ফাদার পিশোতোকে যেমন দেখেছি - দৈনিকশিক্ষা

ফাদার পিশোতোকে যেমন দেখেছি

কাজল ঘোষ |

ফাদার পিশোতোর মৃত্যুর খবরটি জানার পর থেকে ভেতরটা শূন্য মনে হচ্ছে। কেমন বোবা কান্নায় পেয়ে বসেছে। নিজের অজান্তেই ব্যাথার পারদ ওঠানামা করছে। নিজেকেই প্রশ্ন করছি, ফাদার পিশোতো কি আমার আপন কেউ? উত্তর মিলছে, যাকে দেখে সময়ানুবর্তিতা কি জেনেছি, মানুষকে কেবলই নিজের কাজের মধ্যে আত্মমগ্ন থাকতে হয় তার জ্ঞানের আলো বিলিয়ে দিতে, পরিশ্রমের কোন বিকল্প নেই জীবনে পথ চলতে, এগুলো যার কাছ থেকে শিখেছি, তিনিই তো পিশোতে। সে তোমার আত্মার কেউ নয়, আত্মনিয়ন্ত্রের একজন স্বার্থহীন অবিভাবক। 

অনেক কথা মনে হচ্ছে ফাদারকে নিয়ে। প্রথম দেখার দৃশ্যটি এমনই ছিল: প্রধান ভবনের নিচ তলায় বারান্দা দিয়ে উঁচু লম্বা একজন মানুষ আনমনে হাঁটছেন। কি যেন ধুনছেন। হাতে এক গাদা বইপত্র। পেছন থেকে মনে হচ্ছিল, এত ব্যস্ততায় পড়নের কাপড়চোপড় আলুথালু। প্যান্ট বুঝি খুলে পড়ে যাবে। এরপর অনেকবার দেখেছি মানুষটিকে একইভাবে। কাজের ভারে, বইয়ের ভারে অক্লান্ত। কাজের বাইরে, পড়াশোনার বাইরে কখনও দেখিনি মানুষটিকে। সংসারের বন্ধন ছেড়ে মানুষের সেবায় আজন্ম কাটিয়েছেন নির্মোহচিত্তে। আমার ব্যক্তিজীবনে সবসময় এই মানুষটি আর তার দীক্ষায় দুটি বছর কাটিয়ে আসা স্মরণীয় হয়ে থাকবে। 

মতিঝিলের পাশে বাসা থাকায় নটর ডেমকে চিনি নানাভাবে। একটি বড় সুশীতল ছায়াময় প্রতিষ্ঠান। স্কুল জীবন থেকেই আসা-যাওয়ার পথে তাকিয়ে থাকতাম। বিশাল বড় বড় গগণ শিরিষ পাগলের মতোই টানতো। আর এর সুবিশাল মাঠ চুৃম্বকের মতোই আকর্ষণ করত আমাকে। এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর ৯৩ খ্রিষ্টাব্দে অবাক হই বাবাকেও একইরকমের আকর্ষণে পেয়ে বসেছে দেখে। ছেলেকে একটি সুন্দর প্রতিষ্ঠানে পড়াতে চান তিনিও। এর ওর কাছে বাবাকে দেখলাম ছুটে যেতে। একটাই কারণ, ছেলেকে তিনি এই কলেজেই পড়াতে চান? ছোট থেকে দেখতে দেখতে আমিও গভীর থেকে গভীরতর প্রেমে পড়ে যাই নটর ডেমের। বলা যায়, একজন নটর ডেমিয়ান হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হতে থাকি। এসএসসির ফল বেরুলে ছুটে যাই নটর ডেমে। ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিলেও আটকে যাই অল্পের জন্য। এটাকে বলে, ওয়েটিং লিস্ট।

নটর ডেম কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ফাদার পিশোতো

 বাবা এর ওর কাছে বলাবলি করে কলেজ প্রিন্সিপালের অফিসে দেখা করলেন আমাকে নিয়ে। ফাদার পিশোতের মুখোমুখি তখনও হতে পারিনি। অফিস সেক্রেটারি জানিয়ে দিলেন কেন এখানে পড়াতে চান আপনার সন্তানকে তার যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করে আবেদন করতে হবে ফাদারের কাছে। ফাদার এমনটাই বলেছেন। বাবা থামলেন না। দমলেন না। তাই করলেন। এক সপ্তাহ পর নবীন বরণের ঠিক আগ দিন বিকেলে কলেজ নোটিশ বোর্ডে নামটি দেখে বিষ্ময় আর আনন্দের সীমা ছিল না আমার। ফাদার পিশোতোর স্বাক্ষরে আমি ভর্তির জন্য মনোনীত নামটি বারবার দেখেছিলাম।  

প্রথমদিনই তিনি অল্পকথায় বলে দিলেন কেন এখানে আমাদের আসা। আর শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য কি? আমি বাণিজ্য বিভাগে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। ফাদার পিশোতো কলেজ অধ্যক্ষের বাইরে নিয়মিত ক্লাস নিতের পদার্থ বিভাগে। কাজেই বাণিজ্য বিভাগে থাকায় ফাদারের সঙ্গে ক্লাসের সুযোগ পাইনি। তবে পদার্থ বিভাগের ল্যাবে যেতে হতো আমাদের ক্লাসের সামনে দিয়েই। প্রতিদিনই একইসময়ে দেখতাম লম্বা চওড়া মানুষটি এক গাদা বই বগলদাবা করে যাচ্ছেন ল্যাবে। এ সময়টায় নীরবতায় আচ্ছন্ন থাকতো পুরো বিভাগ। 

নীরবে কাজ করে যেতেন মানুষটি। দু বছরের এই সময়টাতে কখনই কোন সমস্যায় আটকালে বারান্দায় চলার পথে ফাদার বললেই থেমে দাঁড়াতেন, পিছনে হাত দিয়ে বলতেন, টুমি কিছু বলবে? ফাদার এটা...ওটা। আমি অফিস সেক্রেটারিকে বলে দিচ্ছি, সমাডান হয়ে যাবে বলেই আবার ছুটতেন। 

একটি ঘটনার কথা মনে করে আজও শ্রদ্ধায় অবনত হই আমি। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত শ্রদ্ধাবনত মস্তিষ্কে তা মনে রাখব। একবার আর্থিক সমস্যায় বেশ ক মাসের বেতন আটকে যায়। টেস্ট পরীক্ষার আগে তা পরিশোধের বাধ্যতা ছিল। ফাদারের কাছে গেলে বললেন, সমাধান বাতলে দিলেন। নটরডেম কলেজে ওয়ার্ক প্রোগ্রাম ছিল। কাজের বিনিময়ে শিক্ষা কর্মসূচি। যারা বিভিন্ন সমস্যায় বেতন বা ভর্তি ফি পরিশোধ করতে ব্যর্থ হতো তাদের কাজের বিনিময়ে সে সমস্যা সমাধানের পথ করে দিত। আর অভিনব এই কর্মসূচির উদ্ভাবক ছিলেন ফাদার পিশোতোই। 

যুক্তরাষ্ট্রে প্রকৌশল বিদ্যায় পড়াশোনা করেও মানুষের জন্য শিক্ষা নিয়ে কাজ করতে ছুটে আসেন বাংলাদেশে। বয়স তখন মাত্র আটাশ। ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে অধ্যাপনা শুরু করেন নটর ডেমে। এরপর আর ছুটে চলা থামেনি। ১৯৭২-এ ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ এবং এরপর নিয়মিত হন কিছুকালের মধ্যেই। টানা পঁচিশ বছর অধ্যক্ষ ছিলেন নটর ডেমের। ১৯৯৮-তে অবসের যান অধ্যক্ষ পদ থেকে। অবসরে গিয়েও বিদায় নেননি। প্রতিদিন সময় করে পদার্থবিদ্যার ক্লাস নিয়েছেন। ঘন্টার পর ঘন্টা ল্যাবে কাজ করেছেন। এর বাইরে মিশনারির যে কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সঙ্কট তৈরি হলে ছুটে যেতেন। কারিকুলাম সচল করতেন। অকাতরে বিলিয়ে দিতেন নিজের সময়। 

নটর ডেমে আমার শিক্ষাজীবন দু বছর। উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে বের হয়ে অনেকদিন পর পেশাগত কাজে পুরোনো ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে সেন্ট গ্রেগরিতে যাই। আমার এসএসসি পরীক্ষার কেন্দ্র আর নটর ডেমের আদি প্রতিষ্টান বলে বরাবরই ভিন্ন রকমের টান অনুভব করি এই প্রতিষ্ঠান নিয়ে। নীরবে হেঁটে দেখছিলাম ঐতিহ্যবাহী এই স্কুলটি। হঠাৎ একটি ক্লাসরুমের কাছে আসতেই মনে হলো এই গলাটি আমার পরিচিত। আরেকটু অগ্রসর হতেই চোখে পড়ে ফাদার পিশোতো বিজ্ঞান ক্লাস নিচ্ছেন। অপেক্ষায় থাকলাম কিছুক্ষণ। ফাদার বের হতেই দু হাত তুলে নমষ্কার জানাতেই কাছে ডাকলেন। শারীরিক খোঁজ নিয়ে বললাম, এখনও ক্লাস নিচ্ছেন। বললেন, ‘শিক্ষকের কোন অবসর নেই। অ্যা টিচার ইজ অ্যা অলওয়েজ টিচার।’ 

এরপর যেখানেই গেছি, ফাদারকে স্মরণ করেছি। বন্ধুমহলে বলেছি, ফাদার এখনও কি পরিশ্রমই না করেছেন দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে। ফাদার আসলে এমনই। এটিই ফাদার পিশোতো। ১৯৬২ থেকে ২০০৪ টানা চার দশক পার করেছেন সক্রিয় শিক্ষকতায়। আর শেষপর্যন্ত এ নেশাতেই মগ্ন ছিলেন। আজ বিজ্ঞান জগতের অনেক সেরা ছাত্রই নিশ্চয় ফাদারের হাতে গড়া। শুধু হাতে গড়া বললে ভুল হবে, ফাদারের দরদিয়া হাতে তৈরি। ফাদার আপনি ভাল থাকুন ওপারে। আপনার জন্য আমার আকাশসম ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা।

কাজল ঘোষ: লেখক, নটর ডেম কলেজের সাবেক ছাত্র ও দৈনিক মানবজমিনের বার্তা সম্পাদক। 

ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে জবি ছাত্রীর আত্মহত্যা: শিক্ষক-শিক্ষার্থী বহিষ্কার - dainik shiksha ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে জবি ছাত্রীর আত্মহত্যা: শিক্ষক-শিক্ষার্থী বহিষ্কার ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে জবি ছাত্রীর আত্মহত্যা: শিক্ষক-শিক্ষার্থী বহিষ্কার - dainik shiksha ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে জবি ছাত্রীর আত্মহত্যা: শিক্ষক-শিক্ষার্থী বহিষ্কার অবন্তিকার আত্মহত্যা: সাতদিনের মধ্যে তদন্ত সম্পন্নের আশ্বাস জবি উপাচার্যের - dainik shiksha অবন্তিকার আত্মহত্যা: সাতদিনের মধ্যে তদন্ত সম্পন্নের আশ্বাস জবি উপাচার্যের হয়রানির প্রতিকার চেয়েও ফল পাননি অবন্তিকা, অভিযোগ মায়ের - dainik shiksha হয়রানির প্রতিকার চেয়েও ফল পাননি অবন্তিকা, অভিযোগ মায়ের নতুন শিক্ষাক্রম: শিক্ষকদের কাছে প্রাইভেট না পড়লে মিলছে না মূল্যায়ন - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রম: শিক্ষকদের কাছে প্রাইভেট না পড়লে মিলছে না মূল্যায়ন মূল্যায়ন বুঝলেও নৈপুণ্য অ্যাপে চ্যালেঞ্জের মুখে শিক্ষকরা - dainik shiksha মূল্যায়ন বুঝলেও নৈপুণ্য অ্যাপে চ্যালেঞ্জের মুখে শিক্ষকরা ‘পড়তে ও লিখতে’ শেখা প্রকল্প কেনো - dainik shiksha ‘পড়তে ও লিখতে’ শেখা প্রকল্প কেনো please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0076861381530762