বঙ্গবন্ধু হ*ত্যাকাণ্ড ও সিআইএ - দৈনিকশিক্ষা

বঙ্গবন্ধু হ*ত্যাকাণ্ড ও সিআইএ

মিজানুর রহমান খান |

সংবিধান, আইন ও সংসদ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ সাংবাদিক প্রয়াত মিজানুর রহমান খান বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অনেক দুর্লভ নথি প্রকাশ করেছিলেন। তার লেখা উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলোর অন্যতম হলো- ‘মার্কিন দলিলে মুজিব হত্যাকাণ্ড’ ও  ‘১৯৭১: আমেরিকার গোপন দলিল’। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড নিয়ে পত্রপত্রিকাতেও অনেক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন আছে তার। এই লেখা তেমনই একটি কালোত্তীর্ণ প্রতিবেদন। এতে সেই সময়কার মার্কিন রাজনীতি, সিআইএর তৎপরতা ও তৎকালীন বাংলাদেশের ঘটনাপ্রবাহের অনেক অজানা বিষয় উঠে এসেছে। বিশ্ব ইতিহাসের ওই পর্বটিতে সিআইএ বিস্তর অপকর্ম করেছে বলে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দকে কেনো ইয়ার অব ইন্টেলিজেন্স বা গোয়েন্দাবর্ষ বলা হয় তারও ব্যাখ্যা খুঁজেছেন লেখক। সময়ের উপযোগিতা বিবেচনায় অনুসন্ধানী পাঠকদের জন্য লেখাটি পুন:প্রকাশ করা হলো।  

১৫ আগস্ট আসে, ১৫ আগস্ট যায়। আমি নতুন অবমুক্ত হওয়া মার্কিন নথি, বিশেষ করে সিআইএর দলিলপত্রের দিকে চোখ রাখি। বাংলাদেশি পর্যবেক্ষকেরা আজও এ নিয়ে কৌতূহলী। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পরেই এ ঘটনায় সিআইএর সংশ্লিষ্টতা নিয়ে অভিযোগ ওঠে। যুক্তরাষ্ট্র তা নাকচও করে সরকারিভাবে। নির্মম এই ঘটনাটি নিয়ে ৪৫ বছর ধরে অনেক নথি প্রকাশিত হয়েছে। বেরিয়েছে অনেক বই। মার্কিন সাংবাদিকরাই এ ঘটনায় সিআইএর যোগ নিয়ে লিখেছেন বেশি। এর মধ্যে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ হলো, সেইমুর হার্শের বিবরণে ১৫ আগস্টের উল্লেখ। তবে তিনি তা বলেছেন লরেন্স লিফশুলৎজের বরাতেই। হার্শই সেই বিখ্যাত ব্যক্তি, যিনি ১৯৭৫ নিয়ে প্রথম হাটে হাঁড়ি ভাঙেন। সিআইএর অপকর্মের তদন্তে চার্চ ও পাইক কমিটি গঠিত হয়।

২০১৭ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডসংক্রান্ত যত নথি পাওয়া যাচ্ছে, তার মধ্যে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, এ নিয়ে সিআইএর কোনো নথিরই সম্ভবত পুর্ণ বিবরণ প্রকাশ করা হয়নি। কিছু না কিছু বাক্য গোপন করা হয়েছে। সিআইএর ওয়েবসাইটেই এসব নথি রয়েছে।

১৯৭৪ সালের ২২ ডিসেম্বর নিউইয়র্ক টাইমস¬–এ হার্শের রিপোর্ট ঝড় তুলেছিল। হার্শ প্রথম এ ব্যাপারটি উন্মোচন করেছিলেন যে সিআইএ মার্কিন নাগরিকদের গোপনীয়তা লঙ্ঘন করছে। তারা আড়ি পাতছে। এ তথ্যে মার্কিন নাগরিকেরা বিস্মিত হয়ে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৭৫ সালকে তাই বলা হয় ইয়ার অব ইন্টেলিজেন্স বা গোয়েন্দাবর্ষ।

চিলির নেতা সালভাদর আয়েন্দে সম্পর্কে সিআইএ পরিষ্কার বলেছে যে হোয়াইট হাউস এবং সরকারের আন্তসংস্থা নীতি সমন্বয়ক কমিটিগুলোর নির্দেশনার ভিত্তিতে চিলিতে তারা নানামুখী গোপন মিশন বাস্তবায়ন করেছিল। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তাদের এ রকম কোনো প্রাতিষ্ঠানিক তৎপরতা চালানোর সম্ভাবনা কতটা ছিল, সেই প্রশ্ন বিবেচ্য। চিলিতে প্রেসিডেন্ট নিক্সনসহ গোটা প্রশাসন আনুষ্ঠানিকভাবেই জড়িত ছিল বলা যায়।

অনেক মার্কিন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ মনে করেন, বাংলাদেশে কিছু ঘটিয়ে থাকলে নিক্সনকে না জানিয়ে কিসিঞ্জার তা করে থাকতে পারেন। সিআইএ বা যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন বহু উপায়ে খুনিচক্র তথা অভ্যুত্থানকারীদের প্রতি লিফশুলৎজ–বর্ণিত ‘সবুজসংকেত’ দেওয়ার সামর্থ্য রাখে। বাংলাদেশে সেটা তারা দিয়ে থাকলে কী উপায়ে দিয়েছিল কিংবা অভ্যুত্থানকারীদের কাছে কীভাবে তা প্রতিভাত হয়েছিল, সেটা আরও অনুসন্ধানের বিষয়।

একাত্তরের ৭ মার্চের ভাষণের আগে ওয়াশিংটনে সভা বসল। সবাই বললেন, বাংলাদেশকে স্বাধীনতায় স্বীকৃতি দানই হবে মার্কিন স্বার্থের রক্ষাকবচ। কিসিঞ্জার বললেন, ‘না, আমি বিরুদ্ধে যাব। আমি হব ডেভিলস অ্যাডভোকেট।’ সিআইএ বিশ্ব ইতিহাসের ওই পর্বটিতে বিস্তর অপকর্ম করেছে। তাই দিনে দিনে প্রশ্নের মিছিল গড়ে উঠেছে। অন্যতম প্রশ্ন হলো, শেখ মুজিব ঠিক কখন কিসিঞ্জারের সবচেয়ে ঘৃণিত লোকে পরিণত হলেন? ১৯৭০ সালের নির্বাচনী ফল সম্পর্কে কিসিঞ্জারের মনোভাব কী ছিল? এসব প্রশ্নের উত্তর জানা দরকার। 

সাধারণভাবে আমাদের জানা বিষয়গুলোও কি আরও পরিষ্কারভাবে জানা সম্ভব হবে না? আর বাংলাদেশে ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের কাজে কি বিদেশি রাষ্ট্র আদৌ কোনো একটিমাত্র গ্রুপকেই বেছে নিয়েছিল?

আয়েন্দেকে ঠেকাতে সিআইএ ১৯৭০ সালের নির্বাচনের আগে থেকেই তৎপর ছিল। তারা স্বীকার করেছে যে আয়েন্দেবিরোধী তিনটি আলাদা গ্রুপকে তারা একই সঙ্গে মদদ দিয়েছে। তিনটি গ্রুপ একমত হয়েছিল, যেকোনো অভ্যুত্থান ঘটানোর জন্য সাবেক সেনাপ্রধান রেনে স্নাইডারকে অপহরণ করতে হবে। কারণ, তিনি গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন যে সংবিধান অনুযায়ী সেনাবাহিনীর কাজই হচ্ছে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতা গ্রহণে সহায়তা করা।

উল্লেখ্য, সিআইএ আয়েন্দে হত্যাকাণ্ডের ৩৪ বছর পর ২০০৭ সালের ২৪ এপ্রিল তাদের সরকারি ওয়েবসাইটে এ–সংক্রান্ত দলিলপত্র প্রকাশ করেছে। শেখ মুজিবের মার্কিনবিরোধিতা কিংবা মার্কিনদের ব্যক্তি মুজিব বিরোধিতার তেমন কোনো ধারাবাহিক ঐতিহাসিক পরম্পরার অনুপস্থিতি আমরা লক্ষ করেছি। আয়েন্দের মতো মতাদর্শগত বিরোধের তেমন ক্ষেত্র অনুপস্থিত।
 
‘আমি মার্ক্সবাদী নই,’ পঁচাত্তরের ২৪ মার্চ শেখ মুজিব নির্দিষ্টভাবে জানিয়েছিলেন ঢাকার চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স আরভিং চেসলকে। চেসল লিখেছেন (কনফিডেন্সিয়াল ঢাকা ১৪৮৫): আজ রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবের সঙ্গে রাজনীতি ও অর্থনীতি নিয়ে আলোচনা হয়। আমি তাঁকে আসন্ন স্বাধীনতা দিবসের ভাষণের বিষয়বস্তু সম্পর্কে প্রশ্ন করি। তিনি বলেন, বিদেশনীতি ও অর্থনীতিবিষয়ক পর্যালোচনা ভাষণে উল্লিখিত হবে। বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটি এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের আগে ঘোষণা করা যাচ্ছে না। কারণ, তাঁকে জটিলতার কবলে পড়তে হচ্ছে। ‘মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ’ সম্পর্কে অধিকতর সমালোচনামুখর হওয়ার জন্য তাঁর কাছে কিছু মহল দেনদরবার করে চলেছে। এটা অনুমেয় যে তিনি সিপিবি এবং ন্যাপ–মোজাফফরের দিকে ইঙ্গিত দেন। তিনি বলেন, তিনি সকল প্রকারের সাম্রাজ্যবাদের বিরোধী। তাই বলে কোনো দেশ, বিশেষ করে কোনো বন্ধুদেশ, সেটা আবার যুক্তরাষ্ট্রের মতো মহানুভব দেশ হলে তার দিকে তিনি অঙুলিনির্দেশ করবেন না। মুজিব বলেছেন, তিনি মার্ক্সবাদী নন। তাঁর মতে সমাজতন্ত্র, যে দেশের প্রয়োজনীয় সম্পদ নেই তার পক্ষে, একটি দীর্ঘ মেয়াদে অর্জনের বিষয়। এবং বাংলাদেশের মতো একটি গরিব রাষ্ট্রের জন্য যতটা সম্ভব সবার সঙ্গে মৈত্রী ও সহযোগিতার সম্পর্ক বজায় রাখার নীতি অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত। সরকারি দলের অভ্যন্তরের সাম্প্রতিক আলাপ-আলোচনায় বিষয়টি যথেষ্ট বিতর্কের সূচনা ঘটালেও তিনি তাঁর ওই মনোভাব বদলাবেন না। মুজিব আরও বলেন, তিনি একের পর এক মার্ক্সবাদী–নকশালিদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিচ্ছেন এবং গ্রাম এলাকাকে শিগগিরই তিনি এদের কবলমুক্ত করবেন। তিনি বলেন, তাঁর মুখ্য সমস্যা রাজনীতি নয়, বরং অর্থনীতি, বিশেষ করে পাট। তিনি অধীর আগ্রহে মার্কিন পাটের বাজার উন্মুক্ত করার দিকে তাকিয়ে আছেন। কারণ, বিভিন্ন সমস্যার কারণে ইতিমধ্যে তাঁকে ৩০টি পাটকল বন্ধ করে দিতে হয়েছে। তিনি আবারও খাদ্যসহায়তার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এবং সম্ভাব্য অতিরিক্ত খাদ্যশস্য পেতে তাঁর আগ্রহেরও ইঙ্গিত দেন। চেসল তাঁর ওই বার্তায় মন্তব্য করেন, ‘মুজিব যেসব সমস্যার কথা বলেছেন, তা আমাদের জানাশোনা গুজবেরই প্রতিধ্বনি করছে।

১৯৭৫ সালের ১৫ ও ১৬ আগস্টের দুটি প্রতিবেদনে সিআইএ ঘটনার যে রকম বিবরণ দিয়েছে, তাতে প্রশ্ন জাগতে পারে, চিলি ও আয়েন্দের ক্ষেত্রে যেমনটা ঘটেছে এবং যত নথিপত্র এখন প্রকাশ পাচ্ছে, ভবিষ্যতে বাংলাদেশের ১৫ আগস্টের ঘটনা নিয়ে তেমন কিছু প্রকাশ পাবে কি না। এও মনে করার অবকাশ আছে, সিআইএর অবমুক্ত করা দলিলের ভাষ্যকে ভবিষ্যতের প্রকাশিতব্য কোনো দলিলের ভাষ্য খণ্ডন করার কথা নয়।

আমরা মনে রাখব, লিফশুলজ এ পর্যন্ত মুজিবের সরকার পরিবর্তনে হেনরি কিসিঞ্জারের একটি অদৃশ্য সম্মতি ছিল বলে দাবি করেছেন। কিন্তু নির্দিষ্টভাবে এর সমর্থনে এখনো কোনো নথিপত্র মেলেনি। 

শিক্ষার সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক শিক্ষার ইউটিউব চ্যানেলের সাথেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।

দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE  করতে ক্লিক করুন।

কাল থেকে শিক্ষা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী চলবে সব প্রাথমিক বিদ্যালয় - dainik shiksha কাল থেকে শিক্ষা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী চলবে সব প্রাথমিক বিদ্যালয় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান বাড়ানোর নির্দেশ রাষ্ট্রপতির - dainik shiksha বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান বাড়ানোর নির্দেশ রাষ্ট্রপতির ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার দাবিতে দেশজুড়ে সংহতি সমাবেশ - dainik shiksha ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার দাবিতে দেশজুড়ে সংহতি সমাবেশ সব মাদরাসার ওয়েবসাইট ও তথ্য হালনাগাদের নির্দেশ - dainik shiksha সব মাদরাসার ওয়েবসাইট ও তথ্য হালনাগাদের নির্দেশ অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক : দুই মন্ত্রণালয় যা করবে - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক : দুই মন্ত্রণালয় যা করবে নার্সিং-মিডওয়াইফারি ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ - dainik shiksha নার্সিং-মিডওয়াইফারি ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় সিনিয়র আইনজীবীরা বিচার বিভাগের স্বার্থে কথা বলবেন, আশা প্রধান বিচারপতির - dainik shiksha সিনিয়র আইনজীবীরা বিচার বিভাগের স্বার্থে কথা বলবেন, আশা প্রধান বিচারপতির দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0033409595489502