বই-খাতা ভুলে হাতে হাতে স্মার্টফোন, শিক্ষা ফেলে সাইবার অপরাধে! - দৈনিকশিক্ষা

বই-খাতা ভুলে হাতে হাতে স্মার্টফোন, শিক্ষা ফেলে সাইবার অপরাধে!

নিজস্ব প্রতিবেদক |

গত ১৫ মাসে শিক্ষার্থীদের মস্তিষ্ক থেকে মুছতে বসেছে বইয়ের স্মৃতি। সেখানে খেলে বেড়াচ্ছে অনলাইনের নানা রং। করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে দীর্ঘ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের কারণে স্মার্টফোনে বুঁদ হয়ে আছে কয়েক কোটি কিশোর-তরুণ শিক্ষার্থী। তাদের কেউ কেউ শিষ্টাচার-সামাজিকতার পাট চুকিয়ে ঢুকে পড়েছে সাইবার অপরাধে। কেউ অনলাইন গেমসে মত্ত, কেউ মাদকের ঘোরে। অনলাইনে চলছে মাদক কেনাবেচা। চলছে নারীপাচারের মতো ভয়ংকর অপরাধও। হতাশায় এমনকি আত্মঘাতীও হচ্ছে কেউ কেউ। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, করোনাকালে যে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে, তাদের আর শ্রেণিকক্ষে ফেরানো সম্ভব হবে না। যাদের সার্বিক স্বাস্থ্য-নিরাপত্তা বিবেচনায় স্কুল, কলেজ ও মাদরাসা বন্ধ রাখা হয়েছে, সেই শিক্ষার্থীরা এখন আর ঘরে থাকছে না। তাদের বেশির ভাগই প্রতিনিয়ত ঘরের বাইরে ছোটাছুটি করছে। ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার যৌক্তিকতাও কেউ কেউ আর দেখছে না।

অন্যদিকে বিকল্প হিসেবে অনলাইন ক্লাস ও অ্যাসাইনমেন্টের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মনোযোগ ধরে রাখার চেষ্টাটিও খুব একটা কার্যকর হচ্ছে না। মফস্বলের শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগ শুরু থেকেই অনলাইনে যুক্ত হতে পারেনি। যারা অনলাইনে ক্লাস করতে মোবাইল ফোন হাতে নিয়েছে, এক পর্যায়ে সেই ফোনে তারা পড়াশোনার বদলে গেম বা ইন্টারনেটভিত্তিক ক্ষতিকর অ্যাপগুলোতে আসক্ত হয়ে পড়েছে। অনেকেই চলে গেছে বিপথে।

বিশেষজ্ঞরা আরো বলছেন, ‘নিরাপত্তা নিশ্চিত করে যে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে হবে, সেই জ্ঞান আমরা বিতরণ করতে পারিনি। সোশ্যাল নেট প্ল্যাটফর্মগুলোর খারাপ দিক সম্পর্কে নতুন প্রজন্মকে কখনো সচেতন করা হয়নি।’

গত বছরের ১৮ মার্চ থেকে বন্ধ রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ফলে ২০২০ সালের প্রাথমিক ও ইবতেদায়ি সমাপনী পরীক্ষা হয়নি। সবাই অটো পাসে উত্তীর্ণ হয়। গত বছর দেশে ২৯ লাখের বেশি শিক্ষার্থী প্রাথমিক ও ইবতেদায়ি পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার কথা ছিল। হয়নি জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট ও জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট পরীক্ষাও। ওই দফায় অটো পাস দেওয়া হয় প্রায় ২৬ লাখ শিক্ষার্থীকে। অটো পাস করেছে এইচএসসির শিক্ষার্থীরাও। সর্বশেষ ঘোষণা অনুযায়ী, আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকছে। গতকাল বৃহস্পতিবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ঠিক ১৫ মাস পূর্ণ হয়েছে।

রাজধানীর ভিকারুন নিসার স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী হাবিবা (আসল নাম নয়)। স্কুল বন্ধ হওয়ার পর মাসখানেক শুয়ে-বসেই কাটিয়ে দেয়। সময় যত গড়ায়, তার খারাপ লাগা বাড়তে থাকে। স্কুল বন্ধ, বাইরে কোথাও ঘুরতে যাওয়ারও সুযোগ নেই। কঠোর লকডাউন, তাই গ্রামে যাওয়ারও সুযোগ ছিল না। অলস সময়ের সঙ্গী হিসেবে বেছে নেয় মায়ের স্মার্টফোনটি। আঙুলের স্ক্রলে সে জানতে পারে ইন্টারনেটভিত্তিক নানা অ্যাপের কথা। কয়েক দিনের মধ্যেই যুক্ত হয়ে যায় টিকটকে। এখন সে নিয়মিত টিকটকার। আছে বিশাল ফ্যান-ফলোয়ার। প্রায় প্রতিদিনই তাকে টিকটকের জন্য ভিডিও বানাতে হয়। এ জন্য লাগে নানা আইডিয়া। অভিনয় আরো কত ভালো করা যায়, এ নিয়েই ফারিহাকে ভাবতে হয় সারাক্ষণ। পড়াশোনায় আর মন বসে না তার।

মেয়েটির মা বলেন, যখন হাবিবার হাতে মোবাইল ফোন দেওয়া হয়, তখন চিন্তাই করা যায়নি একদিন সে টিকটকে এতটা আসক্ত হয়ে উঠবে। এখন তাকে কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না। টিকটকে সে এতটাই ব্যস্ত যে অনলাইনের ক্লাস পর্যন্ত করতে পারেনি। অনেক বুঝিয়েও তাকে পড়ার টেবিলে বসানো যায় না। মেজাজ খিটখিটে হয়ে গেছে। মায়ের কথা পর্যন্ত মানতে চায় না।

হাবিবার মতো কয়েক কোটি শিক্ষার্থী এখন অনলাইনে আসক্ত। গত নভেম্বরে কিশোরগঞ্জে ফ্রি ফায়ার গেমের ডায়মন্ড কিনতে এক হাজার টাকা না দেওয়ায় রাফিন নামের এক কিশোর ফাঁসিতে ঝুলে আত্মহত্যা করে। গবেষণায় দেখা গেছে, ইন্টারনেটে বেশি গেম খেলার কারণে অতিরিক্ত টেনশন, বিষণ্নতা এবং তীব্র মানসিক চাপ থেকে দেখা দিতে পারে মানসিক রোগও। শারীরিক ও মানসিক রোগের সঙ্গে সঙ্গে পাবজি বা ফ্রি ফায়ারের মতো গেমগুলো করোনাকালীন শিশু-কিশোরদের মাঝে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

মানসিক চাপের কারণে শিশু-কিশোরদের আত্মঘাতী হয়ে ওঠার চিত্র উঠে আসছে গণমাধ্যমের খবরেও। গত বছরের ১৮ মার্চ থেকে গত ৪ জুন পর্যন্ত প্রকাশিত খবর বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এই সময়ের মধ্যে অন্তত ১৫১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। এর মধ্যে ৭৩ জন স্কুল শিক্ষার্থী, ৪২ জন বিশ্ববিদ্যালয়-মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থী, ২৭ জন কলেজ শিক্ষার্থী এবং ২৯ জন মাদরাসার শিক্ষার্থী রয়েছে। তাদের বেশির ভাগের বয়স ১২ থেকে ২০ বছরের মধ্যে।

শিক্ষার্থীদের অনলাইন আসক্তির কিছুটা ধারণা পাওয়া যায় একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার গবেষণায়। পোল্যান্ডভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবস্থাপনার প্ল্যাটফর্ম নেপোলিয়নক্যাটের পরিসংখ্যান বলছে, করোনা পরিস্থিতির আগে যেখানে বাংলাদেশে মোট ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল তিন কোটি ৮৪ লাখ ৭৫ হাজার, গত মে মাসে তা দাঁড়ায় চার কোটি ৮২ লাখ ৩০ হাজারে। এদের মধ্যে দুই কোটি ১২ লাখের বয়সই ১৮ থেকে ২৪ বছরের মধ্যে। একই সঙ্গে বেড়েছে মেসেঞ্জার, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক, লাইকি ও বিগোর মতো হালের আলোচিত অ্যাপসের ব্যবহার।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. জিয়া রহমান বলেন, করোনার কারণে শিক্ষার্থীরা ঘরবন্দি। স্বাভাবিকভাবেই তারা নতুন কিছুতে ঝুঁকে পড়েছে। মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট তাদের প্রধান আকর্ষণ ছিল। ফলে তারা খুব সহজে তা লুফে নিয়েছে। কিন্তু এর ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে তারা অবগত ছিল না। ফলে তারা যাচ্ছেতাই ব্যবহার করে চলেছে। ফলে তাদের মধ্যে নানা রকম মানসিক অবসাদগ্রস্ততা দেখা যাচ্ছে। খুব সহজেই অপরাধ কর্মকাণ্ডেও জড়িয়ে পড়ছে তারা।

শিক্ষা কার্যক্রমে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসার পর সরকারের প্রথম কাজ হোক শিক্ষার্থীদের নতুন করে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া। তাদের মধ্যে যেসব পরিবর্তন এসে গেছে, সেগুলো নিয়ে কাজ করতে হবে। বিশেষ করে ইন্টারনেট ব্যবহারের ভালো-মন্দ সব দিক তুলে ধরে প্রয়োজনে সেগুলো পাঠ্য বইয়েও সংযোজন করতে হবে।

অন্যদিকে দীর্ঘ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের প্রভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে ঝরে পড়ার হার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার পর এক বছর ধরে চালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, প্রাথমিক পর্যায়ে ১৯ এবং মাধ্যমিক পর্যায়ে ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে। গত বছরের এপ্রিল থেকে জরিপটি চালায় বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেটরি রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড গভর্ন্যান্স (বিআইডিজি)।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রণোদনা দিয়ে হলেও ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের স্কুলমুখী করার ব্যাপক কার্যক্রম নিতে হবে। ২০১৯ সালে প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার ছিল ১৭.৯ শতাংশ আর মাধ্যমিকে এই হার ছিল ৩৭.৬২ শতাংশ। করোনার কারণে পরিবারে অভাবের কারণে শিশুরা ঝুঁকেছে শ্রমের দিকে। তাঁরা আরো বলছেন, এসডিজি অর্জনে সরকার শিশুশ্রম নিরসনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু এখন ২০২১ সালের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম এবং ২০২৫ সালের মধ্যে সব ধরনের শিশুশ্রম বন্ধে সরকারের পরিকল্পনাও চ্যালেঞ্জে পড়ে গেল।

সম্প্রতি এডুকেশন ওয়াচের প্রতিবেদনে বলা হয়, দ্রুত ক্লাসে ফিরে যেতে চায় ৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থী। ৭৬ শতাংশ অভিভাবক ও ৭৩ শতাংশ জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা দ্রুত স্কুল খোলার পক্ষে মত দিয়েছেন। ৫৮ শতাংশ শিক্ষক ও ৫২ শতাংশ উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা একই মত দিয়েছেন। ৮২ শতাংশ শিক্ষক স্কুল খুলে দেওয়ার আগে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা তথা মাস্ক ও স্যানিটাইজার ব্যবহার এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন।

 

ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি - dainik shiksha ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে - dainik shiksha ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে মাকে ভরণপোষণ না দেয়ায় শিক্ষক গ্রেফতার - dainik shiksha মাকে ভরণপোষণ না দেয়ায় শিক্ষক গ্রেফতার ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0039770603179932