বাংলাদেশি অধ্যক্ষের চোখে লন্ডন - দৈনিকশিক্ষা

বাংলাদেশি অধ্যক্ষের চোখে লন্ডন

অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী |

বৃটেনে আসার পর প্রায় তিন মাস পার হতে চলেছে। লন্ডন শহর ঘুরে দেখা হয়নি। আসার সময় হিথ্রো বিমানবন্দরের কাছে ১৫ দিনের মত হোটেলে থেকেছি। কোয়ারেন্টিন করেছি। একদিনের জন্যও বাইরে বের হওয়ার সুযোগ ছিল না। কোয়ারেন্টিন শেষে সোজা বার্মিংহামে ছেলের কাছে চলে আসি। এর ভেতর একদিন কেবল অক্সফোর্ড ছাড়া বার্মিংহামের বাইরে কোথাও যাওয়া হয়নি। লন্ডনে আমার বেশ কয়েকজন বন্ধু থাকে। কয়েকজন ছাত্রও আছে। এরা প্রায় প্রতিদিন কেউ না কেউ ফোন করে লন্ডনে যেতে বলে। স্নেহের ছাত্র কামরুল লন্ডনের আপটন পার্ক এলাকায় পরিবার নিয়ে থাকে। বাসায় মা, শ্বাশুড়ি, স্ত্রী ও একমাত্র শিশুপুত্র সাহাল। ছিমছাম পরিবার।  আরেক ছাত্রী রুনা ও তার মামা শিহাব ইলফোর্ডে যার যার বাসায় থাকে। শিহাবও আমাদের ছাত্র। খায়রুল থাকে সেন্ট্রাল লন্ডনে। স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে সুন্দর সংসার। 

সিলেট এমসি কলেজের এক সময়ের নির্বাচিত ভিপি ও নব্বই দশকে আলোচিত ছাত্রনেতা খসরুজ্জামান খসরু গ্রিনিচ থাকেন। একদম গ্রিনিচ মানমন্দিরের কাছে। একমাত্র ছেলে সাহাবি এবং স্ত্রী ও কন্যাদের নিয়ে সুখের সংসার। এখানে এনএইচএস বা ন্যাশনাল হেল্থ সার্ভিসের পদস্থ কর্মকর্তা। প্রায় সময় ফোন করে খোঁজ খবর নেন। লন্ডনে বেড়াতে যেতে বলেন।

কানাইঘাট উপজেলার প্রথম নির্বাচিত চেয়ারম্যান মরহুম এমএ রকিব সাহেবের ছেলে বাহার জামানও লন্ডনে থাকেন। হোটেল কোয়ারেন্টিনে থাকার সময় মেসেঞ্জারে টেক্সট দিতেন। ইংলিশ খাবারে অভ্যস্ত নই বলে মাঝে মাঝে কাছাকাছি কোন হোটেলে অনলাইনে অর্ডার করে বাংলা খাবার পাঠাতেন। আমার কয়েকজন কলেজ সহপাঠী ইংল্যান্ডে থাকে। জুবায়ের ও শামীম সেন্ট্রাল লন্ডনে। দুজনে পাশাপাশি এলাকায়। আবিদ সাউথএন্ডে। লন্ডন শহর থেকে ৩০-৪০ মাইল দূরে সমুদ্র সৈকতের কাছাকাছি জায়গায়। রেস্টুরেন্ট ব্যবসা আছে। এক ছেলে এক মেয়ে নিয়ে চমৎকার সুখী সংসার। স্ত্রী আফসানা হোসেন খুব বন্ধুবৎসল ও অতিথিপরায়ন। অত্যন্ত সুন্দর জায়গা। সি-বিচ থাকায় প্রতিদিন প্রচুর লোক সমাগম হয়। 

নজরুল থাকে দূরের শহর ওয়েস্ট ইয়র্কশায়ারে। বার বার ফোন করে যেতে বলে। তারও রেস্টুরেন্ট ব্যবসা। তার ওখানে এখনও যাওয়া হয়নি। দেশে ফেরার আগে অন্তত একবার তাকে দেখতে যাওয়ার ইচ্ছে আছে। সালাহ উদ্দিন থাকে নিউ ক্যাসেলে। ট্র্যাভেলস ব্যবসা করে বলে জানিয়েছে। আবিদের সাথে এখন শুধু ফেসবুকে যোগাযোগ। গতদিন ফোনে কথা হয়েছে। কলেজ জীবনের পর এদের সাথে দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে দেখা নেই। সহপাঠীদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি এত প্রেম, এত ভালবাসা-ইংল্যান্ড এসে আবার নতুন করে উপলব্ধি করলাম। একেবারে আপন সহোদর ভাই বোনের মত। ছাত্র-ছাত্রীরা শিক্ষককে কত ভালবাসে তা এখানে এসে জিয়া, কামরুল, খায়রুল, শিহাব, রুনা ও শাহেদদের কাছ থেকে ভাল করে জানা হলো।

গত ২৯ আগস্ট কামরুল প্রায় ১৩০ মাইল গাড়ি চালিয়ে বার্মিংহাম থেকে লন্ডনের আপটন পার্কে তার বাসায় নিয়ে যায়। আপডাউন মিলে ২৬০ মাইল গাড়ি চালিয়েও তার মাঝে এতটুকু ক্লান্তি ছিল না। তার বাসায় প্রায় এক সপ্তাহ থেকে পুরো লন্ডন শহর ঘুরে বেড়িয়েছি। আপটন পার্ক স্টেশন থেকে পাতাল রেলে চড়ে লন্ডনের দর্শনীয় জায়গাগুলো ঘুরে ঘুরে দেখে উপভোগ করেছি। এ দেশে ট্রেন সার্ভিস খুব ভাল। বিশেষ করে পাতাল রেলে চড়তে বেশি আনন্দ লাগে। খুব অল্প সময়ে লন্ডন শহরের যে কোন স্থান ঘুরে আসা যায়। স্টেশনে কিংবা রেলে হৈচৈ নেই। ক্রেডিট কার্ড বা ফেয়ার কার্ড থাকলে টিকেট কেনার ঝামেলা নেই ৷ কার্ড ঘষলেই প্রবেশ পথ খুলে যায়। পাতাল রেলে কার্ড ঘষে ভাড়া পরিশোধ করতে হয়। টিকিটের কোন ব্যবস্থা নেই। প্রয়োজনে বার বার রেল পরিবর্তন করতে অসুবিধা নেই। প্রবেশ স্টেশনে একবার আর বের হওয়ার  স্টেশনে আরেকবার কার্ড ঘষতে হয়। এ দেশে প্রায় সব কিছুতে কার্ড ঘষে বিল পরিশোধ করা যায়। নগদ টাকা পয়সা নিয়ে কোথাও যাওয়ার দরকার নেই। কার্ডের মাধ্যমে দৈনন্দিন কেনাকাটার কাজ চালানো যায়। পাতাল রেল ছাড়া অন্য ট্রেনে টিকেট কেনেও ভাড়া পরিশোধ করা যায়। টিকেট কেনার প্রয়োজন হলে ট্রেন ছাড়ার পাঁচ মিনিট আগে অনায়াসে কেনা যায়। টিকেট কেনা নিয়ে এ দেশে তেলেসমাতি নেই। সময়ের এতটুকু হেরফের নেই। পাঁচ মিনিট পর পর ট্রেন আসে আর যায়। একটা স্টেশনে সর্বোচ্চ ২-৩ মিনিট থেমে পুনরায় ছেড়ে দেয়। এই সময়ের মধ্যে যাত্রীরা অনায়াসে উঠানামা করতে পারে। কোথাও কোথাও চলন্ত সিঁড়ি কিংবা লিফট দিয়ে অনেক নীচে নেমে পাতাল রেল ধরতে হয়। একটা পাতাল রেল পথের উপর দিয়ে কোথাও একাধিক পাতাল রেল পথ আছে। সত্যি অবাক হওয়ার মত।

পরদিন শিহাব আমাকে তার বাসায় নিতে আপটন পার্কে আসে। ইলফোর্ডে বাসা। রুনাকে  আমার কথা জানালে আমরা তার বাসায় যাওয়ার আগেই রুনা সেখানে এসে পৌঁছে যায়। রুনার দুই সন্তান। এক ছেলে এক মেয়ে। আমাকে পেয়ে মামা ও ভাগনির সে কী যে আনন্দ ! 

রুনা নিজ হাতে রান্না করে। দুপুরে এদের ওখানেই খাওয়া দাওয়া করি। বিকেলে শিহাব বাসে উঠিয়ে দেয়। এদেশের বাস সার্ভিস খুবই আরামদায়ক। দু'তলা বাস। বাসের ভেতর সত্যিকারের বিমানের ছোঁয়া। সিটগুলো ফাঁকা ফাঁকা। কার্ড ঘষে ভাড়া দিতে হয়। কোন হেলপার নেই। একজন মাত্র ড্রাইভার। একটা স্টেশন ছাড়ার পর পরবর্তি স্টেশনের নাম ডিসপ্লেতে ভেসে উঠে এবং সাউন্ড সিস্টেমে বড় করে বলে দেয়। ফলে অপরিচিত জায়গায় যেতে কোন অসুবিধা হয় না। লন্ডন শহরে নগদ টাকায় বাস ভাড়া দেয়া যায় না। সব ভাড়া ক্রেডিট কার্ড কিংবা ফেয়ার কার্ড ঘষে পরিশোধ করতে হয়। লন্ডনের বাইরে নগদ টাকা পরিশোধ করে বাসের টিকিট কেনা যায়। ড্রাইভারের কাছাকাছি জায়গায় অটো মেশিনে নির্দিষ্ট ভাড়ার টাকা রেখে দিলে অটোমেটিক টিকেট বেরিয়ে আসে। এই টিকেট দিয়ে একই বাস কিংবা ঐ গ্রুপের যে কোন বাসে সারা দিন চড়ে শহর ঘুরা যায়। সিটের কাছাকাছি জায়গায় ‘স্টপ’ লেখা বোতাম থাকে। সেটি চাপলেই বাস থেমে যায়। তাই বাসে কোন হৈচৈ নেই। সন্ধ্যা হওয়ার বেশ কিছু আগেই কামরুলের বাসায় ফিরে আসি।

সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় কামরুল কাজ থেকে বাসায় ফেরে। আটটায় মাগরিবের নামাজ পড়ে এশার নামাজ ইস্ট লন্ডন জামে মসজিদে পড়ার জন্য রওয়ানা হই। সাড়ে নয়টায় এশার জামাত। কামরুলের বাসার অনতিদূরে পাতাল রেল স্টেশন। পায়ে হেঁটে যাওয়া যায়। দুই-তিন মিনিট লাগে। আপটন পার্ক রেল স্টেশন। কামরুল দু'টো ক্রেডিট কার্ড সাথে নেয়। একটি আমি এবং অন্যটি নিজে ব্যবহার করে। স্টেশনে প্রবেশমুখে নির্দিষ্ট জায়গায় কার্ড ঘষে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে যাই। ট্রেনে উঠে পড়ি। জীবনে এই প্রথম পাতাল রেলে চড়া। পাতাল রেলে আলাদা আলাদা বগি নেই। লাগাতার একই কামরা। সিটগুলো ভেতরে গাড়ির দু' পাশে। মাঝখানে সিট নেই। একদম খালি। যাত্রীরা সামনা সামনি হয়ে বসে। 

স্টেশনে পৌঁছানো মাত্র অটোমেটিক ট্রেনের দরজা খুলে যায়। যাত্রীরা দ্রুত ট্রেন থেকে নেমে পড়ে। নতুন যাত্রী উঠে। বাসের মত ট্রেনেও এক স্টেশন ছাড়ার পর কম্পিউটারে পরবর্তী স্টেশনের নাম বলে দেয়। গল্পে গল্পে আমরা হোয়াইটচ্যাপেল স্টেশনে পৌঁছে যাই। এর অনতিদূরে ইস্ট লন্ডন জামে মসজিদ। ট্রেন থেকে নেমে পায়ে হেঁটে মসজিদে পৌঁছাই। 

বিশাল মসজিদ। এটি ইউরোপের সর্ববৃহৎ মসজিদগুলোর অন্যতম। ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দে মসজিদটির তিন তলা বিশিষ্ট ভবনের কাজ শুরু হয়েছিল। এই মসজিদে এক সাথে সাত হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। এটি বাংলাদেশি মুসলমানেরা প্রতিষ্ঠা করেছেন। বৃটেনে ইসলামিক সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারে মসজিদটি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে থাকে। মসজিদে জামাতে এশার নামাজ আদায় করি। মসজিদের ভেতরে লন্ডনে দীর্ঘদিন থেকে বসবাসকারী এলাকার জনৈক সৈয়দ জামালের সাথে দেখা হয়ে যায়। নামাজ শেষে মসজিদের পাশে একটি বাঙালি রেষ্টুরেন্টে তিনজনে চা খেয়ে আলতাব আলী পার্ক ও ব্রিকলেইন জামে মসজিদ দেখতে যাই। 

ব্রিকলেন মসজিদটিও অনেক বড়। ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে বৃটেনের বাংলাদেশি মুসলমানেরা এই মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করেন। পুরো এলাকাটি বাঙালি অধ্যুষিত। প্রতিটি রাস্তার নাম ইংরেজির সাথে বাংলায় লেখা দেখতে পাই। অনেককে বাংলায় কথা বলতে শুনি। ইস্ট লন্ডন মসজিদের অনতিদূরে আলতাব আলী পার্ক। পার্কটি জনৈক সিলেটি আলতাব আলীর নামে। তিনি ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দে কাজ থেকে বাসায় ফেরার পথে বর্ণবাদীদের হামলায় নিহত হয়েছিলেন। এদেশে একজন ফ্যাক্টরি শ্রমিক ছিলেন। এই পার্কের দক্ষিণ প্রান্তে আমাদের মহান ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে বাঙালিরা একটি শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠা করেছেন। ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত শহীদ মিনারটি বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের তৎকালীন স্পিকার মরহুম হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী উদ্ধোধন করেছিলেন। এই শহীদ মিনারে বৃটেনের বাংলা ভাষাভাষীরা শহীদ দিবস তথা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন করেন। এছাড়া এখানে বাঙ্গালিরা বিভিন্ন সময়ে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উদযাপন করে থাকেন। 

রাত এগারটার দিকে আমরা ফিরতি পথে রওয়ানা দেই। হোয়াইটচ্যাপেল পাতাল রেল স্টেশন থেকে পুনরায় পাতাল রেলে চড়ি। ২৫-৩০মিনিট সময়ে আপটন পার্ক স্টেশনে ফিরে আসি।

পরদিন কামরুলের ছুটি। ঘুমাতে যাবার আগে দু'জনে মিলে বৃটিশ পার্লামেন্ট, টাওয়ার ব্রিজ, বাকিংহাম প্যালেস ঘুরতে যাবার সিদ্ধান্ত নেই। সেন্ট্রাল লন্ডন থেকে খায়রুল আমাদের সাথে বৃটিশ পার্লামেন্ট ভবনের সামনে দেখা করার কথা জানায়। ভিপি খসরুজ্জামান দুপুরে তার বাসায় লাঞ্চের দাওয়াত দিয়ে টেলিফোন করেন। তার বাসার অনতিদূরে গ্রিনিচ পার্ক, গ্রিনিচ মান মন্দির, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বৃটিশ বাহিনীর ব্যবহৃত যুদ্ধ জাহাজ ক্যাটি সার্ক ও টেমস নদীর সুড়ঙ্গ পথ রয়েছে বলে জানান। লাঞ্চের পর পুরো বিকেল আমাদের নিয়ে এসব দর্শনীয় জায়গা ঘুরে ঘুরে দেখাবেন এবং সন্ধ্যায়  তার গাড়ি দিয়ে আমাদের আপটন পার্কে পৌঁছে দেবেন বলে আশ্বস্ত করেন। পরদিনের সিডিউল ঠিক করে ঘুমাতে রাত সাড়ে বারোটা বেজে যায়।

পরদিন সকালে গোসল ও নাস্তা সেরে দশটায় নিকটস্ত পাতাল রেল স্টেশনে পৌঁছি। পাতাল রেলে চড়ে আমরা দ্রুততম সময়ে ওয়েস্টমিনস্টার পৌঁছে যাই। মাঝপথে একবার ট্রেন বদলাতে হয়েছে। ওয়েস্ট মিনস্টার ব্রিজ থেকে লন্ডন আই ও লন্ডন ব্রিজ এবং টেমস সংলগ্ন লন্ডন শহরের বড় একটা অংশ দেখা যায়। এই ব্রিজে অসংখ্য দর্শনার্থীর ভীড়। ব্রিজের এক মাথায় টেমস নদীর তীরে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ভবন। এক হাজার বছরের ও বেশি সময় ধরে এই ভবনটি পার্লামেন্ট ভবন হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এর আগে এটি রাজকীয় বাসস্থান হিসেবে ব্যবহৃত হত। এই ভবনে হাউস অব লর্ডস ও হাউস অব কমন্সের অধিবেশন বসে। সামনে পার্লামেন্ট স্কয়ার। এই স্কয়ারে মহাত্মা গান্ধী ও নেলসন ম্যান্ডেলার মত বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিদের প্রতিকৃতি রয়েছে। পার্লামেন্ট ভবন ও স্কয়ার থেকে বাকিংহাম প্যালেস পায়ে হেঁটে পাঁচ মিনিটের রাস্তা। 

প্রিয় ছাত্র খায়রুল এসে বাকিংহাম প্যালেসের সামনে আমাদের সাথে মিলিত হয়। বাসা থেকে প্যাকেটে করে নাস্তা ও পানীয় নিয়ে আসে। বাকিংহাম পার্কে বসে নাস্তা পানি খেয়ে কামরুল ও খায়রুলকে নিয়ে বাকিংহাম প্যালেসের চারদিক ঘুরে দেখি। এর চারপাশের বিরাট পার্ক ও বাগানগুলো ঘুরে দেখতে বহু সময় লেগে যায়। এটি মূলত বৃটিশ রাজ পরিবারের লন্ডনের বাসস্থান। বর্তমান পৃথিবীতে বিদ্যমান বৃহত্তম রাজকীয় প্রাসাদ। নির্মাণকালে এর নাম ছিল বাকিংহাম হাউজ। এটি এখন পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ। প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক বাকিংহাম প্রাসাদ দেখতে আসেন।

বাকিংহাম প্যালেস, পার্ক ও গার্ডেন ঘুরে অনেকটা ক্লান্ত হয়ে পড়ি। খায়রুলের কাজ থাকায় সে বিদায় নিলে আমি ও কামরুল ওয়েস্টমিনস্টার পাতাল রেলস্টেশন থেকে গ্রিনিচের পথে যাত্রা করি। অল্প সময়ের মধ্যে  গ্রিনিচ রেলস্টেশনে পৌঁছে যাই। স্টেশন থেকে খসরু ভাইকে টেলিফোন করি। দশ মিনিটের ভেতর স্টেশনে এসে তিনি আমাদের রিসিভ করেন। একমাত্র ছেলে সাহাবি গাড়ি চালিয়ে বাসায় আমাদের নিয়ে যায়। লাঞ্চের সময় পেরিয়ে যায়। জোহরের নামাজ আদায় করে খেতে বসি। স্বদেশি খাবার আর ভাবি ও খসরু ভাইয়ের আতিথেয়তায় উদর ও মন দু'টো ভরে যায়। বাসার পেছনে শাক-সবজির বাগান। ভাবি নিজ হাতে বিভিন্ন জাতের দেশি শাক-সবজি লাগিয়েছেন। আমাদের দেশের সুপারি গাছের নীচের ধনিয়া পাতা পর্যন্ত বাদ যায়নি। গার্ডেন দেখতে গিয়ে মনে হয়েছে একখণ্ড বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে আছি।

একটু বিশ্রাম নিয়ে আমরা গ্রিনিচ পার্কে বেড়াতে যাই। প্রথমে গ্রিনিচ মান মন্দির পর্যবেক্ষণ করি। এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বৃটিশ বাহিনীর ব্যবহৃত যুদ্ধ জাহাজ ক্যাটি সার্ক দেখতে যাই। এর অদূরে টেমস নদী পায়ে হেঁটে পার হবার সুড়ঙ্গ পথ। সুড়ঙ্গের ভেতরে নেমে অনেক দূর পর্যন্ত হেঁটে আসি। তারপর গ্রিনিচ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে দিয়ে টেমস নদীর তীরে হেঁটে হেঁটে খসরু ভাইয়ের বাসায় ফিরে আসি। পথে দূর থেকে লন্ডনের মিলেনিয়াম ডোমেইন দেখতে পাই। সন্ধ্যা হবার সাথে সাথে সাহাবি গাড়ি চালিয়ে লন্ডনের টেমসের আরেক সুড়ঙ্গ পথে আমাদের আপটন পার্কে পৌঁছে দেয়। সাথে খসরু ভাই এবং ভাবিও। 

পরদিন বৃটিশ লাইব্রেরি এবং বৃটিশ মিউজিয়াম দেখতে যাই। দুপুরে খায়রুলের বাসায় লাঞ্চের দাওয়াত। সকাল দশটায় আপটন পার্ক রেল স্টেশন থেকে পাতাল রেলে চড়ে ইউস্টন স্টেশনে যাই। বিরাট রেল স্টেশন। এই স্টেশন থেকে পাতাল রেলে চড়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যাওয়া যায়। স্টেশন থেকে পায়ে হেঁটে বৃটিশ লাইব্রেরিতে যাই। বিরাট লাইব্রেরি। প্রায় ৫০ বছর থেকে এটি লাইব্রেরি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এর আগে এটি বৃটিশ যাদুঘরের অংশ ছিল। এটি বিশ্বের বৃহত্তম লাইব্রেরিগুলোর অন্যতম। এখানে ২০০০ খ্রিষ্টপূর্বের নানা নিদর্শনসহ প্রায় ১৪ মিলিয়ন বই রয়েছে। এটি যুক্তরাজ্যের জাতীয় গ্রন্থাগার। এই গ্রন্থাগারটি মুলত একটি গবেষণা গ্রন্থাগার। ইউস্টন রেল স্টেশনের কাছাকাছি ইউস্টন রোডে লাইব্রেরিটির অবস্থান। লাইব্রেরিটি ঘুরে ঘুরে দেখা শেষ হতে না হতে জুমার নামাজের সময় হয়ে যায়। ততক্ষণে খায়রুল তার ছেলেকে নিয়ে লাইব্রেরির সামনে এসে ফোন দেয়। আমরা লাইব্রেরি থেকে বের হয়ে জুমার নামাজ আদায় করতে মসজিদের দিকে রওয়ানা দেই। নামাজ পড়ে পায়ে হেঁটে খায়রুলের বাসায় গিয়ে লাঞ্চ সেরে নেই। 

লাঞ্চের পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে বৃটিশ মিউজিয়ামের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ি। বৃটিশ লাইব্রেরি থেকে বৃটিশ মিউজিয়াম খুব একটা দূরে নয়। একটি থেকে আরেকটিতে হেঁটে যাওয়া যায়। খায়রুলের বাসা থেকে খুব বেশি দূরে নয়। পায়ে হেঁটে পাঁচ মিনিটের রাস্তা। এটি ‘গ্রেট রাসেল স্ট্রিটে’ অবস্থিত। বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ যাদুঘরগুলোর অন্যতম। পৃথিবীর নানা অঞ্চলের মানুষের সংস্কৃতির শুরু থেকে বর্তমান পর্যন্ত প্রায় ১৩ মিলিয়ন নিদর্শন এতে সংরক্ষিত আছে। এই যাদুঘরটি ১৭৫৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৭৭৯ খ্রিষ্টাব্দ থেকে এটি সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। বিশাল বৃটিশ লাইব্রেরি ও যাদুঘর ঘুরে দেখতে দেখতে এক সময় ক্লান্ত হয়ে পড়ি। খায়রুলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পাতাল রেলে চড়ে আপটন পার্কে কামরুলের বাসায় ফিরে আসি। রাতে সহপাঠী বন্ধু জুবায়ের গাড়ি নিয়ে তার বাসায় নিতে আসে। সেন্ট্রাল লন্ডনে তার বাসায় যেতে যেতে জুবায়ের আমাদের আরেক সহপাঠী শামীম চৌধুরীকে টেলিফোন করে। আমরা জুবায়েরর বাসায় পৌঁছতে না পৌঁছতে শামীম এসে যায়। দীর্ঘদিন পর তিন সহপাঠীর সাক্ষাৎ। পরস্পরকে পেয়ে সে কী যে আনন্দ! কলেজ জীবনের শত স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে অনেক রাত কেটে যায়। সে রাতটি কেন জানি আমার কাছে খুব ছোট্ট একটি রাত মনে হয়েছে।

পরদিন আফসানা ভাবির বড় ভাইয়ের সাথে আপটন পার্ক থেকে তার গাড়িতে চড়ে আরেক সহপাঠী বন্ধু আবিদের সাথে সাক্ষাৎ করতে সাউথএন্ডের দিকে যাত্রা করি। লন্ডন শহর থেকে ৩৫-৪০ মাইল দূরের পথ। রাস্তার দু'পাশের সৌন্দর্য দেখে দেখে কখন যে আবিদের বাসার সামনে গিয়ে গাড়ি পৌঁছে যায়, তা' টের পাইনি। আমাকে পেয়ে আবিদের সে কী যে আনন্দ ! আনন্দের আতিশয্যে দু'জন দু'জনকে জড়িয়ে ধরি। বিকেলে আবিদের অন্য একটি জরুরি কাজ থাকায় জনৈক সামছ উদ্দিন চাচাকে মিলিয়ে দিয়ে কিছু সময়ের জন্য সে চলে যায়। সামছ উদ্দিন চাচা সত্তরের দশক থেকে ইংল্যান্ডে বসবাস করেন। অভিজ্ঞ মানুষ। নিজের ব্যবসা ও কয়েকটি ফ্ল্যাট বাড়ি আছে। সাউথএন্ডে একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভুমিকা পালন করেছেন। মসজিদের পাশেই 'সামছুদ্দিন কোর্ট' নামে তার একটি ফ্ল্যাট বাড়ি। এখানে ইংল্যান্ড বড় বড় অনেক ভবনের নামের সাথে কোর্ট শব্দটি সংযুক্ত থাকে। প্রকৃতপক্ষে এসব আদালত অর্থে কোর্ট নয়। মুলত এসব কোর্ট দ্বারা বৃহৎ ভবনই বুঝায়। সামছুদ্দিন চাচা বাঙালি কমিউনিটির বহুল পরিচিত মানুষ। তার গাড়ি দিয়ে পুরো সন্ধ্যা আমাকে নিয়ে 'সাউথ এন্ড অন সি' তে অতিবাহিত করেন। বয়স অনেক হলেও প্রাণবন্ত ও বন্ধুবৎসল মানুষ। সন্ধ্যায় চাচার বাসায় ফিরে নানা খোশগল্প করে এবং চাচার কাছ থেকে বিলেতে বাংলাদেশিদের জীবনযাত্রার অনেক কাহিনী শুনে সত্যি মুগ্ধ হই। এরপর রাতে আবিদের বাসায় আমি, সামছুদ্দিন চাচা ও আবিদ এক সাথে খাওয়া দাওয়া করি। চাচা তার বাসায় ফিরে গেলে আমরা দু'জন অতীত স্মৃতির মধ্যে বেশ কিছু সময় হারিয়ে যাই। পরদিন ক্যামব্রিজ যাবো বলে আর দেরি না করে ঘুমিয়ে পড়ি।

গত সন্ধ্যায় 'সাউথে এন্ড অন সি' তে জোয়ার ছিল না বলে সমুদ্রের ভরা যৌবন দেখতে সকালে নাস্তা সেরে আমি ও আবিদ আবার সৈকতে যাই। জোয়ারের পানি তখন একেবারে কানায় কানায় ভরা। হৃদয় যেন অন্য এক প্রশান্তিতে ভরে যায়। বহু বছর পর এক সাথে রৌদ্র ঝলমল সকালটি কেবলি একান্ত আমাদের দু'জনের হয়ে উঠে। সমুদ্রের অথৈ জলরাশির ঢেউ মনের প্রশান্তি আরো বাড়িয়ে দেয়। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় দেখতে যাবার তাড়া না থাকলে পুরো দিনটিই সেদিন সৈকতে কাটিয়ে দিতাম। বাসায় ফেরে দ্রুত  ক্যামব্রিজের পথে বের হয়ে পড়ি। আবিদ নিজে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যায়। আফসানা ভাবি এবং ভাতিজা তাজওয়ারও আমাদের সফরসঙ্গী হয়। এক অনাবিল আনন্দ নিয়ে ক্যামব্রিজের পথে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলে। কলেজ জীবনের শত স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে কখন যে আমরা ক্যামব্রিজ শহরে পৌঁছে যাই, তা এতটুকু টের পাইনি। 
ততক্ষণে আফসানা ভাবি ও ভাতিজা তাজওয়ার গাড়ির ভেতর তন্দ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছেন। ক্যামব্রিজ শহরের সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন মসজিদের আন্ডারগ্রাউন্ড পার্কিংয়ে গাড়ি রেখে জোহরের নামাজ আদায় করতে আমরা মসজিদে প্রবেশ করি। মসজিদটি আধুনিক স্থাপত্য ও নির্মাণ শৈলিতে গোটা ইংল্যান্ডে অদ্বিতীয় ও অনন্য বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। ক্যামব্রিজের দৃষ্টিনন্দন মসজিদ ও ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আরেকদিন লিখার প্রত্যাশায় আজ এখানেই শেষ করছি।

লেখক : অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী, অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট এবং দৈনিক শিক্ষার নিজস্ব সংবাদ বিশ্লেষক, বর্তমানে যুক্তরাজ্যে সফররত।

শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0090949535369873