বঙ্গবাজার ট্র্যাজেডি, দায় বইবে কে! - দৈনিকশিক্ষা

বঙ্গবাজার ট্র্যাজেডি, দায় বইবে কে!

মাজহার মান্নান |

বঙ্গবাজারে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় বাকরুদ্ধ রাজধানী। চোখের সামনে এমন একটি ভয়াবহ অবস্থা যে কাউকে বিমর্ষ করে তুলবে। করেছেও তাই। ক্ষয় ক্ষতির পরিমান কারও জানা নেই। তবে কয়েক লক্ষ মানুষ পথেযে বসেছে সেটা নিশ্চিত করে বলা যায়। এখন পর্যন্ত অগ্নিকান্ড কেন ঘটলো তা সুনির্দিষ্ট করে জানা গেল না। এটি কি দুর্ঘটনা নাকি নাশকতা তাও পরিস্কার নয়। মূহুর্তের মধ্যে স্বপ্ন পুড়ে ছাই হয়ে গেলো। কিন্তু এমন ভয়াবহতার দায় কেউ নিতে চাচ্ছে না। একে অন্যকে দোষারোপ করে যাচ্ছে। 

এদিকে অস্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্থদের সেখানে বেচাকেনার সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে। এটি ভাল উদ্যোগ। তবে যত উদ্যোগই নেয়া হোক না কেন মার্কেট ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতা না কাটানো পর্যন্ত কোন লাভ হবে না। বার বার কেন অগ্নি কান্ড!! কোথায় গলদ? সীতাকুণ্ডের বি এম কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে প্রাণ হারিয়েছিল  অর্ধশতাধিক মানুষ। আহত হয়ে অনেককে পঙ্গুত্ব নিয়ে সারা জীবন পার করতে হচ্ছে।  আগুন নিভিয়ে যারা মানুষকে বাঁচাতে গিয়েছিলেন তাদের মধ্যে ৯ জনের জীবন প্রদীপ  সেই আগুনেই নিভে গিয়েছিলো।

বঙ্গবাজারে কেন এমন হল? নানা প্রশ্ন মনে ঘুরপাক খাচ্ছে এবং একই সাথে অগ্নিকান্ড নিয়ন্ত্রণে আমাদের সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।  অগ্নিকান্ডের ঘটনা বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়। প্রায়ই অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে থাকে। বহু মানুষ প্রাণ হারায় এবং অনেকে আহত হয়। কয়েকদিন খুব হৈচৈ চলে। কিন্তু কয়েক দিনের মাথায় সেটা কালের গর্ভে হারিয়ে যায়। অগ্নিকান্ডের তদন্ত রিপোর্ট নিয়ে জনমনে যে খুব স্বস্তি আছে তাও নয়। কেন বার বার একই দৃশ্যের অবতারনা? গলদ কোথায় ! সেটা নিয়েই আজকের আলোচনা।  

কোথাও অগ্নকাণ্ড ঘটলে আমরা সবাই সরব হই। তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু ফলাফলটা কি? নিয়ম অনুযায়ী অগ্নিকাণ্ডে যারা নিহত বা আহত হয় তাদের যে ক্ষতিপূরুণ পাওয়ার কথা তারা কি সেটা পান? কারখানা কর্তৃপক্ষ ক্ষতিপূরুণ দেয়ার ক্ষেত্রেও গরিমসি ও নানা ধরনের কৌশলের আশ্রয় নিয়ে থাকেন। বহু মানুষ আছেন যারা এমন পরিস্থিতির শিকার হয়েও কোনো ক্ষতিপূরুণ পাননি। তাজরীন ফ্যাশন, হাসেম ফুডসহ বহু কারখানায় আগুনে বহু প্রাণহানি ঘটেছে। এসব ঘটনার দায় তবে কার? অগ্ননির্বাপণে আমাদের সক্ষমতা কি সঠিক পর্যায়ে আছে। পরিস্থিতি দেখেতো সেটা মনে হয় না। আর কত মৃত্যু হলে আমাদের হুঁশ ফিরবে? সীতাকুণ্ডের ঘটনায় অনিয়ম, গাফিলতি এবং দায়িত্বহীনতার চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। 

বাংলাদেশের শ্রম আইন অনুযায়ী বড় আকারের কোন স্থাপনা ও কারখানায় অগ্নিনিরাপত্তা পরিকল্পনা থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু শ্রম আইনের এই বিধানটি কেবল কাগজেই থেকে গেছে বলে মনে হয়। বাস্তবে এর প্রয়োগ কি হয়? কারখানাগুলিতে শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়ে কর্তৃপক্ষ কি সত্যি আন্তরিক? যদি তাই হত তবে এমন ঘটনা কি বারবার ঘটতো? শ্রমিকদের বের করে আনার মতো সময় ছিল কিন্তু গেটের নিরাপত্তা কর্মীরা তালা লাগিয়ে পালিয়ে যান। মূল ফটকে তালা লাগিয়ে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা আমরা প্রতিবারই দেখি। ফটকের নিরাপত্তা কর্মীরা তবে কি কর্তৃপক্ষের আদিষ্ট হয়ে এমনটি করেন।

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে অর্ধশতাধিক মানুষের মৃত্যু ছিল অত্যন্ত হৃদয়বিদারক ও মর্মান্তিক ঘটনা। অগ্নি দুর্ঘটনা বাংলাদেশে নতুন কিছু নয় এবং অগ্নি দুর্ঘটনার কারণে বাংলাদেশে প্রতি বছর অনেক লোক মারা যায় এবং বিভিন্ন কারখানায় প্রায়ই এই ধরনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। তবে এ ধরনের অগ্নিকাণ্ড অব্যাহত রয়েছে এবং ঢাকার চকবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৭০ জনের বেশি মানুষ নিহত এবং বিপুল আর্থিক ক্ষতি হয়। ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকার নিমতলীতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১২৪ জনের মারা যান এবং সম্পত্তির ব্যাপক ক্ষতি হয়। বারবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলেও তা প্রতিরোধে কার্যকর ও স্থায়ী কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। 

২০০৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে দেশে অগ্নিকাণ্ডে ৬০০ জন শ্রমিক মারা গেছে এবং ২০১২  খ্রিষ্টাব্দে তাজরীন ফ্যাশনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে  ১১৭ জন শ্রমিক মারা গেছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনেক ভবনে অগ্নি নিরাপত্তা সরঞ্জাম বসানো নেই এবং কোথাও লাগানো থাকলে তা সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় না। যে কারণে প্রায়ই এমন দুর্ঘটনা ঘটে। বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, জাতীয় বিল্ডিং কোড অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক করা উচিত। বিশেষজ্ঞদের মতে, বেশিরভাগ কারখানায় আগুন লাগলে দ্রুত বের হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় এক্সিট নেই এবং কারখানায় নিয়মিত ফায়ার ড্রিল করা হয় না। অনেক কারখানায় অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র আছে কিন্তু প্রশিক্ষণের অভাবে এবং আগুন নেভানোর জন্য পর্যাপ্ত পানির সরবরাহ না থাকায় অনেকেই জানে না কিভাবে সেগুলো পরিচালনা করতে হয়। অনেক কারখানায় সিঁড়ি এতটাই সরু যে শ্রমিকরা ছুটে গিয়ে নিচের দিকে চলে যায় এবং দুর্ঘটনায় মারা যায়।
 
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে কোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে কারখানার ট্রান্সফরমার, জেনারেটর, পাওয়ার সাবস্টেশনসহ অন্যান্য বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি নিয়মিত পরিদর্শন ও মনিটরিং করা প্রয়োজন। অনেক বিল্ডিংয়ে ফায়ার অ্যালার্ম সিস্টেম আছে কিন্তু সেগুলো সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় না বা সেগুলো ঠিকমতো কাজ করে না। ২০১৩  সালে রানা প্লাজা ধসের পর এগারো শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছিল এবং তখন থেকে ভবনের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে কিন্তু এখনও পর্যাপ্ত মাত্রায় পৌঁছায়নি। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে অনেক সময় লেগেছে এবং সে কারণে হতাহতের সংখ্যা বেড়েছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে কোনো জায়গায় দাহ্য পদার্থের ধরণের উপর ভিত্তি করে আগুন নেভানো দরকার। অনেক ক্ষেত্রে শুধু পানি ছিটিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা যায় না, তবে পানিতে অন্যান্য রাসায়নিক মিশিয়ে আগুন দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। বাংলাদেশ কারখানা পরিদর্শন অধিদফতরের মতে, কোনো ভবনে রাসায়নিক ও দাহ্য পদার্থ থাকলে সে তথ্য স্থানীয় কারখানা পরিদর্শন বিভাগে জমা দিতে হবে। ফায়ার সার্ভিসের তথ্যমতে, বিভিন্ন কারণে প্রতি বছর ভবনসহ বিভিন্ন স্থানে অগ্নি দুর্ঘটনা ঘটে থাকে এবং এর প্রধান কারণ চুলার আগুন, বিদ্যুৎ সংযোগ ও সিগারেটের আগুন। ফায়ার সার্ভিস বিশ্বাস করে যে ভবনগুলিতে দাহ্য পদার্থের ভুল স্থাপনের কারণে এই ধরনের দুর্ঘটনা আরও বেড়ে যায়। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা মনে করেন, পরিদর্শন বিভাগ ও স্থানীয় প্রশাসনের নিয়মিত কারখানার ভেতরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ সংযোগ, গ্যাস সংযোগ ও দাহ্য সামগ্রীর ওপর নজরদারি করা প্রয়োজন। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের মতে, এ ধরনের অগ্নিকাণ্ডের পুনরাবৃত্তির মূল কারণ হচ্ছে অভিযুক্তদের উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা না করা। কারখানা কর্তৃপক্ষ প্রায়ই অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা উন্নত করতে এবং দুর্ঘটনা ঘটাতে অনিচ্ছুক। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করা উচিত এবং দোষীদের বিচারের আওতায় আনা উচিত। 

আইএলও কনভেনশনের ১২১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান এবং আহত শ্রমিকদের সুস্থতা ও ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। তবে বড় অগ্নিকাণ্ডের পর কয়েকদিন অনেক হৈ চৈ থাকলেও কালের গর্ভে তা ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যায়। কারখানাগুলো নিয়মিত মনিটরিং করার পর্যাপ্ত উদ্যোগ না থাকায় প্রয়োজনীয় নীতিমালা ও নির্দেশনা প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া উচিত এবং তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নিতে হবে অন্যথায় এর পুনরাবৃত্তি ঘটবে। বঙ্গবাজারে ক্ষতিগ্রস্থ ব্যবসায়ীরা যেন পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরুন পান সেটা নিশ্চিত করতে হবে। শুধু লোক দেখানো পূর্ণবাসনেই যেন সীমাবদ্ধ না থাকে সেটা নিশ্চিত করতে হবে। স্থায়ী মার্কেট করে যাদের দোকান ছিল তাদের বরাদ্দ দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

জবাবদিহিতা এবং স্বচ্ছতার জায়গাটিতো অবশ্যই তৈরি করতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহিতা আর আইনের শাসন না থাকলে আদৌ কি এগুলি সমাধান হবে? নজরদারি বডির তৎপরতার উপর নির্ভর করে অনেক কিছু।  যাহোক, অগ্নিনিরাপত্তা বিষয়ে আর কোন গাফিলতি যেন না থাকে সেটাই নিশ্চিত করতে হবে। দায়ীদেরকে অবশ্যই দায় নিতে হবে। 

লেখক :মাজহার মান্নান, সহকারী অধ্যাপক, বিএএফ শাহীন কলেজ, ঢাকা

 

প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপের মৌখিক পরীক্ষা শুরু ৯ মে - dainik shiksha প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপের মৌখিক পরীক্ষা শুরু ৯ মে প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের নতুন নির্দেশনা ঢাকার তাপমাত্রা দেখে স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্ত নয়: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha ঢাকার তাপমাত্রা দেখে স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্ত নয়: শিক্ষামন্ত্রী তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রির বেশি হলে স্থানীয়ভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হতে পারে - dainik shiksha তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রির বেশি হলে স্থানীয়ভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হতে পারে বঙ্গবন্ধুকে হারিয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিক্ষাখাত - dainik shiksha বঙ্গবন্ধুকে হারিয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিক্ষাখাত আরো ৭২ ঘণ্টার হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha আরো ৭২ ঘণ্টার হিট অ্যালার্ট জারি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0072698593139648