হোয়াটসঅ্যাপে পছন্দের মানুষের আসা বার্তা দেখেও মনে হয়, ‘আহা! কী সুন্দর হাতের লেখা!’ সম্প্রতি ফেসবুকে মজা করে এই কথা লিখেছেন একজন। হাতের লেখার অনভ্যাসের কারণে মজা করে লেখা কথাটি কিন্তু অনেকটা সত্যিও। ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ, ই-মেইল, ভিডিও কলের যুগে আমরা হাতে লিখি কতটুকু? আর হাতেই যখন লেখা হয় কম, তখন আর হাতের লেখা নিয়ে কে-বা মাথা ঘামায়। হয়তো হাতের লেখা হারিয়ে যাচ্ছে বলেই এখন হাতের লেখা দিবসের আনুষ্ঠানিকতা বেড়েছে। আজ ২৩ জানুয়ারি সেই হাতের লেখা দিবস।
নতুন বছরের শুরুতে প্রথমবার স্কুলে ভর্তি হয়েছে অনেক শিশু। সদ্য পাঠ্যবইয়ের জগতে ঢোকা শিশুকে ‘অজগর ওই আসছে তেড়ে’-এর ‘অ’ বর্ণের প্যাঁচ শেখাতে গিয়ে কিঞ্চিৎ বিড়ম্বনা যে মা-বাবার হয় না, তা কিন্তু নয়। লিখতে গিয়ে হোঁচট খেতে হয়। মনে হয় এত খারাপ হয়ে গেছে নিজের হাতের লেখা! হাতের আর দোষ কী? কম্পিউটার, ল্যাপটপ, মোবাইলের কি-বোর্ডে ‘অ’ চাপতে চাপতে লেখার অভ্যাসটাই যে গেছে বদলে।
তবে হাতের লেখা কি একেবারেই হারাতে বসেছে? স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, পরীক্ষার হলের খাতায় বা শ্রেণিকক্ষের বোর্ডে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের হাতের লেখা কিন্তু জ্বলজ্বল করে জানিয়ে দিচ্ছে হাতের লেখা টিকে আছে। বলছে যতই কমপিউটারে কি-বোর্ড চাপো, আর মোবাইলের কি-প্যাডে আঙুল ঘোরাও, হাতে লিখতে তোমায় হবেই। আর হাতে যখন লিখতে হবেই, তখন সেটা সুন্দর তো হতেই হবে। ‘খাতায় এসব কী লিখেছিস কাকের ঠ্যাং, বকের ঠ্যাং’—এ কথা শুনতে কারই-বা ভালো লাগে। তাই তো হাতের লেখা সুন্দর করার প্রয়াস আজও বিরাজমান। শিশুদের হাতের লেখা সুন্দর করতে কত কিছুই না করেন বাবা-মায়েরা। বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে হাতেখড়ি দেওয়ার চল কয়েক বছর ধরেই শুরু হয়েছে। স্কুলগুলোতেও হাতের লেখার জন্য বিশেষ ক্লাস নেওয়া হয়।
কথায় আছে, সুন্দর মন সুন্দর লেখার পরিচয় দেয়। চীনের দার্শনিক কনফুসিয়াস বলেছিলেন, হাতের লেখা দেখে মানুষ চেনা যায়।
আবার এই হাতের লেখার সূত্র ধরে অনেক সময় বাঘা বাঘা অপরাধী ধরা পড়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জালে। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) হস্তলিপি বিশারদ অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সৈয়দ শওকত হোসেন বললেন, জালিয়াতির ইচ্ছা নিয়ে অন্যের হাতের লেখা নকল করার চেষ্টা অনেকে করেন। কিন্তু পৃথিবীতে একজনের আঙুলের ছাপ যেমন অন্যজনের সঙ্গে মেলে না, হাতের লেখাটাও সে রকমই। হস্তলিপি বিশারদের কাছে গেলে নকল সই ও জালিয়াতি ধরা পড়বেই।
হাতের লেখা নিয়ে কাজ করছেন যাঁরা
হাতের লেখা নিয়ে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন সংগঠন কাজ করে। এমনই একটি সংগঠন ‘হ্যান্ডরাইটিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’-এর আহ্বায়কের দায়িত্বে রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক খোরশেদ আলম ভূঁইয়া। ১৯৭৪ সালের পর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মূল শিক্ষা সনদের হস্তাক্ষর খোরশেদ আলম ভূঁইয়ার। শিশু থেকে শুরু করে সব বয়সীদেরই সুন্দর ও দ্রুত হাতের লেখা শেখানো হয় এখানে। পেইন্টিং হ্যান্ডরাইটিং স্কুল, অ্যাডভান্স হ্যান্ডরাইটিং স্কুলের মতো প্রতিষ্ঠান হাতের লেখা নিয়ে কাজ করে। পেইন্টিং হ্যান্ডরাইটিং স্কুলের স্বত্বাধিকারী আনিসুর রহমান (নাইম) বলেন, তাঁদের প্রতিষ্ঠানে শিশু থেকে শুরু করে ৫০ ও ৬০ বছর বয়সীরা হাতের লেখা শেখেন। পদোন্নতির পরীক্ষার জন্য চাকরিজীবী ও বিসিএস পরীক্ষার্থীরা এসব প্রতিষ্ঠানে হাতের লেখা শেখেন।
থ্রি ফিঙ্গার্স হ্যান্ডরাইটিং ডেভেলপমেন্ট একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ ও বাংলাদেশ শিশু একাডেমির হস্তলেখা বিভাগের সাবেক প্রধান প্রশিক্ষক এইচ এম জারীফ বলেন, তাঁরা ৩১ বছর ধরে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সুন্দর হাতের লেখার প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন।
যেভাবে শুরু হাতের লেখা দিবস
হাতের লেখা দিবস পালনের ধারণা ও প্রচলন যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে প্রতিবছর ২৩ জানুয়ারি জাতীয় হাতের লেখা দিবস পালিত হয়। রাইটিং ইনস্ট্রুমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যাসোসিয়েশন (ডব্লিউআইএমএ) দিবসটি পালনের উদ্যোক্তা। ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে মুক্ত হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের মুক্তির সনদে স্বাক্ষর করেছিলেন জন হ্যানকক। খুবই চমৎকার ছিল তাঁর দীর্ঘ স্বাক্ষর। সে কারণেও হ্যানককের স্বাক্ষর খুব বিখ্যাত। তাঁর জন্মদিন ২৩ জানুয়ারিকেই হাতের লেখা দিবস হিসেবে উদ্যোক্তারা বেছে নিয়েছিলেন।
কর্মসূচি
হাতের লেখা দিবসে ‘হ্যান্ডরাইটিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’ শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে দুই মিনিট অবস্থান করবে। শোভাযাত্রার পরিকল্পনা ছিল এই সংগঠনের। তবে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে শোভাযাত্রার পরিবর্তে রাজধানীর পলাশীতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে আলোচনা সভা হবে। এসব আয়োজনের মাধ্যমে হাতের লেখা সুন্দর করার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হবে।