প্রাথমিক শিক্ষা ও মূল্যবোধের ধারণা - দৈনিকশিক্ষা

প্রাথমিক শিক্ষা ও মূল্যবোধের ধারণা

জাকির আহমদ খান কামাল |

মানুষের মৌলিক বিশ্বাস, সামাজিক রীতিনীতি ও আচার-আচরণের সমষ্টিকেই মূল্যবোধ বলে।

মূল্যবোধ এমন একটি মানদণ্ড যা ভালো-মন্দ নির্ধারণের মাধ্যমে মানুষের আচরণকে সঠিক পথে পরিচালিত করে। মানুষের সামাজিক সম্পর্ক ও আচার-আচরণ প্রত্যক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণের জন্য সব সমাজেই বিভিন্ন ধরনের বিধিনিষেধ প্রচলিত থাকে। এ সব বিধিনিষেধ অর্থাৎ ভালো-মন্দ, ঠিক-বেঠিক সম্পর্কে সমাজের সদস্যদের যে ধারণা তাই হলো মূল্যবোধ। মূল্যবোধ মানুষের জীবনে ঐক্য ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, সামাজিক জীবনকে সুদৃঢ় করা এবং সমাজের মধ্যে যথার্থ সম্পর্ক বিনির্মাণে অবদান রাখে।সামাজিক জীবনে নৈতিকতা, মানবিকতা, ধর্মীয় মূল্যবোধ, সাংস্কৃতিক চিন্তাধারা ও সামাজিক মূল্যবোধকে উজ্জীবিত করার মূল হাতিয়ার হলো শিক্ষা। আর প্রাথমিক শিক্ষা হলো পরবর্তী সকল শিক্ষার মূল ভিত।

১৯৭০-এর ৭ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক নির্বাচনের আগে এক টেলিভিশন ভাষণে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘সুষ্ঠু সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য শিক্ষা খাতে পুঁজি বিনিয়োগের চেয়ে উৎকৃষ্ট বিনিয়োগ আর কিছু হতে পারে না।’ যার প্রতিফলন হলো সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে রচিত সংবিধানের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি অংশে শিক্ষাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে চিহ্নিত করে প্রাথমিক শিক্ষাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করা হয়। প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব বিবেচনা করেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ খিষ্টাব্দে ৩৬ হাজার ১৬৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করে প্রাথমিক শিক্ষার অগ্রযাত্রার শুভ সূচনা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪-এ দেশে প্রথম শিক্ষা কমিশন গঠন করেন এবং এর পরপরই প্রাথমিক শিক্ষা প্রসারে জোর দেয়া হয়।তারই ধারাবাহিকতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় ‘জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০’ প্রণীত হয়। প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে বছরের প্রথম দিনে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেয়া, শতভাগ উপবৃত্তি কার্যক্রম, অনগ্রসর এলাকায় স্কুল ফিডিং চালু, সরকারি বিদ্যালয়ে দপ্তরি কাম নৈশ প্রহরী নিয়োগ, খুদে ডাক্তার, স্টুডেন্ট কাউন্সিল গঠন, ই-মনিটরিংয়ের মাধ্যমে বিদ্যালয় পরিদর্শন ইত্যাদি। 

প্রাথমিক শিক্ষায় সমতায়নের লক্ষ্যে  ২০১৩ খিষ্টাব্দে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৬ হাজার ১৯৩টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করেন। এর পাশাপাশি প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে ও আধুনিকীকরণে বিভিন্ন বাস্তবমুখী ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। শিক্ষার্থী ভর্তি, শ্রেণির পাঠদান কার্যক্রমে ডিজিটালাইজেশনের ব্যবহার শুরু হয়েছে। শতভাগ শিশুর বিদ্যালয়ে ভর্তি নিশ্চিত করা, ঝরে পড়ার হার প্রায় শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসা, ছাত্র ও ছাত্রীদের মধ্যে সমতা আনা, নতুন শিক্ষাক্রমে নতুন পাঠ্যবই ছাপানো, প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা চালু, অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ নানা ক্ষেত্রেই অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয়েছে। প্রাইমারি এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম-৪, জিপিএস, এনএনজিপিএস প্রজেক্টের মাধ্যমে দৃষ্টিনন্দন প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন, ওয়াস ব্লক, বাউন্ডারি ওয়াল নির্মাণ ও নিরাপদ খাবার পানির উৎস স্থাপনসহ ব্যাপক ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়ন কার্যক্রম চলমান। শিক্ষার প্রসারে এখন লক্ষ দিতে হবে শিক্ষার গুণগত মানের উন্নয়নের দিকে। ভৌত অবকাঠামোগত সুবিধার পাশাপাশি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো যোগ্য, দক্ষ ও পেশাদারি মনোভাবাপন্ন শিক্ষক। নিবেদিতপ্রাণ দক্ষ শিক্ষকেরাই পারেন আজকের শিশুশিক্ষার্থীদের আগামীর যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে, যারা ভবিষ্যতে এ দেশের নেতৃত্ব দেবে। 

রূপকল্প ২০৪১ এবং জাতিসংঘ ঘোষনাতেও বলা হয়েছে নিবেদিতপ্রাণ দক্ষ শিক্ষকেরাই পারেন আজকের শিশুশিক্ষার্থীদের আগামীর যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে, যাদের নেতৃত্বেই ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’ বাস্তবায়নের জন্য মানবসম্পদ উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই। ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’-এর প্রাথমিক শিক্ষা-সংক্রান্ত লক্ষ্য হলো ২০৩০-এর মধ্যে দেশের সব শিশুর মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা, যা অর্জনে বাংলাদেশ দৃঢ় অঙ্গীকারাবদ্ধ। সেইসঙ্গে সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সম্পৃক্ততা, সম্মিলিত উদ্যোগ ও সমন্বিত প্রয়াস বাড়াতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থা হলো তিন চাকা বিশিষ্ট একটি বাহন। শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং অভিভাবক হলেন এর অংশীজন। যেখানে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ চাকাটি হলো শিক্ষক। সুতরাং, শিক্ষার উন্নয়নের মূলে রয়েছেন শিক্ষক সমাজ। পেশাগত সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে এবং শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া আধুনিকীকরণ করে অধিকতর শিক্ষাগত যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থীদের নিয়োগ প্রদান করা প্রয়োজন।

শিক্ষকদের চাকরির শুরুতেই দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পাঠদানে দক্ষ করার ব্যবস্থা নেয়াও জরুরি। প্রত্যেক শিক্ষক ও বিদ্যালয়ের কর্মদক্ষতার মান পরিমাপ করে জবাবদিহির আওতায় আনা যেমন জরুরি, তেমনি কর্মদক্ষতার ভিত্তিতে পুরস্কৃত করার ব্যবস্থাও থাকা দরকার। সরকার এ ক্ষেত্রে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বর্তমান সরকার শিক্ষার মানোন্নয়নে যে কয়েকটি অসাধারণ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে তার একটি হলো প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের পদটি দ্বিতীয় শ্রেণিতে উন্নীতকরণ। সহকারী শিক্ষকদের বেতন স্কেলও এক ধাপ উন্নীত করা হয়েছে। বর্তমানে প্রধান শিক্ষকদের বেতন গ্রেড ১১ এবং সহকারী শিক্ষকদের বেতন গ্রেড ১৩। এ ছাড়া, ৩৪তম বিসিএস চূড়ান্ত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে যারা ক্যাডার পাননি, তাদের মধ্য থেকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে দ্বিতীয় শ্রেণির নন-ক্যাডার পদমর্যাদায় নিয়োগ করা হয়েছে। শিক্ষার মানোন্নয়ন ও গুণগত শিক্ষার ধারা নিশ্চিত করতে এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। তবে গ্রেড এবং মানের দিক থেকে আমাদের মতো পার্শবর্তী উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় অনেক নিম্নগামী যা দিয়ে উচ্চ শিক্ষিত গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষক ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না।

প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়ন নিশ্চিত করতে সরকার পর্যায়ক্রমে বিপুলসংখ্যক উচ্চশিক্ষিত শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছে। দক্ষ জনসম্পদ গঠন, জাতীয় উন্নয়ন, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন এবং গতিশীল ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনে গুণগত শিক্ষার বিকল্প নেই। কিন্তু বাস্তবতা হলো অন্য কোনো বিভাগে আরো নিম্ন গ্রেড বা মানের চাকরি হলে তারা নিঃসংকোচে চলে যান।২০৪১ খিষ্টাব্দের উন্নত বাংলাদেশ ও বিশ্বের চাহিদা মাথায় রেখে আধুনিক প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণে দক্ষ শিক্ষক তৈরি করতে প্রশিক্ষণেরও বিকল্প নেই। শিক্ষক প্রশিক্ষণের মানও ইতোমধ্যে বৃদ্ধি পেয়েছে। শিক্ষকদের পর্যায়ক্রমে দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্পমেয়াদি বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ, নিড বেজড সাব ক্লাস্টার প্রশিক্ষণ, আইসিটি প্রশিক্ষণ, প্রধান শিক্ষকদের বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা প্রশিক্ষণ ও ইংরেজি বিষয়ে দক্ষ করতে সরকারি অর্থায়নে ব্রিটিশ কাউন্সিল কর্তৃক মাস্টার ট্রেইনার প্রশিক্ষকসহ নানাবিধ প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। এ ছাড়া, বিদ্যালয় পরিদর্শনকারী কর্মকর্তা ও প্রশিক্ষকদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। এসব প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা শ্রেণি পাঠদানে যথাযথভাবে প্রয়োগ শিক্ষার্থীর মূল্যবোধকে শাণিত করতে পারে। যদিও বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশাপাশি অন্য ব্যবস্থাগুলো হলো- ইংরেজি মাধ্যম প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাদ্রাসাভিত্তিক ইবতেদায়ি শিক্ষাব্যবস্থা, এনজিও পরিচালিত প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা, বেসরকারি ও প্রি-ক্যাডেট প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা। 

এসব শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে মূল্যবোধের যেমন পার্থক্য রয়েছে তেমনি সমন্বয়হীনতাও রয়েছে যা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে নজরদারির আওতায় আনা জরুরি। বিশেষ করে করোনাকালীন শিক্ষা শূন্যতায় নিয়ন্ত্রণহীনভাবে কওমি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা প্রাথমিক শিক্ষায় শুভকর মনে হচ্ছে না। সুশিক্ষা ভালো-মন্দ বিচার করতে শিখায়। এই ভালো-মন্দের বিচার মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করেই গড়ে ওঠে। মূল্যবোধের অনুপস্থিতিতে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, পরিবেশ ও রাজনীতিসহ সর্বত্র মানবজীবন ব্যবস্থা হয়ে উঠে অস্থিতিশীল। একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীকে মূল্যবোধে উজ্জীবিত করে সমাজকে করতে পারে আলোকিত ও উদ্ভাসিত।

লেখক : জাকির আহমদ খান কামাল, প্রধান শিক্ষক, পূর্বধলা মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় 

 

 

শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস - dainik shiksha শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল - dainik shiksha সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0032939910888672