি। দীর্ঘ সময় আলোচনার পরও প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে নতুন করে বৈষম্যের বিষয়টি বুঝাতে হবে।

প্রাথমিকের এ আন্দোলন সর্বমহল বুঝে সাড়া জাগাতে পারলেও শিক্ষাবান্ধব সরকারের মন্ত্রণালয়কে নতুন করে বুঝাতে হবে বিষয়টি রহস্যজনক। প্রধান শিক্ষকদের ১০ম গ্রেড স্থগিতের প্রস্তাব সংশ্লিষ্টদের ঘৃণ্য চক্রান্ত। প্রধান সহকারীদের দ্বন্দ্বে রেখে নেতৃবৃন্দকে মাথায় হাত বুলিয়ে সাময়িক পার পাওয়া যাবে। শিক্ষকদের ক্ষোভ ও হতাশা মাননীয় মন্ত্রী, সচিব ও মহাপরিচালক মহোদয়সহ গণমাধ্যমের সাংবাদিকরাসহ সকলে প্রত্যক্ষ করেছেন। সহকারীদের বৈষম্য নিশ্চিত। সময়ক্ষেপন করে, প্রধান সহকারীদের দ্বন্দ্বে ঠেলে দিলে, সে ষড়যন্ত্রে প্রাথমিক শিক্ষা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সর্বপ্রথম প্রাথমিকের মাত্র ৩টি সহকারী সংগঠন ২৩ ডিসেম্বর অনশনের ডাক দিয়েছেন।

সাথে সাথে প্রাথমিক শিক্ষক অধিকার সুরক্ষা ফোরাম সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে কর্মসূচি সফলের আহ্বান জানান। নেতৃত্বের মান অভিমানের সত্ত্বেও শিক্ষকদের প্রাণের যৌক্তিক দাবির প্রতি সারা দেশের শিক্ষকদের কর্মসূচি সফল করার জন্য এগিয়ে আসেন। ঐক্যবদ্ধভাবে হিংসা বিদ্বেষ ভূলে শিক্ষকদের যৌক্তিক দাবির প্রতি আন্তরিক না হলে ২১ ফেব্রুয়ারির শহীদ মিনারের ফুলের মত শুকিয়ে ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে যাবে তাদের নেতৃত্বের শক্তি।

শিক্ষকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম জোরদার হোক। এই প্রতাশায়।

মো. সিদ্দিকুর রহমান: আহবায়ক, প্রাথমিক শিক্ষক অধিকার সুরক্ষা ফোরাম ও দৈনিক শিক্ষার সম্পাদকীয় উপদেষ্টা।

প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ জুনের মধ্যে: প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ জুনের মধ্যে: প্রতিমন্ত্রী পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের - dainik shiksha পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের ঝরে পড়াদের ক্লাসে ফেরাতে কাজ করছে সরকার - dainik shiksha ঝরে পড়াদের ক্লাসে ফেরাতে কাজ করছে সরকার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি, ভাইবোন গ্রেফতার - dainik shiksha প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি, ভাইবোন গ্রেফতার ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি - dainik shiksha ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন প্রায় শূন্যের কোটায় - dainik shiksha শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন প্রায় শূন্যের কোটায় ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে - dainik shiksha ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0039310455322266