বিতর্কিতদের দূরে রাখুন - Dainikshiksha

বিতর্কিতদের দূরে রাখুন

মো. সিদ্দিকুর রহমান |

সমাজের অবক্ষয়ে জনজীবনে ভীষণ অসহায়ত্বের ভাবনা দেখা দেয়। এমন লোকদের মন্তব্য, সব শেষ। দেশ, সমাজ সবই রসাতলে যাচ্ছে। এর মাঝেও কিছু আদর্শবান ব্যক্তি মাথা উঁচু করে সমাজে বসবাস করে আসছেন। তাদের মধ্যে শিক্ষক, মসজিদের ইমাম, শিল্পী, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক অন্যতম। কিছু বাস্তব ঘটনা নিয়ে সমাজে তাদের অবস্থান আলোকপাত করছি।
পল্লীগীতির মরমী শিল্পী আবদুল আলীম স্বাধীনতার আগে ঢাকার কমলাপুরে বসবাস করতেন।

একদিন রাতে তার বাসায় চুরি হল। তিনি ঢাকার বাইরে থাকায় পরদিন বাসায় এসে জানলেন রান্নাঘরের হাঁড়ি, পাতিল, থালা, বাটি সবই চোর নিয়ে গেছে। যেহেতু পরিবারের সদস্যদের খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে তাই রান্নার উপকরণসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী কেনার জন্য বাজারের উদ্দেশে রওনা দিলেন। বাড়ি থেকে বের হয়ে গেটের পাশে সরু গলিতে বস্তাভর্তি কী যেন পড়ে থাকতে দেখা গেল। বস্তা খুলে দেখলেন তার সব মালামাল অক্ষত অবস্থায় আছে, সঙ্গে চোরের হাতে লেখা একখানা পত্রও। চোর অতি বিনয়ের সঙ্গে লিখেছে, ‘আমি ক্ষমাপ্রার্থী। জানতাম না এটা শিল্পী আবদুল আলীমের বাসা ও এগুলো তারই মালামাল।’ শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানিয়ে এবং নিজের অপরাধের জন্য বিনম্র চিত্তে আবার ক্ষমা চেয়ে তার চিঠির বক্তব্য শেষ করেছে। সমাজে চিহ্নিত খারাপ ব্যক্তিরাও শিক্ষককে সম্মান জানাতে কার্পণ্য করে না।

আরেকটা ঘটনা নব্বইয়ের দশকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। ঢাকার দক্ষিণ বাসাবো বিদ্যালয় থেকে আমাকে বদলি করা হল খিলগাঁওয়ের হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এরশাদ সরকারের শাসনের পর সারা দেশের ১৪টি বিদ্যালয়ের মতো আমার ভাগ্যেও জুটল ছয় বছর অনিয়মিত বেতন পাওয়ার যন্ত্রণা। রিটেনশন আদেশ প্রদানের বিলম্বের কারণে ২-৩ বছর পরপর বেতন পেতাম। তাই বিদ্যালয়ের পাঠদান শেষে প্রতিনিয়ত মন্ত্রণালয়ে যেতে হতো। তখন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব ছিলেন মঈনুল হোসেন। তিনি একদিন ক্ষিপ্ত হয়ে আমাকে বললেন, ‘কেন আপনি প্রতিদিন বিরক্ত করছেন?’ আমি বললাম, ‘আমি তো মনের সুখে আপনাকে বিরক্ত করছি না। আপনি অফিস আদেশে স্বাক্ষর করলে আমরা দীর্ঘ সময়ের বেতন পাব। এ জন্য আপনার কাছে আসতে হয়। দিবারাত্রি, শয়নে-স্বপনে আপনার ছবি মনের গহিনে ভেসে ওঠে। বেতন প্রাপ্তির আদেশের জন্য নির্দিষ্ট একটা তারিখ বলে দিন, এর মাঝখানে আর মন্ত্রণালয়ে আসব না। আপনিও বিরক্ত হবেন না।’

তাতে মঈনুল হোসেন আরও ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, জানেন আমার আর আপনার স্ট্যাটাসের পার্থক্য? প্রত্যুত্তরে বললাম, স্যার, আপনার স্ট্যাটাস সম্পর্কে আমার তেমন কোনো ধারণা নেই। তবে আমি একজন শিক্ষক, এর চেয়ে বেশি কিছু আমার জানা নেই। তার সঙ্গে কথা না বাড়িয়ে স্বীয় মনে অহংকার করতে করতে ২-৩ বছর বেতন না পাওয়ার যন্ত্রণা ভুলে প্রলাপ বকতে বকতে ঘরে ফিরে এলাম। দুঃখভরা মনে ভাবলাম, এ ধরনের লোকেরা কি জানে না শিক্ষকরা জাতি গড়ার কারিগর, তাদের মর্যাদা সবার শীর্ষে?

শিক্ষিত জাতি গঠনে প্রাথমিক শিক্ষকদের অবদান শীর্ষে। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নোয়াখালীর এক জনসমুদ্রের মাঝে তার শৈশবের শিক্ষককে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানিয়ে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা করেছেন। রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ তার প্রাথমিক শিক্ষক মানিকগঞ্জের মফিজ মাস্টারকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য তার বাড়ি গিয়ে জীর্ণ কুটির নতুন গৃহে রূপান্তরিত করেছেন। বাদশাহ আলমগীরসহ আরও অনেকের উদাহরণ আর নাই লিখলাম। শিক্ষা ও শিক্ষকদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রয়েছে অপরিসীম ভালোবাসা। অথচ তার স্বপ্ন বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছেন মঈনুল হোসেনের কতিপয় অনুসারীরা।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মহোদয়ের তথ্য মোতাবেক ৫০ হাজার শিক্ষকের পদ শূন্য। এ অবস্থায় শূন্যপদগুলো দ্রুত পূরণ না করলে শিগগিরই বিদ্যালয়গুলো শিক্ষকশূন্য হয়ে পড়বে। সারা দেশে শিক্ষক সংকটের পাশাপাশি পাঠদানবহির্ভূত কাজের চাপে গরিব মানুষের সন্তানদের প্রাথমিক শিক্ষা আজ বিপন্ন হতে চলেছে। সরকারের নতুন স্লোগান ‘মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা’ আজ প্রাণহীন হয়ে শিকেয় উঠতে বসেছে। মন্ত্রী, সচিবসহ বড় বড় কর্মকর্তাদের কোনো পদ শূন্য নেই। তাদের তেমন কোনো সংকটও দৃশ্যমান নয়। তাদের শূন্যপদ পূরণ বা সংকট নিরসনে সময়ক্ষেপণ হয় না। অথচ সহকারী শিক্ষকদের বেতনবৈষম্য, প্রধান শিক্ষকদের ২য় শ্রেণীর মর্যাদায় ১৬০০০ টাকার স্কেলসহ নানা খুঁটিনাটি সমস্যা সবই যেন মঈনুল হোসেন গং ৩-৪ বছর ঝুলিয়ে রেখে হাইকোর্টে রিটের কথা বলে নিজেদের দায় এড়িয়ে যাচ্ছে। অধিকার বা পাওনা থেকে বঞ্চিত হলে রিট গৃহীত হয়।

প্রাথমিক শিক্ষকদের কী দায় পড়েছে বিপুল অর্থ ব্যয় করে রিট করার? প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সময়ক্ষেপণ করে আজ শিক্ষাবান্ধব সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করে চলছে। সর্বস্তরের মানুষের কাছে আজও শিক্ষক সমাজ সম্মানের পাত্র। এর অন্যতম কারণ প্রায় সবাই কমবেশি শিক্ষকদের কাছে লেখাপড়া শিখেছে। আমাদের ব্যর্থতা সন্ত্রাসীদের সুশিক্ষা দিতে পারি নাই। বাস্তবে এ জন্য প্রকৃত শিক্ষকরা দায়ী নন। নানাভাবে দলীয় বিবেচনায় কতিপয় ব্যক্তি শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়ে শিক্ষকতার আদর্শকে কলঙ্কিত করে মানসম্মান ধুলায় মিশিয়ে দিচ্ছে।

সংবাদপত্রের মাধ্যমে জানা গেল, ৯ সেপ্টেম্বর সকাল ১০টার দিকে কুষ্টিয়ার দৌলতপুর কলেজের ভূগোল বিভাগের প্রদর্শক (ডেমনস্ট্রেটর) জহুরুল আলম আওয়ামী লীগ নেতা ও কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ছাদিকুজ্জামান খানের কাছে যান। তিনি ঈদুল আজহার বোনাসের বিষয়ে জানতে চান। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ওই বোনাসের টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে তাকে বলেন, সবার ঈদ বোনাসের টাকা অন্য খাতে ব্যয় করা হবে। এই নিয়ে দু’জনের মধ্যে বাকবিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে ছাদিকুজ্জামান তার লাইসেন্স করা পিস্তল বের করে জহুরুলকে হুমকি দেন। তাকে কলেজের সীমানার বাইরে চলে যেতে বলেন। এই ঘটনার পর তিনি চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। তিনি বলেন, অধ্যক্ষের কক্ষে সিসি ক্যামেরা আছে। ফুটেজ দেখলে ওই দিন কী ঘটেছিল, সব ধরা পড়বে। ছাদিকুজ্জামান উপজেলা আওয়ামী লীগের শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক। তা ছাড়া তার ঠিকাদারি ব্যবসা রয়েছে।

গাজীপুরের মরহুম আহসানউল্লাহ মাস্টার পরবর্তীকালে শ্রমিক ও জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতৃত্বে অবস্থান করেছিলেন। শিক্ষকতার মহান আদর্শে বলীয়ান হয়ে রাজনৈতিক নেতৃত্বে জনপ্রিয় হয়েছেন এমন ব্যক্তির সংখ্যা অনেক। রাজনীতিক ও ব্যবসায়ী শিক্ষক হয়ে লাইসেন্সপ্রাপ্ত পিস্তল দিয়ে শিক্ষা দেয়া ঘৃণ্য কাজ ও শিক্ষকতার আদর্শের পরিপন্থী।

শিক্ষকতা মহান পেশা। এ পেশায় শিক্ষকের কাছে কাগজ, কলম, বই থাকবে এটাই স্বাভাবিক। ব্যবসায়ী বা রাজনৈতিক ব্যক্তিদের কাছে যা থাকার কথা তা শিক্ষকের কাছে থাকার কথা নয়। শিক্ষক হবেন সব দলমতের ঊর্ধ্বে সম্মানিত ব্যক্তি। শিক্ষকতা পেশা গ্রহণের সঙ্গে তার পূর্বদলীয় বা ব্যবসায়ী পদবির কর্মকাণ্ড ছেড়ে দেয়ার কথা। হাতে থাকবে বই-খাতা-কলম বা শিক্ষাসামগ্রী। এর ব্যতিক্রম মোটেই কাম্য নয়। প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিনীত আবেদন, দলবাজ-পিস্তলবাজ শিক্ষকদের দূরে রেখে সরকারের পথে সব চ্যালেঞ্জ উপড়ে ফেলে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা কায়েম করুন।

মো. সিদ্দিকুর রহমান: আহবায়ক, প্রাথমিক শিক্ষক অধিকার সুরক্ষা ফোরাম ও দৈনিক শিক্ষার সম্পাদকীয় উপদেষ্টা।

প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ জুনের মধ্যে: প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ জুনের মধ্যে: প্রতিমন্ত্রী পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের - dainik shiksha পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের ঝরে পড়াদের ক্লাসে ফেরাতে কাজ করছে সরকার - dainik shiksha ঝরে পড়াদের ক্লাসে ফেরাতে কাজ করছে সরকার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি, ভাইবোন গ্রেফতার - dainik shiksha প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি, ভাইবোন গ্রেফতার ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি - dainik shiksha ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন প্রায় শূন্যের কোটায় - dainik shiksha শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন প্রায় শূন্যের কোটায় ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে - dainik shiksha ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0035231113433838