বাঁশি তো আগের মতো বাজে না - দৈনিকশিক্ষা

বাঁশি তো আগের মতো বাজে না

কে জি মোস্তফা |

স্মৃতি রোমন্থনের ফাঁদে মায়া বড় বিভ্রান্তিকর। এই বস্তু যখন মনের ওপর ভর করে, তখন আপাতদৃষ্টির সাজানো-গোছানো চারপাশ হঠাৎ করেই বিভ্রম সৃষ্টি করে, জন্ম দেয় ভীষণ তুচ্ছ অথচ পরম মূল্যবান কোনো বস্তু হারিয়ে ফেলার শূন্যতাবোধ।  
 
ইদানিং ঢাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আমগাছে ঢিল মারার দৃশ্য প্রায়ই চোখে পড়ে। কাঁচা আমের লোভে পথশিশুরা যেন মরিয়া! ভ্রুক্ষেপহীন এই দুর্দান্ত দৃশ্য আমাকে কৈশোরে ফিরিয়ে নিয়ে যায়।

শিল্পী প্রতিমা ব্যানার্জীর বিখ্যাত গানটি-‘আমি মেলা থেকে তালপাতার এক বাঁশি কিনে এনেছি। বাঁশি কই আগের মতো বাজে না, মন আমার তেমন কেন সাজে না। তবে কি ছেলেবেলা অনেক দূরে ফেলে এসেছি’। 

হ্যাঁ, আমারও ছেলেবেলা এখন অনেক দূরে! জীবনের অনেকটা পথ চলে এসেছি। শৈশব-কৈশোর এমনকী যৌবনে গ্রামগঞ্জে গাছে চড়ে, পানিতে ঝাঁপ দিয়ে, নির্মল বাতাস সেবন করে, পাখির গান শুনে, ঋতুর রঙ-বেরঙ দেখে প্রকৃতির সঙ্গে আত্মীয়তা গড়ে উঠেছিল।

‘গ্লোবাল ভিলেজ’-এর যুগে সেই অজ পাড়াগাঁ আর নেই। অদ্ভুত কোমল, কী সহনশীল ছিল মানুষ। হিন্দু-মুসলমানের পাশাপাশি বসবাস সেই কাল ছিল নিরবচ্ছিন্ন মহামিলনের এক ইতিহাস।

যাই হোক, বাঙালি জীবনে পয়লা বৈশাখ এক সর্বজনীন উৎসব। মনে পড়ে গ্রামের নকশীকাঁথা মাঠে মাসব্যাপী অনুষ্ঠিত বৈশাখী মেলা। সেই মেলা ছিল পল্লীর কুটিরশিল্প, লোক উৎসবের এক বার্ষিক ফিচার। গ্রামগঞ্জের কুমোরগণ তৈরি করত কত খেলনা- তাতে রঙের কী বাহার! মাটির বাসনপত্র, মাটির ঘোড়া, হরিণ, গরু, ষাঁড়, বলদ, গাভী, ছাগল,পাখি, মাছ, আম, কাঁঠাল, লিচু, আরও কত কিছু। কী তার অপূর্ব শিল্পরূপ! কামার তৈরি করত কত রকমের দা, কাঁচি, ছুরি, বটি, দাঁড়িপাল্লা। কাঠের তৈরি কত রকমের চেয়ার, টেবিল, পিঁড়ি, বাকস, বেলচা, বেলনা। আসত কত রঙবেরঙের ঘুড়ি। একটি ঘুড়ির জন্য সে কী আবদার, সে কী কান্না! বিক্রি হতো উড়কি মুড়কি বিন্নি ধানের খই, চিনি বা গুড়ের খাজা। শোলার তৈরি বিচিত্র পাখি, মালা, ফুল, মুখোশ, মুকুট, চড়কি। হাতে তৈরি বিচিত্র পাটি, রঙিন পাটের শিকে, সারিন্দা, ডুগডুগি, ঢোলক, পটের ছবি। মেলার এমন সব চিত্র যা ছিল যুগযুগ সাধনার ধন। সে এক আনন্দঘন অনুভূতি, যেন দূরাগত এক বাঁশির সুর, ফিরতি যাত্রায় মেলাটাই যেন হাসি হয়ে বাঁশি হয়ে ঘরে ফিরত। 

মেলার এতকিছুর মধ্যে আমার বায়না ছিল শুধু এক আনা দামের একটি ছুরি। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে আমবাগানে হারিয়ে যেতাম। দক্ষিণের বাতাস ছুটত, ঝরে পড়ত কিছু মুকুল বা দু একটি আম। ঘনপাতার ফাঁকে কোকিলের ডাক আমায় স্বাগতম জানাত। কত নামের কত রকমের আম। ‘সিদুঁরে বউ’ আমের গোড়ায় কে যেন সিঁদুরের ফোঁটা এঁকে দিত। ‘মধুচাড়া’ মধুর মতই যার ছিল স্বাদ। ‘রাঙাবউ’ যেন লজ্জাবতী হলুদমাখা রাঙাবউ। ‘বেগম ভোগ’ ‘বাদশাভোগ’ ‘গোপালভোগ’-এগুলো যেন বাদশা-বেগমরাই খেতেন। আরও ছিল ‘জষ্টিমধু’- জ্যৈষ্ঠ মাসের নিদারুণ গরমে কী যে মিষ্টি! আমের আরও কত নাম, আজ আর সেসব মনে নেই। 

আসলে জীবনের সঙ্গে জন্মগত ও ঐতিহ্যগত প্রাত্যহিক যে পরিচয় ছিল, তা এখন হারিয়ে গেছে। বংশপরম্পরায়প্রাপ্ত আজন্মলালিত দেশীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পূর্ণ নতুন ভিন্নতর জীবনযাপনে এখন নিত্য সংঘর্ষ।
 
পয়লা বৈশাখের প্রধান শিক্ষাই ছিল আত্ম-আবিষ্কার, ঐতিহ্যের আবিষ্কার। কিন্তু বিশ্বায়নের এই যুগে পয়লা বৈশাখ মরে ভূত হয়ে গেছে। অথচ পয়লা বৈশাখ বাঙালির জীবনে এক বাস্তব সত্য। এই দিনটিকে শুধু পণ্য বা শুভ বলেই ধরা হয় না, সৃষ্টি ও নির্মাণের সূচনা দিবস হিসেবে বাঙালির জীবনে বহুযুগ থেকে দিনটি চিহ্নিত হয়ে আসছে। এই দিনটিকে ব্যবসা-বাণিজ্য তার নবীনযাত্রা ও পুনর্যাত্রার দিনরূপে মান্যতা দিত।

বলাবাহুল্য, এখন গ্রামে গেলে অনেকখানি হাহাকারভরা শূন্যতা নিয়ে ফিরে আসতে হয় ঘরে। সেই শূন্যতা ও হাহাকার যেন গ্রামের প্রতিটি ইট-পাথরকে বিষণ্ন করে রেখেছে। মায়াময় বেদনা খুব শিগগিরই আমাদের জড়িয়ে ফেলে এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে। যে বাঁধন থেকে মুক্তি পেলে হয়তো ভাল হতো, কিন্তু মুক্তি পেতে ইচ্ছে করে না। 

এসো হে বৈশাখ, এসো। বৈশাখ, তুমি এলে স্মৃতি যেন কবিতার বিষয় হয়ে ওঠে। সকালবেলায় উঠোনে একটা শালিক কী যেন খুঁটে খাচ্ছে, ডালেডালে দোয়েলের মিষ্টি মধুর শিস। গাছে গাছে কুটুম পাখি, আঙ্গিনায় পাতাবাহার, নিদাঘ দুপুরে ঘুঘুর ডাকে সোহাগি ঘুম! 

সহেলি, হঠাৎ মনে পড়ল এই বৈশাখে তোমাকে, নীরব মোহিনী মায়ায় যে আমায় একদা কাঙাল করেছিলে। স্বপ্ন আর স্বপ্নভঙ্গে বহুকাল, কত কাল কেটে গেছে। তোমার সঙ্গে পুকুরপাড়ে বকুল কুড়িয়েছিলাম। আজ তুমি নেই, নেই সেই মায়াবী প্রহর। তাজের মর্মমহলে মমতাজ নেই। গতির আবর্তে গতিময় দিনগুলো কোথায় হারিয়ে গেছে। সবার অলক্ষ্যে বকুলবিহীন ঘাসের ওপর আজ আমি পড়ে আছি একা!
                                    
লেখক : কে জি মোস্তফা, গীতিকার কবি কলামিস্ট

ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.003547191619873