রাজধানী ও আশপাশের এলাকাগুলোয় গড়ে উঠেছে নকল প্রসাধনী ও কৌটা তৈরির কারখানা। কেউ যেন সন্দেহ করতে না পারে, সেজন্য কারখানার সামনে টানিয়ে রাখা হয়েছে স্কুলের সাইনবোর্ড। এসব কারখানায় উৎপাদিত নকল পণ্য দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মোড়কে বাজারে ছড়িয়ে দিচ্ছে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। আরেকটি চক্র দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে মেয়াদোত্তীর্ণ প্রসাধনী দেশে এনে টেম্পারিং করে তারিখ পরিবর্তন করে বাজারে বিক্রি করছে। লাগেজ পার্টির মাধ্যমে এসব পণ্য দেশের বাজারে প্রবেশ করে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, রাজধানীর ইসলামবাগ, কামরাঙ্গীরচর, কেরানীগঞ্জের জিনজিরা এলাকায় দুই শতাধিক খুপরি কারখানায় নকল প্রসাধনী পণ্য ও মোড়ক উৎপাদন করে চকবাজার, সোয়ারীঘাট, নবাব কাটারা পাইকারি মার্কেটগুলোর মাধ্যমে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। কারখানার সামনে স্কুলের সাইনবোর্ড টানিয়ে রাখা হয়েছে। বেশি মুনাফা হয় বলে পাইকারদের কাছে এসব পণ্যের চাহিদা বেশি।
মোড়ক তৈরি হয় এমন একটি কারখানা হলো কামরাঙ্গীরচরের আলীনগর চৌরাস্তা দক্ষিণ পাশে হুজুরপাড়া রোডের মিন্টু মিয়ার হাসান পলিমার কারখানা। পণ্যের নকল বোতল ও কৌটা তৈরি করাই ওই কারখানাটির প্রধান ব্যবসা। কারখানাটিতে বিশ্বখ্যাত বিভিন্ন কোম্পানির পণ্যের হুবুহু কৌটা তৈরি করা হয়।
সরেজমিনে দেখা যায়, কারখানাটির প্রধান ফটকে ঢাকা মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাইনবোর্ড রয়েছে। ভেতরে ডুকতেই দেখা যায়, কয়েকটি মেশিনে প্লাস্টিক দানা গুলিয়ে বোতল, কৌটা ও কর্ক তৈরি করা হচ্ছে। পাশাপাশি একটি মেশিনে ডাইস শিতলীকরণ করা হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজার ফজল হোসেন ফজর বলেন, করোনা আসার পর থেকে ব্যবসা-বাণিজ্য একেবারে কমে গেছে। প্রতি বস্তা প্লাস্টিক দানার দাম ৪ হাজার টাকা। প্রতিদিন কারখানা চালাতে অনেক খরচ হয়। সলিট পার্টির কাজ করলে বিলের টাকা ওঠাতে জুতার তলা ক্ষয় হয়ে যায়। আর কপি মাল (বিখ্যাত পণ্যগুলোর হুবহু নকল মোড়ক) বানালে অগ্রিম টাকা পাওয়া যায়। ব্যবসা টেকাতে এসব পণ্য বানাচ্ছি। তিনি আরও বলেন, শুধু আমরা নই, কামরাঙ্গীরচরে দুই শতাধিক কারখানায় এমন কপি মাল বানানো হয়।
কারখানার মালিক মিন্টু মিয়া বলেন, আমার ভ্যাট-টেক্সসহ সব লাইসেন্স রয়েছে। আমি বৈধভাবে ব্যবসা করছি। তবে মাঝেমধ্যে ব্যবসা টিকিয়ে রাখার জন্য দু-একটি নকল মোড়ক বানাতে হয়।
জানা যায়, এক লিটার ওজনের প্রতি হাজার প্লাস্টিক কৌটা ৬ হাজার টাকায় বিক্রয় হলেও নকল পণ্যের কৌটা প্রতি হাজার ১২ থেকে ১৪ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। এজন্য কারখানা মালিকরা পণ্য নকলকারীদের অর্ডার সাপ্লাই করতেই বেশি পছন্দ করেন। পাশাপাশি দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে বিভিন্ন নামিদামি কোম্পানির মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য লাগেজ পার্টির মাধ্যমে দেশের বাজারে ছড়িয়ে পড়ছে। টেম্পারিং (কেমিক্যাল ব্যবহার করে পুরোনো লেখা উঠিয়ে নতুন মেয়াদ বাড়িয়ে দেওয়া) করে এসব পণ্য বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে।
যেসব পণ্য নকল করে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে তার মধ্যে আছে বিশ্বমানের ব্র্যান্ড গার্নিয়ার, লরেল, রেভলন, হেড অ্যান্ড শোল্ডার, লাক্স লোশন, অ্যাকুয়া মেরিন লোশন, পেনটিন, নিভিয়া, ফেড আউট ক্রিম, ডাভ সাবান, ইমপেরিয়াল সাবান, সুগন্ধির মধ্যে হুগো, ফেরারি, রয়েল, হ্যাভক ও কোবরা। অলিভ অয়েল কিওকারপিন, আমলা, আফটার সেভ লোশন, জনসন, ভ্যাসেলিন হেয়ার টনিক, জিলেট ফোম, প্যানটিক প্রোভি ও হারবাল অ্যাসেনশিয়াল লোশন। এছাড়া ইউনিলিভারের ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী, ফগ বডি স্প্রে ও ইতালিয়ান ব্র্যান্ডের নামিদামি নেইল পলিশ, সেভিং ফোম, সেভিং লোশন ও ক্রিম, পারফিউম, তেলকম পাউডার, সুগন্ধি কেশ তেল, বিউটি ক্রিম, স্যাম্পু, কন্ডিশনার প্যারাসুট, কুমারিকা, ডাবর আমলা, কিউটসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের নারিকেল তেল। এসব ব্র্যান্ডের অধিকাংশই ঘুপরি কারখানাগুলোয় তৈরি হচ্ছে। এই পণ্য মৌলভীবাজারের মোতালেব মার্কেট, মরিয়ম প্লাজা, ১০ নম্বর গলি, পুরান চকবাজার, খান মার্কেট, মুনসুর খান মার্কেট, রহমান মার্কেটে বেশি বিক্রি হয়।
পুরান ঢাকার একাধিক ব্যবসায়ী নেতা বলেন, নকল প্রসাধনীর দৌরাত্ম্যে আমাদের বৈধ ব্যবসার ক্ষতি হচ্ছে। নকল পণ্য উৎপাদনকারীরা অনেক শক্তিশালী। সবাইকে ম্যানেজ করে বছরের পর বছর তারা ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছে। মাঝেমধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালত আসেন, কিছু শাস্তি দিয়ে চলে যান। পরে অর্থদণ্ড দিয়ে একই কাজ শুরু করে নকল পণ্যের ব্যবসায়ীরা।
এ বিষয়ে কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ভেজাল প্রতিরোধে প্রশাসনকে এগিয়ে আসতে হবে। একই সঙ্গে আইনি ব্যবস্থা জোরদারসহ গণমাধ্যমকে আরও সোচ্চার ভূমিকা পালন করতে হবে। সর্বোপরি ভোক্তাদের নকল পণ্য সম্পর্কে সচেতন হওয়ার বিকল্প নেই।
মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি হাফেজ এনায়েত উল্লাহ বলেন, নকলবাজরা দেশ ও জাতির শত্রু। এরা প্রকৃত ব্যবসায়ীদের নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এদের বিরুদ্ধে জোরালো ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রশাসনের কাছে আহ্বান জানাচ্ছি।