বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন মানেই পূর্ণ স্বাধীনতা - দৈনিকশিক্ষা

বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন মানেই পূর্ণ স্বাধীনতা

অধ্যাপক ড. মো. লোকমান হোসেন |

১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ১০ জানুয়ারি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। এ দিনে লাখো কোটি বাঙালির দাবি ও বিশ্ব জনমতের চাপের প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করে তার প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমিতে ফিরে আসেন। দীর্ঘ ২৩ বছরের সংগ্রাম, ত্যাগ-তিতিক্ষা, আন্দোলন, আত্মত্যাগ ও নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে সামনে এগিয়ে নেয়ার প্রশ্নে বাঙালি যখন বাস্তবতার মুখোমুখি-তখনই স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী শোচনীয় পরাজয় বরণ করলে প্রবল আন্তর্জাতিক চাপ ও বাংলাদেশের মাটিতে আত্মসমর্পণকৃত পাকিস্তানি সৈন্যদের স্বদেশে ফিরিয়ে নেয়ার তাগিদ অনুধাবন করে বঙ্গবন্ধুকে তাঁর স্বদেশে ফিরিয়ে দিতে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধুর মুক্তির অনুরোধ জানিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ৬৭টি দেশের সরকার ও রাষ্ট্র প্রধানকে চিঠি দেন ও ইউরোপের ৫টি দেশ এবং যুক্তরাষ্ট্র সফর করে বিশ্বজনমত বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু অনুকূলে আনতে সক্ষম হন। ফলে ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ৭ জানুয়ারি গভীর রাতে বঙ্গবন্ধু পকিস্তানি কারাগার থেকে ছাড়া পান যা ইংরেজি হিসেবে ৮ জানুয়ারি সকাল বেলা। এদিন বঙ্গবন্ধুকে একটি পাকিস্তান সামরিক বিমানে খুব গোপনে তাঁর ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে লন্ডনে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সকাল সাড়ে ৬টায় তিনি লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে পৌঁছান। লন্ডন পৌঁছালে ব্রিটিশ সরকার তাকে লাল গালিচা সংবর্ধনা দেয়া হয়। এ সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন কমনওয়েলথ বিভাগের প্রধান ইয়ান সাদারল্যান্ড ও লন্ডনে নিযুক্ত ভারতীয় হাই কমিশনার, যা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়। রাস্তায় তখন শত শত মানুষ, এক নজর তাদের প্রিয় বঙ্গবন্ধুকে দেখতে যান। সেই ভিড় সামলাতে হোটেল কর্তৃপক্ষকে হিমশিম খেতে হয়েছে। সবাইকে হোটেলে প্রবেশ করতে দেয়া সম্ভব হচ্ছিল না। বঙ্গবন্ধু জানালায় এসে বারবার হাত নাড়ছেন, বাইরে শ্লোগান হচ্ছে  ‘জয় বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধ’! হোটেলে অবস্থানকালেই আমেরিকার সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন। সেই সাজ সকালেই সেখানে ছুটে এসেছিলেন সেই সময়ের ব্রিটেনের বিরোধী দলের নেতা হ্যারল্ড উইলিয়াম যিনি পরবর্তীতে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। সেখানে এসে তিনি বঙ্গবন্ধুকে প্রথম মি. প্রেসিডেন্ট বলে সম্বোধন করলেন। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ তাঁর সরকারি সফর সংক্ষিপ্ত করে শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধুকে সম্মান জানাতে লন্ডনে ফিরে এসেছিলেন। যাবতীয় রীতি উপেক্ষা করে প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ বঙ্গবন্ধুকে বহন করা গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়িয়েছিলেন যতোক্ষণ না তিনি গাড়িতে ওঠেন। যদিও এডওয়ার্ড হিথ কর্তৃক বঙ্গবন্ধুকে দেয়া সংবর্ধনা নিয়ে অনেকেই সমালোচনা করেছিলেন, উত্তরে হিথ বলেছিলেন, আমি জানি কাকে সম্মান জানাচ্ছি, তিনি হচ্ছেন একটি জাতির মুক্তিদাতা মহান বীর। তাঁকে এই সম্মান প্রদর্শন করতে পেরে বরং আমরাই সম্মানিত হয়েছি। 

লন্ডনে পৌঁছেই তিনি ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ, তাজউদ্দিন আহমদসহ অনেকের সঙ্গেই বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেন। ওইদিন দুপুরের দিকে লন্ডনে প্রধানত এ চারটি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে প্রেস কনফারেন্সের মাধ্যমে তিনি বিশ্ববাসীর কাছে তার বার্তা প্রেরণ করেন। এ চারটি বিষয় ছিলো: মহান মুক্তিযুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অভিনন্দন জানানো; যেসব দেশ মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা বা সমর্থন দিয়েছে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা এবং যেসব দেশ সমর্থন করেনি অথচ জনগণ সমর্থন দিয়েছে, তাদের প্রতি ধন্যবাদ জানানো। সকল দেশের কাছে স্বাধীনতার স্বীকৃতি চাওয়া; পুনর্বাসন কিংবা পুনর্গঠনের জন্য সহযোগিতা চাওয়া। ৮ জানুয়ারি বিকেল ৫টায় ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে এক বৈঠকে মিলিত হন বঙ্গবন্ধু।  

পরিশেষে ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর দেয়া বিশেষ বিমানটি হিথ্রো বিমান বন্দর ছাড়ার পর বিবিসি ঘোষণা দেয় বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের উদ্দেশে যাত্রা করেছেন। স্বদেশে ফেরার পথে বিমানটি দুই ঘন্টার জন্য যাত্রা বিরতি করে নয়া দিল্লীতে। সেখানে তিনি ভারতের রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, সমগ্র মন্ত্রিসভা, তিন বাহিনীর প্রধান এবং অন্যান্য অতিথি ও সে দেশের জনগণের কাছ থেকে উষ্ণ সংবর্ধনা লাভ করেন। দিল্লিতে বিশাল নাগরিক সংবর্ধনায় বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেন। দিল্লিতে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর এক বৈঠকে তিন মাসের মধ্যে বাংলাদেশে অবস্থানরত ভারতীয় সৈন্যদের ফিরিয়ে আনার বিষয়টিও আলোচনা হয়। 

অবশেষে ওইদিন বিকেল ৩ দশমিক ১৫ মি. তিনি বিজয়ের দেশে, বিজয়ীর বেশে, স্বপ্নের সোনার বাংলার মাটিতে পা রাখেন। যে স্বপ্নের জন্য জীবনের ১৩টি বছর কাটিয়েছেন জেলে, সহ্য করেছিলেন নির্যাতন নিপীড়ন। দেশে ফিরে বিমানবন্দর থেকে সরাসরি চলে যান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয়ের পরই বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধুকে প্রাণঢালা সংবর্ধনা জানানোর জন্য অধীর অপেক্ষায় ছিলো। আনন্দে আত্মহারা লাখ লাখ মানুষ ঢাকা বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দান পর্যন্ত তাঁকে স্বতঃস্ফূর্ত সংবর্ধনা জানায়। যে দেশ এবং যে স্বাধীনতার জন্য জীবনবাজি রেখেছিলেন, সেই মাটিতে পা দিয়েই আবেগে তিনি কেঁদে ফেলেন। বিমানবন্দরে তাঁকে স্বাগত জানাতে যারা গিয়েছিলেন তারা সকলেই অশ্রুসজল নয়নে বরণ করেন ইতিহাসের এই বরপুত্রকে। বিকাল পাঁচটায় রেসকোর্স ময়দানে প্রায় ১০ লাখ লোকের উপস্থিতিতে তিনি ভাষণ দেন। রেসকোর্স ময়দানে লাখো মানুষের উদ্দেশে দেয়া ভাষণে মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের জন্য দেশবাসীকে অভিনন্দন এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে গড়ে তোলার কাজে সবাইকে আত্মনিয়োগ করার আহ্বান জানান। 

বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ যে রেসকোর্স ময়দানে বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামের ডাক দিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে বলেছিলেন আর সেই রেসকোর্স ময়দানে ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ১০ জানুয়ারি স্বাধীনতার পূর্ণতা সম্পর্কে স্পষ্ট করে বলেন ‘আজ থেকে তোমাদের প্রতি আমার অনুরোধ, আমার আদেশ, আমার হুকুম। নেতা হিসেবে নয়, প্রেসিডেন্ট হিসেবে নয়, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নয়, আমি তোমাদের ভাই, তোমরা আমার ভাই, এই স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি আমার বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না পায়।’  ‘এই স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি আমার বাংলার মা-বোনেরা কাপড় না পায়, এই স্বাধীনতা পূর্ণ হবে না, যদি এ দেশের মা- বোনেরা ইজ্জত না পায়। এই স্বাধীনতা আমার পূর্ণতা হবে না যদি এ দেশের মানুষ, যুবক শ্রেণী চাকরি না পায়।’ যা ছিলো জাতির জন্য দিক নির্দেশনা। তিনি ডাক দিলেন দেশ গড়ার সংগ্রামে। উপস্থিত জনতা দু’হাত তুলে ঐক্যবদ্ধভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিলেন।

তিনি জনগণকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আমি দেখিয়ে দিবার চাই শান্তিপূর্ণ বাঙালি রক্ত দিতে জানে, শান্তিপূর্ণ বাঙালি শান্তি বজায় রাখতেও জানে।’ মহান মুক্তিযুদ্ধে বহির্বিশ্বের সমর্থনকে অকুণ্ঠ চিত্তে স্বীকার করেন এ ভাষণে। পাশাপাশি তিনি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা জানান ভারত সরকার, সে দেশের জনগণ ও তাদের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে। কৃতজ্ঞতা জানান ব্রিটেন, জার্মান, ফ্রান্স ও সোভিয়েত ইউনিয়নকে। আবার বঙ্গবন্ধু মার্কিন জনগণকে ধন্যবাদ জানান কারণ সে দেশের জনগণ আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেছিল, সরকার রিরোধিতা করেছিলো। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে উদাত্ত আহ্বান জানান এইনভাবে, ‘দুনিয়ার সমস্ত রাষ্ট্রের কাছে আমি সাহায্য চাই। আমার বাংলাদেশকে তোমার রিকগনাইজ করো। জাতিসংঘে স্থান দেও, আমরা হার মানব না। আমরা হার মানতে জানি না। 

বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের মাধ্যমে ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জন করে। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগারে থেকে মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসার মাধ্যমে সে বিজয় পূর্ণতা লাভ করে। বঙ্গবন্ধুকে যখন মানুষদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছিলো, তখন তারা কেঁদেছিলো; যখন বন্দি করে রাখা হয়েছিলো, তখন তারা যুদ্ধ করেছিলো; আর যখন তিনি ফিরে আসলেন তখন তারা বিজয়ী। এ অভিযাত্রা অন্ধকার থেকে আলোর, বন্দিদশা থেকে স্বাধীনতার, নিরাশা থেকে আশার অভিযাত্রা। জেল-জুলুম-অত্যাচার কখনোই বঙ্গবন্ধুকে বিমর্ষ বা চিন্তিত করতে পারেনি। তিনি ছিলেন অকুতোভয় ও বলিষ্ঠ আত্মপ্রত্যয়ী ব্যক্তিত্বের অধিকারী একজন সাহসী নেতা। তাঁর ছিলো বাঙালি জাতির প্রতি অবিচল আস্থা। তিনি স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় সেদিন বলেছিলেন ‘এই বাংলাদেশে হবে সমাজতন্ত্র ব্যবস্থা, এই বাংলাদেশে হবে গণতন্ত্র, এই বাংলাদেশ হবে ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র।’

১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর ভাষণে সেদিন সবাইকে দেশ গড়ার ডাক দেন। তিনি বলেন, ‘যথেষ্ট কাজ পড়ে রয়েছে। আমি সমস্ত জনগণকে চাই, যেখানে রাস্তা ভেঙে গেছে, নিজেরা রাস্তা করতে শুরু করে দেও। আমি চাই, জমিতে যাও, ধান-বোনাও, কর্মচারীদের বলে দেবার চাই, একজনও ঘুষ খাবেনা না। আমি ক্ষমা করব না। সে ভাষণটি হচ্ছে ভবিষ্যত বাংলাদেশের রূপরেখা ও নতুন দেশ হিসেবে দেশ পুনর্গঠনের নীল নকশা। পূর্ব প্রস্তুতিহীন এ সংক্ষিপ্ত ভাষণে অনেকগুলো বিষয়ের প্রতি বঙ্গবন্ধু দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। যা রাষ্ট্র ও জাতি গঠনে তাৎপর্য বহন করে। পাশাপাশি বহন করে তাঁর রাষ্ট্রনায়কোচিত দূরদৃষ্টির। এ ভাষণটি অন্যান্য ভাষণের ন্যায় আমাদের জাতীয় জীবনের অমূল্য সম্পদ ও অন্তহীন প্রেরণা। সেই সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আলোকিত সোনার বাংলা বির্নিমাণে অবিনাশী অনুপ্রেরণা, পাথেয় ও দিক নিদের্শনা। জাতির পিতা যে অসাম্প্রদায়িক, ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত ও উন্নত-সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখেছিলেন, সব ষড়যন্ত্র প্রতিহত করে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের কার্যকরী ভূমিকা রাখব, ইনশা আল্লাহ।’

১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ মার্চ রাতে হানাদার বাহিনী তাদের পূর্ব পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ বাস্তবায়নে লাখ লাখ নিরীহ জনগণের ওপর আক্রমণ ও গণহত্যা চালায়। এ প্রেক্ষাপটে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে সর্বস্তরের জনগণকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ লড়াই শুরু করার ডাক দেন। স্বাধীনতা ঘোষণা দেয়ার পরপরই দখলদার পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুকে তার ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসা থেকে গ্রেফতার করে তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে আটকে রাখে। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতেই দেশে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। পশ্চিম পাকিস্তানে প্রহসনের বিচারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়। বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করায় বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসিতে ঝোলানোর পাকিস্তানি খায়েশ আর পূর্ণ হয়নি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপে ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ১০ জানুয়ারি তিনি বিজয়ীর বেশে তার প্রিয় স্বদেশে ফিরে আসেন। 

বাঙালি জাতির প্রতি বঙ্গবন্ধুর সীমাহীন আস্থা, অন্যদিকে তাঁর প্রতি মানুষের ভালবাসা ও শ্রদ্ধা তাঁকে সর্বদাই রেখেছে দৃঢ়চিত্ত, উন্নতশির ও অসীম সাহসী। তাই তিনি বললেন, আজ আমার জীবনের স্বাদ পূর্ণ হয়েছে। বাংলাদেশ আজ স্বাধীন। বাংলার কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, মুক্তিযোদ্ধা ও জনতার প্রতি জানাই সালাম। এক বিরাট ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা এসেছে। ৩০ লক্ষ লোক মারা গেছে। আপনারাই জীবন দিয়েছেন, কষ্ট করেছেন। বাংলার মানুষ মুক্ত হাওয়ায় বাস করবে। খেয়ে পরে সুখে থাকবে, এটাই ছিলো আমার সাধনা। 

বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে তার ভাষণ দানকালে বলেন, বাংলাদেশের আদর্শগত ভিত্তি কী হবে, রাষ্ট্র কাঠামো কী ধরনের হবে, পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যারা দালালি ও সহযোগিতা করেছে তাদের কী হবে, বহির্বিশ্বকে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য অনুরোধ, মুক্তিবাহিনী, ছাত্র সমাজ, কৃষক, শ্রমিকদের কাজ কী হবে, এসব বিষয়সহ বিভিন্ন দিক নিয়ে নির্দেশনা। রেসকোর্সের জনসভায় তিনি মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে শিশুর মতো কান্নায় ভেঙে পড়েন। ভাষণে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘বিশ্বকবি তুমি বলেছিলেন ‘সাত কোটি সন্তানের হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করনি।’ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তুমি দেখে যাও, তোমার আক্ষেপকে আমরা মোচন করেছি। তোমার কথা মিথ্যা প্রমাণিত করে আজ ৭ কোটি বাঙালি যুদ্ধ করে রক্ত দিয়ে এই দেশ স্বাধীন করেছে। 

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দ, বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও বাংলার মানুষ তখনো জানত না তাদের নয়নের মণি ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব জীবিত আছেন কি না? তাই বিজয়ের মধ্যেও মানুষের মনে ছিলো শঙ্কা ও বিষাদের ছাপ। এ ছাড়াও যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের পুনর্গঠন ও প্রশাসনিক কাঠামো তৈরির মাধ্যমে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শারীরিক উপস্থিতি ছিলো অনিবার্য। তা ছাড়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা, ৩০ লক্ষ মানুষের আত্মাহুতি ও দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রম হারানোর বেদনার্ত ইতিহাস-সবকিছুই যেনো বঙ্গবন্ধুকে ছাড়া অসম্পূর্ণ ছিলো। তাই ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে বিজয় লাভ করলেও প্রকৃতপক্ষে ১০ জানুয়ারি ছিলো বাঙালির জন্য পূর্ণ বিজয়ের দিন। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের আরেকটি আলোকিত অধ্যায়। 

বঙ্গবন্ধু, ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি ও দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তিনি ভারত বিভাজন আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন এবং পরবর্তীকালে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে কেন্দ্রীয়ভাবে নেতৃত্ব প্রদান করেন। শুরুতে তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি, এরপর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক স্বায়ত্বশাসন অর্জনের প্রয়াস এবং পরবর্তীকালে ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পেছনের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হিসেবে কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশের ‘জাতির পিতা’ হিসেবে তাঁকে অভিহিত করা হয়। ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দে বিবিসি কর্তৃক পরিচালিত জনমত জরিপে শেখ মুজিবুর রহমান সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে নির্বাচিত হন। 

পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতির প্রাথমিক পর্যায়ে শেখ মুজিব ছিলেন তরুণ ছাত্রনেতা। জনগণের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ছয় দফা স্বায়ত্ত্বশাসন পরিকল্পনা প্রস্তাব করেন, যাকে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী পরিকল্পনা হিসেবে ঘোষণা করেছিলো। ছয় দফা দাবির মধ্যে প্রধান দাবি ছিলো প্রাদেশিক স্বায়ত্ত্বশাসন, যার কারণে তিনি আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের অন্যতম বিরোধী পক্ষে পরিণত হন। ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে ভারত সরকারের সাথে যোগসাজশ ও ষড়যন্ত্রের অভিযোগে তাকে প্রধান আসামি করে আগরতলা মামলা দায়ের করা হয়; তবে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের কারণে তা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচনে তার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করা সত্ত্বেও তাকে সরকার গঠনের সুযোগ দেয়া হয়নি।

পাকিস্তানে নতুন সরকার গঠন বিষয়ে ইয়াহিয়া খান এবং জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গে তাঁর আলোচনা বিফলে যাওয়ার পর ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঢাকা শহরে গণহত্যা চালায়। ফলশ্রুতিতে, তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। ফলশ্রুতিতে নয় মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ-ভারত যৌথ বাহিনীর কাছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করার মধ্য দিয়ে বিশ্ব মানচিত্রে ‘বাংলাদেশ’ নামক স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ১০ জানুয়ারি শেখ মুজিব পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন এবং বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ১২ জানুয়ারি তিনি সংসদীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ আগস্ট একদল সামরিক কর্মকর্তার হাতে তিনি সপরিবারে নিহত হন। 

বঙ্গবন্ধু আলো দিয়ে উদ্ভাসিত করে গেছেন একটি জাতিসত্ত্বাকে। এমন ক্ষণজন্মা পুরুষ হাজার হাজার বছরে এক বারই আসে। কিছু মানুষ সেইসব ক্ষণের সঙ্গী হতে পারে, মহাকালের সাক্ষী হতে পারে। তিনি স্বশরীরে আমাদের মাঝে না থাকলেও রয়েছে তাঁর নির্দেশনা ও প্রেরণা। তাঁর জ্যৈষ্ঠ কন্যা শেখ হাছিনা তাঁর মতোই মানুষের কল্যাণে ও দেশের আধুনিকায়নে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি পঞ্চমবারের মতো দেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন। আসুন আমরা তাঁর হাতকে শক্তিশালী করি এবং একটি ক্ষুধা, দারিদ্রমুক্ত, বৈষম্যহীন স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখি।

লেখক: সাবেক মহাপরিচালক, নায়েম, শিক্ষা মন্ত্রণালয়  

শিক্ষাসহ সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।

 

দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল  SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।

শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা - dainik shiksha মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা - dainik shiksha দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0031759738922119