প্রাথমিকে পরীক্ষা বাণিজ্য: অবৈতনিক শিক্ষার চ্যালেঞ্জ - দৈনিকশিক্ষা

প্রাথমিকে পরীক্ষা বাণিজ্য: অবৈতনিক শিক্ষার চ্যালেঞ্জ

মো: সিদ্দিকুর রহমান |

ইংরেজ আমলে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে প্রথম অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা আইন করা হয়। ১৯৩৭-৩৮ খিস্টাব্দে শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক এই কার্যক্রমের সম্প্রসারণ করেন।
আজ পরিস্থিতি ভিন্ন। প্রাথমিক শিক্ষা আজ বৈতনিক হতে চলেছে। প্রাথমিক শিক্ষা আজ যেন গরিব মানুষের সন্তানদের কাছে শাখের করাতের মতো। প্রাথমিক শিক্ষায় নোট, গাইড, কোচিং ও পরীক্ষার ফির বাণিজ্যে যন্ত্রণাকাতর হয়ে পড়ছে।
বর্তমানে প্রাথমিক পর্যায়ে ৩টি পরীক্ষা। ভালো পাশের জন্যে গাদা গাদা নোট, গাইড ও সাজেশন পাঠ্যপুস্তককে অকার্র্যকর করে ফেলেছে। শিক্ষকের তীব্র সংকট ও পাঠদান বহির্ভূত কর্মযজ্ঞে শিক্ষকেরা ব্যস্ত থাকায় অভিভাবকদের সন্তানদের বিদ্যালয়ের সময়ের পর কোচিং করাতে বাধ্য হয়। যা অস্বচ্ছল অভিভাবকদের বেদনাহত করে থাকে। একটা প্রবাদ আছে, “আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে”।

কিন্তু বর্তমানে পাল্টে তা হয়েছে “আমার সন্তান যেন বড় পাশ করে”। এই পাশের পিছনে ঘুুরে ধনি বা মধ্যবিত্তরা এগিয়ে যায়। আর গরিবের সন্তানেরা পিছিয়ে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে লেখাপড়াকে সালাম জানিয়ে বিদ্যালয়ের আঙিনা ত্যাগ করে।
বর্তমান পরীক্ষা পদ্ধতি অনেকটা হাতুড়ে ডাক্তারের চিকিৎসার মতো। হাতুড়ে ডাক্তার রোগীর সার্বিক পরীক্ষা না করে লক্ষণ শুনে চিকিৎসা করে থাকেন। তেমনি পরীক্ষা পদ্ধতি শিক্ষার্থীর সার্বিক দিক যাচাই না করে সনদ দেয়। ফলে শিক্ষার্থীর সার্বিক মেধার মূল্যায়ন হয়না। তাই প্রয়োজন প্রাথমিকে একটা আদর্শ মূল্যায়ন পদ্ধতি।

শিশুদের কাছে অত্যন্ত প্রিয় গল্প, ছড়া, কবিতা, কার্টুন, নাটক, গানসহ আনন্দদায়ক বই। বর্তমান পরীক্ষা পদ্ধতির কারণে সে স্থান দখল করে আছে নোট-গাইড। সকালবেলা সূর্যের আলো দেখা, বিকেলে খেলাধুলা, হাঁটা এই প্রজন্ম অনকেটা ভুলতে বসেছে।
ভালো পাশের জন্যে শুধু লেখাপড়া আর লেখাপড়া। শিশুর সার্বিক বিকাশ ও জ্ঞান অর্জন ভুলে আমরা চলছি শিশু মনোবিজ্ঞান সম্পর্কে জ্ঞানবিহীন নামিদামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের খোঁজে। শিশু মনোবিজ্ঞান সম্পর্কে অনেক উচ্চ শিক্ষিতরাও উদাসীন।ঠুনকো মানসম্মানের জন্যে আমরা শিশুকে ঠেলে দিচ্ছি অন্ধকারের দিকে।
উচ্চ বিদ্যালয়ে বছরে দুইটি পরীক্ষা । ছোট্ট ছোট্ট শিশুর জন্যে বছরে তিনটা পরীক্ষাসহ ৫ম শ্রেণির সমাপনীর জন্যে আরো অতিরিক্ত ২ টা মডেল টেস্ট।

পূর্বে পরীক্ষার সব দায়িত্ব ছিল বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ওপর। প্রাথমিক শিক্ষায় পরীক্ষা ফি প্রথা শুরু থেকে চলে আসছে। তখন এই ফির অতিরিক্ত টাকা থেকে গরিব শিক্ষার্থীদের বিনা টাকায় পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ ও বিদ্যালয়ের ছোট-খাটো খরচ মেটানো যেত। বর্তমান পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের টাকা জমা হয় উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের রেইট ২/৩ গুণ বৃদ্ধি করে। যার ফলে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার তহবিলে বিপুল অঙ্কের টাকা উদ্বৃত্ত থাকে। অনেক ক্ষেত্রে ভাউচারে অতিরিক্ত দেখিয়ে উদ্বৃত্ত টাকা কমিয়ে আত্মসাৎ করে থাকে। প্রজ্ঞাপনে উন্নত কাগজে নির্ভুল প্রশ্নপত্র প্রণয়নের কথা থাকলেও বেশির ভাগ উপজেলায় তা মানা হচ্ছে না। বাড়তি টাকা দিয়ে মেধাবীদের উপজেলা ভিত্তিক পুরস্কৃত করার নির্দেশনা দেওয়া আছে। মেধাবীরা সাধারণত বেশিরভাগই স্বচ্ছল পরিবারের সন্তান হওয়ায় পুরস্কার বেশিরভাগ তাদেরই ভাগ্যে জুটবে। এই পুরস্কার অনেকটা তেলা মাথায় তেল ঢালার মতো। আর এদিকে গরিব মানুষদের পরীক্ষা সরকারি নিদের্শনা মোতাবেক ৫ম শ্রেণির ৩৫+৩৫+৩৫+৩৫+৬০=২০০ টাকার জোগাড় করতে কষ্ট হয়ে। এসত্বেও বর্তমানে অনেক উপজেলায় সরকারি নির্দেশনা তোয়াক্কা না করে অনেক বেশি টাকা নেওয়া হচ্ছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে দেশের চরম আর্থিক সংকটে ও তাঁরই সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সালে প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ করেন।এর মূল উদ্দেশ্য ছলি দেশের গরিব মানুষদের সন্তানদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করা। পরীক্ষার সার্বিক নিয়ন্ত্রন উপজেলা কর্মকর্তার অধীনে থাকায় সাধারণ মানুষের শিক্ষার সুযোগ সংকুচিত করে দুর্নীতি প্রসারে সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। ৫ম শ্রেণির সর্বোচ্চ ২টি মডেল টেস্টের জন্য অনেক উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা প্রজ্ঞাপনের আদেশ অমান্য করে সারাদেশে প্রশ্নপত্রের জন্য ১০ টাকার পরিবর্তে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে খাতাসহ ৪০ বা তার উর্ধ্বে টাকা নিয়েছে। বন্যা দুর্গত এলাকায় শিক্ষকদের আবেদন উপেক্ষা করে তাদের পরীক্ষার নামে বিশাল বাণিজ্য করে যাচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রে কিন্ডারগার্টেন ও বেসরকারি স্কুলগুলোকে বাধ্যতামূলক মডেল টেস্টের আওতায় এনে কোন কোন উপজেলায় শুধু মডেল টেষ্টের নামে ২-৪ লাক্ষ টাকা বাড়তি আদায় করা হয়েছে। ১ম-২য় সাময়িক ও বার্ষিক পরীক্ষার টাকা শিক্ষকেরা ব্যাংক একাউন্টে জমা দিলেও মডেল টেষ্ট ২টির টাকা ব্যাংকে জমা না দিয়ে নগদ গ্রহন করছেন।

নিম্নমানের প্রশ্নপত্র ও কাগজ বাবৎ যেখানে সর্বোচ্চ ১৮ টাকা ব্যয় হয়। ২ গুন বেশি বাণিজ্য সাধারণত কম সংখ্যক ব্যবসায়ি করে থাকেন। ঢাকা শহরে মতিঝিল থানার শিক্ষকেরা থানা শিক্ষা অফিসারের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করায় তিনি গরিব মানুষদের সন্তানদের কষ্টের কথা উপলব্ধি বোধ করেন। এই নিবন্ধটি পড়ার পর সংশিষ্ট সকলের মাঝে উপলদ্ধি জাগ্রত হবে বলে আশাবাদী। আমার লেখার ওপরও যে কোন গঠনমূলক সমালোচনা করে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা প্রসারে জাতিকে এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যাশা রাখছি। এ প্রেক্ষাপটে কতিপয় সুপারিশ উপস্থাপন করছি। পূর্ব থেকে এদেশের মানুষ মুখস্ত বিদ্যা, পরীক্ষা দেখে ও দিয়ে অভ্যস্থ। শিশু শিক্ষার্থীর সার্বিক বিকাশে হঠাৎ করে বর্তমান পরীক্ষা পদ্ধতি বিলোপ করা হলে জনমনে ভ্রান্ত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে। এই প্রেক্ষাপটে বইয়ের পড়া অংশ সার্বিক জ্ঞান অর্জন হলো কি না শিক্ষক প্রতিনিয়ত মূল্যায়ন করবেন। শ্রেণির দুর্বল শিক্ষার্থীর বিশেষ সুযোগ দিয়ে নিরাময়মূলক পাঠের ব্যবস্থা করাবেন। শিক্ষার্থীর আচার- আচরণ, নৈতিক শিক্ষা, বলার দক্ষতা, সময়নিষ্ঠা শিক্ষাসহ একটি আর্দশ মূল্যায়ন পদ্ধতি গড়ে তুলতে হবে। বর্তমান পরীক্ষা পদ্ধতির আদলে বার্ষিক পরীক্ষা অনুষ্টিত হবে। বেশিরভাগ জনগণ যখন আদর্শ মূল্যায়ন পদ্ধতির সুফল সম্পর্কে জানবে তখনই পরীক্ষা পদ্ধতি বিলোপ সাধন করা যাবে। সকল বেসরকারি/ কিন্ডারগার্টেন গুলোতে কঠোরভাবে এ মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু করতে হবে।

পরীক্ষার সকল দায়িত্ব থাকবে বিদ্যালয়ের ওপর। যাতে গরিব শিক্ষার্থীরা আর্থিক অনটনে পরীক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত না হয়। সমাপনী পরীক্ষার বিশাল কর্মযজ্ঞে শিক্ষার্থীর লেখাপড়া দারুনভাবে ব্যাহত হয়। এই প্রেক্ষাপটে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডকে সমাপনী পরীক্ষা গ্রহণের দায়িত্ব দেওয়া। সমাপনী পরীক্ষা প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধ হলেও স্ব স্ব বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের কেন্দ্রে উওর বলে দেওয়ার প্রবণতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। জি পি ৫ বানানো যেন পরীক্ষকের কর্মে পরিণত হয়েছে। পরীক্ষকের এ হেন অপকর্ম থেকে বিরত থাকার নির্দেশনা দিতে হবে।অনেক মেধাবীরা এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পরীক্ষার পদ্ধতি আমূল পরিবর্তন করে আমাদেরকে আগামী প্রজম্মকে নোট গাইড, কোচিংমুক্ত জ্ঞান নির্ভর জাতি হিসাবে গড়ে তুলতে হবে। মন্ত্রণালয়কে পরীক্ষার বিশাল বাণিজ্যের দুনীতি থেকে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে রক্ষা করতে হবে।

মো. সিদ্দিকুর রহমান: আহবায়ক, প্রাথমিক শিক্ষক অধিকার সুরক্ষা ফোরাম ও দৈনিক শিক্ষার সম্পাদকীয় উপদেষ্টা।

হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য - dainik shiksha হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা - dainik shiksha ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক - dainik shiksha সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি - dainik shiksha ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার - dainik shiksha রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0091638565063477