কৃষি আমাদের সংস্কৃতির অনিবার্য অনুষঙ্গ। কৃষিপ্রধান এই দেশে সনাতন কৃষি ব্যবস্থার আধুনিকায়নে তথা বিজ্ঞান-ভিত্তিক চাষাবাদের মাধ্যমে টেকসই কৃষি উন্নয়ন ও কৃষি-বিজ্ঞান ভিত্তিক অর্থনৈতিক বুনিয়াদ গড়ে তোলার লক্ষ্যে ষাট দশকের গোড়ায় জন্ম নেয় দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ পীঠস্থান বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। এটি বাংলাদেশের প্রথম উচ্চতর কৃষি শিক্ষা ও গবেষণার ঐতিহ্যবাহী জাতীয় প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় তথা দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই কৃষিশিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি ৫৯ বছরের গৌরবময় পথ পরিক্রমা অতিক্রম করে সম্প্রতি হীরকবর্ষ (ষাট) পালন করেছে। রোববার (২৩ আগস্ট) জনকণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও জানা যায়, জাতীয় খাদ্য ও কৃষি কমিশন এবং শিক্ষা কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে ১৯৬১ সালের ১৮ আগস্ট ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। লক্ষ্য ছিল কৃষি উন্নয়নের জন্য দক্ষ কৃষিবিদ তৈরি করা, কৃষিকে বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতামুখী ও টেকসই করে তোলার জন্য প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা, কৃষির সকল বিষয়ে মৌলিক ও প্রায়োগিক গবেষণার জন্য বিজ্ঞানী তৈরি করা এবং গবেষণালব্ধ প্রযুক্তি কৃষকের কাছে পৌঁছে দেয়া। শুরুতে ভেটেরিনারি ও কৃষি অনুষদ নামে দুটি অনুষদ নিয়ে ১৯৬১ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কয়েক মাসের মধ্যেই পশুপালন অনুষদ নামে তৃতীয় অনুষদের যাত্রা শুরু। এরপরে ১৯৬৩-৬৪ শিক্ষাবর্ষে কৃষি অর্থনীতি ও গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞান অনুষদ, ১৯৬৪-৬৫ শিক্ষাবর্ষে কৃষি প্রকৌশল ও কারিগরি অনুষদ এবং ১৯৬৭-৬৮ শিক্ষাবর্ষে মৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে ছয়টি অনুষদের আওতায় ৪৩টি শিক্ষা বিভাগের তত্ত্বাবধানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে। বর্তমানে ৪৩টি শিক্ষা বিভাগে ৪২ বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রী কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
কার্বনের যেমন সবগুলো সক্রিয় হাত ব্যবহৃত হয়ে গঠিত হয় মূল্যবান হীরকের সুস্থিত কাঠামো তেমনই প্রতিষ্ঠার পর জাতীয় প্রয়োজনে হাতে হাত রেখে নিরলসভাবে কাজ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। ওই প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি শিক্ষক ও গবেষক হৃদয়ে সবটুকু উজাড় করে পরম যত্নে ও মমতায় তৈরি করেছে কৃষিতে আধুনিক জ্ঞানবোধসম্পন্ন সুদক্ষ কৃষি গ্র্যাজুয়েট। প্রতিষ্ঠালগ্ন হতে দিন দিন বৃদ্ধি পেয়েছে এর মর্যাদা ও সুখ্যাতি। শান্তিপূর্ণ সুষ্ঠু পরিবেশে শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নের ধারায় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় আজ আন্তর্জাতিক র্যাঙ্কিং এ বাংলাদেশের সরকারী-বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ধারাবাহিকভাবে পরপর দুইবার প্রথমস্থানে অধিষ্ঠিত হয়েছে।
কৃষির আধুনিক জ্ঞান ও প্রযুক্তির ধারণা নিয়ে গড়ে ওঠা কৃষি গ্র্যাজুয়েট ও বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের নিরলস গবেষণায় সময়, পরিবেশ ও কৃষকের প্রয়োজন অনুযায়ী আধুনিকসব কৃষিপ্রযুক্তি ও ফসলের জাতের উদ্ভাবন ও উন্নয়ন হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশের সকল ধরনের কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কাজ করে দেশের কৃষির জন্য নিত্যনতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করছেন। সেই প্রযুক্তিগুলো যে শুধু দেশের অভ্যন্তরেই ব্যবহার হচ্ছে এমন নয় আন্তর্জাতিক অঙ্গনের সুখ্যাতি লাভ করছে। যার ফলে দেশের সামগ্রিক চাহিদা পূরণে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেবর আজ বহুগুণে বেড়েছে। এই দক্ষ কৃষি গ্র্যাজুয়েটদের নিরন্তর প্রচেষ্টার ফলেই দেশ আজ খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে এবং উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য রফতানি করছে। পাশাপাশি বিভিন্ন রাষ্ট্রের দুর্যোগে এখন আমাদের দেশ খাদ্য সাহায্য পাঠাচ্ছে। শুধু তাই নয় জনসংখ্যার উর্ধমুখী চাপ, কৃষিজমির পরিমাণ ক্রমাগত হ্রাস, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট বন্যা, লবণাক্ততা, খরা, উচ্চ তাপমাত্রা ও বৈরী প্রকৃতির প্রভাব থাকা সত্ত্বেও খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশে^র বুকে মাথা উঁচু করে চলার মতো অবস্থার পৌঁছে গেছে। বন্যা, লবণাক্ততা, খরা ও দুর্যোগসহিষ্ণু শস্যের জাত উদ্ভাবন ও উন্নয়নের বিশ^ তালিকায় বাংলাদেশ শীর্ষে অবস্থান করছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বে ইলিশ উৎপাদনে প্রথম, মাছ ও পাট উৎপাদনে দ্বিতীয়, ধান ও সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, আলু ও আম উৎপাদনে সপ্তম, পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম, মৌসুমী ফল উৎপাদনে দশম স্থানে আছে। এখন প্রয়োজন খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। সে লক্ষ্যেও কাজ শুরু করেছে বিশ^বিদ্যালয়টি। কৃষিক্ষেত্রে দৃশ্যমান এ সাফল্যগুলোর কৃতিত্ব এ দেশের কৃষক ও এ বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটদের, এটি আজ সর্বজন স্বীকৃত।
কৃষি গবেষণা, মাঠ সফলের উৎপাদন বৃদ্ধি তথা দেশের কৃষির সার্বিক উন্নয়নের মূল পরিকল্পনাকারী এবং কৃষিবিদের অনুপ্রেরণা হচ্ছে ইতিহাসের কিংবদন্তি, মাটি ও মানুষের রাজনীতির মহাকবি বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এদেশের কৃষি ও কৃষকের পরমোৎকর্ষের লক্ষ্যে যুগান্তকারী অনেকগুলো পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন তিনি। আর ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ঐতিহাসিক একটি দিন। সেদিন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় তথা বাংলাদেশের কৃষিবিদ সমাজ স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাগত জানানোর এক অবিস্মরণীয় সুযোগ লাভ করেছিল। এ সময় উপস্থিত কৃষিবিদদের দাবির ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধু সরকারী চাকরিতে প্রথম শ্রেণীর পদমর্যাদার ঘোষণা দেন এবং এদেশের কৃষি ও কৃষকের পরিকল্পিত উন্নয়ন তথা গ্রামীণ ও গণমুখী অর্থনৈতিক বিকাশের ওপর সর্বাধিক গুরুত্বরোপ করে কৃষিবিদের দিক নিদের্শনা দেন।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দূরদর্শী সিদ্ধান্ত ও পরবর্তী সময়ে জাতির জনকের সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কৃষি সেক্টরকে প্রাধান্য দিয়ে সময় উপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণের ফলে অন্যান্য সেক্টর থেকে কৃষি সেক্টর দৃশ্যত এগিয়ে আছে। শেখ হাসিনার সরকার ২০৩০ সাল নাগাদ টেকশই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছেন। সে অনুযায়ী ক্ষুধা ও দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পেতে বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদিত শক্তি ও উৎপাদন দ্বিগুণ করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর ভিশন ২০২১, ২০৪১ ও ২১০০ (ডেল্টা প্ল্যান) সালের জন্য উন্নয়নের রূপকল্প ঘোষণা করেছেন। তাঁর এ ঘোষণা বাস্তবে রূপ দিতে শোষিত-বঞ্চিত বীরের জাতিকে মানবসম্পদে রূপান্তর করতে হবে বাংলাদেশের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, আত্মকর্মসংস্থান, কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, দারিদ্র্য বিমোচন ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এসডিজির এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশের ফসল খাতের নানাবিধ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার পাশাপাশি প্রাণিসম্পদ ও মৎস্যসম্পদের গুরুত্ব অপরিহার্য।
আগামী দিনগুলোতে কৃষির জন্য বড় চ্যালেঞ্জগুলো হলো পরিবেশ রক্ষা, জমির একক প্রতি উৎপাদন বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলা, মাটির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি ও ঝুঁকি মোকাবেলা, কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, কৃষিতে আইসিটির ব্যবহার, সকলের জন্য খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা বিধান করা এবং কৃষি শিক্ষাকে যুগোপযোগী ও আধুনিকায়নের লক্ষ্যে কোর্স কারিকুলা আপডেট করা। ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে প্রাণীজ কৃষির বিকাশের মাধ্যমে এ লক্ষ্য আমাদের পূরণ করতে হবে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় অতীতের ধারাবাহিকতায় আগামী দিনের এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দক্ষ গ্র্যাজুয়েট সৃষ্টি এবং কৃষি শিক্ষা, গবেষণা ও সম্প্রসারণ কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে যাবে।
মুজিববর্ষের এই মাহেন্দ্রক্ষণে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের হীরকবর্ষে পদার্পণ করায় বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার অত্যন্ত আনন্দিত এবং গর্বিত। এই আনন্দময় দিনের শপথ, দেশের কৃষি শিক্ষার পথিকৃৎ এ বিশ্ববিদ্যালয় জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কৃষি ক্ষেত্রে সৃষ্ট চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আরও নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করবে এবং ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ গড়ে তুলতে তার অগ্রণী ভূমিকা অব্যাহত রাখতে।
লেখক : অধ্যাপক ড. লুৎফুল হাসান, উপাচার্য, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।