দেশে প্রায় সব দিবস সরকারিভাবে পালিত হলেও বিশ্ব শিক্ষক দিবস সরকারিভাবে পালন করা হয় না। গভীর ক্ষোভ ও দুঃখের সঙ্গে শিক্ষক সংগঠনগুলো এবং কতিপয় এনজিও দিবসটি যথাযথভাবে পালন করে যাচ্ছে। এ বছর বিশ্ব শিক্ষক দিবসের প্রতিপাদ্য- শিক্ষকদের স্বাধীনভাবে পড়ানোর ক্ষমতা ও ক্ষমতাবান হওয়া।
প্রতিপাদ্যটি যথাযথ কার্যকর করার প্রয়াসে সর্বাগ্রে প্রয়োজন শিক্ষকদের আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তোলা। শিক্ষকদের জ্ঞানের ভাণ্ডার থাকবে সমৃদ্ধ। মর্যাদা ও বেতন স্কেল থাকবে উচ্চ স্তরে, যাতে শিক্ষককে কোনো কিছুর জন্য কারও মুখাপেক্ষী হতে না হয়। শিক্ষার্থীর সঙ্গে শিক্ষকের সম্পর্ক থাকবে বন্ধু, দার্শনিক ও পথপ্রদর্শকের মতো। প্রভুর ভূমিকায় কোনো শিক্ষক-কর্মকর্তার প্রভাব পরিলক্ষিত হবে না। ইউনেস্কোর নির্দেশনা মোতাবেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত সব কমিটির প্রধান থাকবেন শিক্ষক।
বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মূল কর্তৃত্ব থাকে শিক্ষাদানের কাজে জড়িত নয় এমন ব্যক্তিদের হাতে। যাদের কারও কারও শিক্ষাগত যোগ্যতা যথেষ্ট নয়। শিক্ষক নিয়োগ, বিভিন্ন কাজের টেন্ডারসহ বেশিরভাগ কাজ রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ছত্রছায়ায় অনুষ্ঠিত হওয়ায় প্রতিষ্ঠানগুলো অনেকটা প্রভাবশালীদের মিনি-অফিসে পরিণত হয়েছে। যখন যারা ক্ষমতায় আসে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো তাদের দখলে চলে যায়।
এমপিও, নন-এমপিও, বাড়িভাড়া, উৎসব বোনাস ও বৈশাখী ভাতা প্রদানে বৈষম্য দূর করে সব বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করার মাধ্যমে বিশ্ব শিক্ষক দিবসের প্রতিপাদ্য কার্যকর করা প্রয়োজন। তা না হলে শিক্ষকদের স্বাধীনভাবে পাঠদান অনেকটা স্বপ্নের মতো থেকে যাবে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে কমিটিসহ শিক্ষকদের অনেকটা কর্তার নির্দেশে কর্ম করতে হয়। বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির অনেক সুপারিশ বা সিদ্ধান্ত শুধু কাগজে-কলমের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে।
প্রাথমিক শিক্ষকদের স্বাধীনভাবে পাঠদানের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয় পাঠদানবহির্ভূত কাজে। বিদ্যালয়গুলো শিক্ষক সংকটে হাবুডুবু খেলেও উপজেলা বা থানা শিক্ষা অফিসের কাজে শিক্ষকদের সারা বছর নিয়োজিত থাকতে হয়। এর একটা বাস্তব উদাহরণ উপস্থাপন করছি। ঢাকা শহরের মতিঝিল শিক্ষা থানার খিলগাঁও গভ. কলোনি, আহম্মদবাগ, কমলাপুর ও মতিঝিল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ বেশকিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তীব্র শিক্ষক সংকটে পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে। সেখানে সারা বছর অফিসকে শিক্ষকদের নানা কাজের কর্মস্থলে পরিণত করা হয়েছে।
২৩টি বিদ্যালয়ে শিক্ষক সংখ্যা ২৮০। অফিস সহকারী ৪ জন, সহকারী থানা শিক্ষা কর্মকর্তা ২ জন। অথচ অফিসের সার্বক্ষণিক কাজে খিলগাঁও স্টাফ কোয়ার্টার প্রাথমিক বিদ্যালয় ২ জন অভিজ্ঞ শিক্ষককে নিয়োজিত করা হয়। থানা শিক্ষা কর্মকর্তার এহেন কর্মকাণ্ডে বিদ্যালয়টি ধ্বংসের পথে। সমাপনী পরীক্ষার কর্মযজ্ঞ ছাড়াও চার-পাঁচজন শিক্ষক বিদ্যালয়ের দায়িত্ব পালন না করে নানা অফিসিয়াল কাজে থাকেন। সমাপনী পরীক্ষার সময় শিক্ষকদের পদচারণায় শিক্ষা অফিসগুলো হয়ে ওঠে কানায় কানায় পূর্ণ। বিদ্যালয়গুলো হয়ে যায় শিক্ষকশূন্য। অগণিত পাঠদানবহির্ভূত কাজের যন্ত্রণায় শিক্ষকরা প্রায় ভুলে যেতে বসেছেন যে পাঠদানই তাদের মুখ্য কাজ। অনেকটা প্রভু-ভৃত্যের মতো প্রাথমিক শিক্ষকরা কর্মকর্তাদের নির্দেশ তামিল করতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন।
বিশ্ব শিক্ষক দিবস সরকারিভাবে পালিত না হওয়ায় সরকারের সংশ্লিষ্টদের কাছে এ দিবসের তেমন কোনো তাৎপর্য নেই। অন্যান্য দেশের মতো শিক্ষকদের নিয়ে তেমন কার্যকর কোনো ভাবনা সরকারের কাজে দৃশ্যমান নয়। শিক্ষকরা পাঠদানে স্বাধীন ও ক্ষমতাবান হলে অধিকার সম্পর্কে সজাগ হবেন। বিশ্ব শিক্ষক দিবসের প্রতিপাদ্য বাস্তবে কার্যকর হবে।
মো. সিদ্দিকুর রহমান: আহবায়ক, প্রাথমিক শিক্ষক অধিকার সুরক্ষা ফোরাম ও দৈনিক শিক্ষার সম্পাদকীয় উপদেষ্টা।