প্রাথমিক ও অষ্টম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষা নিয়ে উল্টোপথে হাঁটছে মন্ত্রণালয়। প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখায় প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী ও জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেটের (জেএসসি) মতো কোনো পরীক্ষা রাখা হয়নি। রূপরেখায় দশম শ্রেণিতে গিয়ে পাবলিক পরীক্ষা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করা হলে পাবলিক পরীক্ষা একেবারে কমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধারাবাহিক মূল্যায়ন বেশি হবে। আবার পিইসি পরীক্ষা শিক্ষার্থীদের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করায় তা বাদ দিতে দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছেন শিক্ষাবিদসহ শিক্ষা নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো।
কিন্তু প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় কেবল এসব উপেক্ষাই করছে না, তারা উল্টো এখন প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা স্থায়ীভাবে নেওয়ার জন্য মাধ্যমিকের মতো ‘প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ড’ স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। এই বোর্ডের অন্যতম কাজই হবে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী ব্যবস্থাপনার যাবতীয় কাজ করা।
বোর্ড গঠন করতে প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ড আইন, ২০২১-এর খসড়াও করেছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। খসড়ার বিষয়ে মতামত দিতে তা গতকাল রোববার প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। খসড়ার বিষয়ে কারও কোনো মতামত বা সুপারিশ থাকলে তা ২৫ নভেম্বরের মধ্যে দিতে বলেছে মন্ত্রণালয়।
২০০৯ সাল থেকে পিইসি পরীক্ষা নেওয়া শুরু করে সরকার। মাদ্রাসার সমমানের শিক্ষার্থীদের জন্যও ইবতেদায়ি শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা চালু করা হয়। এখন প্রায় ৩০ লাখ শিক্ষার্থী এসব পরীক্ষায় অংশ নেয়। বর্তমানে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অধীনে এই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। যদিও করোনার সংক্রমণের কারণে গত বছর এই পরীক্ষা হয়নি। চলতি বছরও এই পরীক্ষা হচ্ছে না।
শিক্ষাবিদেরা বলে আসছেন, পিইসি পরীক্ষা শিক্ষার্থীদের মুখস্থনির্ভরতা, গাইড বই অনুসরণ ও কোচিং–বাণিজ্যের প্রসার ঘটিয়েছে।
শিক্ষা নিয়ে কাজ করা এনজিওগুলোর গবেষণায় দেখা গেছে, প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য দেশের ৮৬ শতাংশের বেশি বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের কোচিং করতে হয়। আবার ৭৮ শতাংশ সরকারি বিদ্যালয়ে এই পরীক্ষার জন্য কোচিং ছিল বাধ্যতামূলক। এ ছাড়া এই পরীক্ষার জন্য প্রাইভেট পড়ার ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ছে। পাঠ্যবইকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে গাইড বই।
সরকারের করা জাতীয় শিক্ষানীতিতেও পঞ্চম শ্রেণিতে জাতীয়ভাবে পরীক্ষা নেওয়ার কথা নেই। ২০১০ সালে করা জাতীয় শিক্ষানীতিতে বলা আছে, পঞ্চম শ্রেণি শেষে উপজেলা, পৌরসভা বা থানা পর্যায়ে সবার জন্য অভিন্ন প্রশ্নপত্রে সমাপনী পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু নিজেদের করা শিক্ষানীতিই ঠিকমতো বাস্তবায়ন করেনি সরকার। এখন প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ড করার মাধ্যমে পিইসি পরীক্ষাকে আরও দীর্ঘ মেয়াদে রাখার পরিকল্পনাই প্রকাশ পাচ্ছে।
আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, এই আইন প্রবর্তনের পর গেজেট আকারে প্রজ্ঞাপন দিয়ে সরকার প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ড আইন স্থাপন করতে পারবে। এই বোর্ডে একজন চেয়ারম্যান থাকবেন। এ ছাড়া অন্যান্য সদস্য থাকবেন।
বোর্ড যেসব কাজ করবে, তার মধ্যে রয়েছে পিইসি পরীক্ষা ব্যবস্থাপনার যাবতীয় কাজ। এসব কাজের মধ্যে রয়েছে পরীক্ষাকেন্দ্র ও ভেন্যু অনুমোদন, বিজি প্রেসে প্রশ্নপত্রের চাহিদা পাঠানো ও মুদ্রণ, পরীক্ষা গ্রহণ, মূল্যায়নের ফলাফল প্রকাশ, ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে বৃত্তির ফল ঘোষণা, কৃতকার্য শিক্ষার্থীদের সনদ প্রদান ইত্যাদি। এ ছাড়া প্রাথমিক শিক্ষায় সুষ্ঠু মূল্যায়নের ব্যবস্থা গড়ে তুলতে নীতি, পরিকল্পনা, গাইডলাইন প্রণয়ন ইত্যাদি কাজের কথা রয়েছে আইনের খসড়ায়।
প্রাথমিকে শিক্ষা বোর্ড করার কারণ জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন বলেন, যেহেতু পরীক্ষা হচ্ছে, প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করতে হয়, যা বোর্ডের কাজ, সে জন্য বোর্ড করতে চাইছেন তাঁরা। কারণ, প্রাথমিক স্তরে পিইসি পরীক্ষাসহ নানান পরীক্ষা আছে।
জাকির হোসেন আরও বলেন, ‘বোর্ড করা দরকার, তাই করতে হচ্ছে। এখন তার সুফল-কুফল নিয়ে লেখালেখি হলে জাতি যদি না চায়, তখন তা পরিবর্তনও হতে পারে।’
খসড়ায় বলা হয়েছে, প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ড প্রতিষ্ঠিত হওয়া সত্ত্বেও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মাধ্যমে হওয়া শিক্ষার্থী মূল্যায়ন, পিইসি পরীক্ষায় সরকারের গৃহীত সব কাজ এই আইনের আওতায় গৃহীত বলে গণ্য হবে।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বোর্ড করে পিইসি পরীক্ষা নেওয়ার উদ্যোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ও জাতীয় শিক্ষাক্রম, উন্নয়ন, পরিমার্জন কোর কমিটির সদস্য এম তারিক আহসান বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষার্থীদের ওপর পরীক্ষার বোঝা কমাতে চান। তিনি তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো আনুষ্ঠানিক পরীক্ষা না রাখার নির্দেশনা দিয়েছেন। নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখাতেও পিইসির মতো কোনো পরীক্ষা রাখার কথা বলা হয়নি। সেখানে বোর্ড করে এই পরীক্ষাকে বাধ্যতামূলক করার অর্থ হলো প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অমান্য করা। নতুন শিক্ষাক্রমের দর্শনের বিরোধী পদক্ষেপ নেওয়া। এই পরীক্ষা স্থায়ী হলে কোচিং, প্রাইভেট ও নোট-গাইডের ব্যবসা আরও রমরমা হবে। একই সঙ্গে নকলের প্রবণতা ও মুখস্থনির্ভরতা বাড়বে। তাই এই পদক্ষেপ থেকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সরে আসা উচিত।