সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দুটি র্যাংকিংয়ের খবর দিয়ে লেখাটি শুরু করতে চাই। এক. যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা ও গবেষণা সংস্থা কোয়াককোয়ারেলি সায়মন্ডসের (কিউএস) করা বিশ্বসেরা এক হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় স্থান পেয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)। দুই. লন্ডনভিত্তিক টাইমস হায়ার এডুকেশন এশিয়ার ৫০০টি সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করেছে। ওই তালিকার সেরা ৪০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদান, গবেষণা, জ্ঞানচর্চা, ইন্ডাস্ট্রি ইনকাম ও আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি—পাঁচটি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে ওই জরিপ করা হয়। শনিবার (২০ জুন) বণিক বার্তা পত্রিকায় প্রকাশিত সম্পাদকীয়তে এ তথ্য জানা যায়।
সম্পাদকীয়তে আরও জানা যায়, এ খবরে অনেকেই হয়তো অবাক হয়েছেন। এটি নিয়ে অবশ্য অবাক হওয়ার মতো কিছুই ছিল না, কারণ পূর্ববর্তী র্যাংকিংয়েও দেখা গেছে প্রতি বছরই বাংলাদেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় হ্রাস পাচ্ছে। যদিও ব্যবহূত মানদণ্ডগুলোর কিছু দিক বাংলাদেশে প্রচলিত ব্যবস্থা কাঠামোর সঙ্গে প্রযোজ্য নয়, তবে র্যাংকিংগুলো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতামূলকতার ক্ষেত্রে মানের একটি মাপকাঠি দেয়। স্থানীয় ও বিদেশী শিক্ষার্থীরা তাদের পছন্দনীয় বিশ্ববিদ্যালয় নির্ধারণে র্যাংকিংকে বিবেচনায় নেয়া শুরু করেছে। র্যাংকিং আন্তর্জাতিক তহবিল ও প্রতিযোগিতামূলক গবেষণা অনুদানকেও প্রভাবিত করে।
তুলনামূলক র্যাংকিংয়ের পতন মানে এই নয় যে বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান হ্রাস পেয়েছে, বরং সম্ভবত অন্য দেশগুলো গবেষণা ও উদ্ভাবনে আরো ভালো পারফরম্যান্স করে চলেছে বলেই পতন ঘটেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উচিত সত্যিকারের ভুল-ত্রুটিগুলো চিহ্নিত করা এবং তাদের সংশোধন করার জন্য গুরুত্বসহকারে চেষ্টা করা। মানসম্পন্ন উচ্চশিক্ষার উচ্চব্যয় এবং বর্তমানে এর সঙ্গে জড়িত বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীকে সমর্থন করার জন্যও এ ব্যাপারে গুরুত্বসহকারে ভাবা প্রয়োজন এবং চাকরির বাজারে প্রবেশের ন্যূনতম যোগ্যতা হিসেবে চার বছরের স্নাতক ডিগ্রি এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রির প্রয়োজনীয়তার সম্পর্কেও গুরুতর পুনর্বিবেচনা করা দরকার।
প্রায় ৩ দশমিক ৮ মিলিয়ন শিক্ষার্থী বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় তালিকাভুক্ত, যা বিশ্বের অন্যতম বেশি। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে, স্নাতকদের মধ্যে বেকারত্বের হার ৩০ শতাংশেরও বেশি। স্থানীয় স্নাতকদের মধ্যে এত বেশি বেকারত্বের হার সত্ত্বেও বেসরকারি খাত সঠিক দক্ষতাসম্পন্ন কর্মচারী খুঁজে পায় না। এটি প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও বাস্তবতার মধ্যে একটি বিস্তর ফারাক। কারিগরি ও পেশাভিত্তিক শিক্ষার দিকে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় একটি ছোট, তবে স্বাস্থ্যকর প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে, যা উৎসাহিত করা উচিত এবং এ খাত দৃঢভাবে সমর্থন এবং পর্যাপ্ত অর্থায়িত করা উচিত। মাধ্যমিক-পরবর্তী বেশির ভাগ শিক্ষার্থীদের এ পথ বেছে নিতে উৎসাহ দেয়া যেতে পারে। ডিগ্রি লাভের পর তাদের সম্মানজনক বেতন, চাকরির সুরক্ষা এবং সামাজিক অবস্থান ও মহানগরের বাইরে কাজ করার জন্য অনুপ্রাণিত করার মাধ্যমে।
কারিগরি ও পেশাভিত্তিক শিক্ষায় বৃহত্তর তালিকাভুক্তি নিশ্চিত করা গেলে তা উচ্চশিক্ষার ওপর চাপ কমিয়ে দেবে এবং হাজার হাজার শিক্ষার্থী কাঙ্ক্ষিত চাকরির গ্যারান্টির জন্য স্নাতকোত্তর হওয়ার দৌড়ে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোয় জায়গা সন্ধান করবে না। সরকারের এখন এবং ভবিষ্যতে সময়ের সঙ্গে বিভিন্ন পেশায় কী পরিমাণ স্নাতকের প্রয়োজন হবে, তার সংখ্যা নির্ধারণের জন্য একটি গুরুতর সমীক্ষা শুরু করা উচিত। পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের পেশায় প্রকৃত সংখ্যা ও প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহের এ বিষয়টি একটি গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোকেও পুনর্গঠনের উপায় সম্পর্কে পরামর্শ দেবে। ১৬০ বা ততোধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ২০টির কিছু বেশিকে গবেষণার সক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত করা যেতে পারে এবং আরো অনেকগুলো ভবিষ্যতে তাদের সঙ্গে যোগ দিতে পারে। বাকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার জন্য আরো বৃহত্তর দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারে এবং উচ্চস্তরের মানসম্পন্ন শিক্ষার জন্য যথোপযুক্ত শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে। এছাড়া স্বাস্থ্য, কৃষি, প্রযুক্তি এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয়সংখ্যক পেশাদারদেরও প্রশিক্ষণ দিতে পারে।
সাম্প্রতিক র্যাংকিংয়ের ক্রমনির্ধারণের জন্য ব্যবহূত মানদণ্ডগুলো পর্যালোচনা করে দেখে মনে হয় যে বাংলাদেশী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষকতার ক্ষেত্রে বেশ ভালো পারফর্ম করছে, তবে গবেষণা ও উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে খুবই বাজেভাবে ব্যর্থ হচ্ছে। পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানীরা কম গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে গবেষণা সরঞ্জাম ও উন্নয়ন তহবিলের অভাবের কথা বলতে পারেন, তবে মানবিক ও সামাজিক বিজ্ঞানের একাডেমিকদের কী অজুহাত রয়েছে?
গবেষণার অনুৎপাদনশীলতার অন্যতম কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিকদের নিয়োগ ও পদোন্নতিতে কেবল এটি একটি প্রান্তিক ভূমিকা পালন করে। তাই এর অগ্রাধিকারও তাদের মাঝে কম। তবুও যারা এ-জাতীয় প্রতিকূল পরিস্থিতিতে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে, তারা নিজের উদ্যোগে এবং প্রায়ই অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক বিদেশী অনুদানের মাধ্যমে এটি করেন। তাদের গবেষণায় উৎপাদনশীলতা প্রদর্শনের জন্য যথাযথ স্বীকৃতি সমর্থন এবং সরাসরি পুরস্কৃত হওয়া উচিত।
বাংলাদেশের মতো একটি দরিদ্র দেশে মানসম্পন্ন উচ্চতর শিক্ষার মাধ্যমে বুদ্ধিবৃত্তিক মূলধন তৈরি করে তার লভ্যাংশ জনসংখ্যার জন্য ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাকে শক্তিশালী না করে সাফল্য অর্জন করা সম্ভব নয়।
একটি উৎপাদনশীল ও জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতিতে শিক্ষার জন্য বাজেটে বার্ষিক প্রস্তাবিত বাজেটের ২০ শতাংশ বা জিডিপির ৬ শতাংশে বরাদ্দ করা উচিত। উচ্চতর শিক্ষার জন্য কমপক্ষে এক-চতুর্থাংশ বেঁধে রাখা উচিত। কিন্তু বর্তমানে বার্ষিক বাজেটের ১ শতাংশেরও কম উচ্চশিক্ষায় বরাদ্দ করা হয়েছে এবং এর একটি ক্ষুদ্র অংশ গবেষণার জন্য প্রস্তাবিত (যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক বাজেটের ০.০১৩৫ শতাংশ গবেষণার জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে)। মনোভাব পরিবর্তন ছাড়া শুধু অর্থ কখনই পছন্দসই ফল বয়ে আনবে না। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ইউজিসি দ্বারা পরিচালিত উচ্চশিক্ষা মানোন্নয়ন কর্মসূচি (হেকেপ) প্রকল্পের তিন রাউন্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় প্রচুর পরিমাণে তহবিল সরবরাহ করা হয়েছে, তবে কার্যসম্পাদন বা র্যাংকিংয়ের কোনো উপলব্ধিযোগ্য উন্নতি এখনো দেখা যায়নি। তহবিল ব্যবহারের কৌশলগুলো আরো উদ্দেশ্যপূর্ণ ও সমন্বিত করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশের উচ্চাভিলাষী অর্থনৈতিক লক্ষ্যগুলোর জন্য প্রয়োজন প্রযুক্তিগত দক্ষতা ও উচ্চশিক্ষাকে অত্যন্ত শক্তিশালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ভিত্তির দ্বারা সজ্জিত করা। এছাড়া গবেষণা ও উদ্ভাবনসহ বহুবিভাগীয় সহযোগিতার ওপর জোর দিয়ে একটি শক্তিশালী স্নাতকোত্তর গবেষণা সংস্কৃতি এবং বিশ্বমানের গবেষণা সুবিধা তৈরি করা প্রয়োজন।
সম্মিলিত জাতীয় বাজেটে জিডিপির প্রায় শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ গবেষণা ও উন্নয়ন (আরঅ্যান্ডডি) খাতে যুক্ত করা হয়েছে, যার মধ্যে বেশির ভাগ অংশই উপরি খরচে ব্যবহূত হয়। ফলপ্রসূ হতে এবং হারানো অবস্থান উদ্ধারের জন্য গবেষণা ও উন্নয়নে খাতের বাজেটকে কমপক্ষে জিডিপির ২ শতাংশে বাড়ানো উচিত। এমনকি এটিও বাংলাদেশের স্নাতকোত্তর এবং অন্যান্য গবেষণা কার্যক্রমের পুরো পরিসীমাকে পর্যাপ্তভাবে সমর্থন করতে খুবই ছোট হবে। বিশ্বমানের গবেষণার ব্যয় এবং বিদ্যমান তহবিলের অভাবের কথা বিবেচনা করে গবেষণা মূলত লক্ষ্যভিত্তিক এবং শিল্পের সহায়তায় পণ্য বা প্রক্রিয়া উন্নয়নের লক্ষ্যে করা উচিত।
লক্ষ্যভিত্তিক গবেষণার তহবিলকে সর্বাধিক জাতীয় অগ্রাধিকার দিয়ে বিদ্যমান শক্তির ক্ষেত্রগুলোয় অল্পসংখ্যক বহুমুখী প্রকল্পের মাধ্যমে পরিচালিত করতে হবে। বিদ্যমান জনশক্তি ও প্রযুক্তিগত সামর্থ্যের প্রভাব সর্বাধিকতর করতে বহু প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধা ও গবেষকদের দক্ষতার মধ্যে সমন্বয় প্রয়োজন। এ ধরনের সহযোগিতাগুলো কেবল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো (মূলত পুরো সময়ের পিএইচডি এবং পোস্ট ডক্টরাল গবেষক) এবং শিল্পকে নয়, উন্নয়ন গবেষণা ও প্রযুক্তি হস্তান্তরকে সমর্থন করার জন্য সরকারি গবেষণা পরীক্ষাগার (যেমন বিসিএসআইআর), সরকারি গবেষণা কাউন্সিল ও নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের সক্রিয় সমর্থন প্রয়োজন। এটি বাংলাদেশের জন্য একটি অভিনব ধারণা হতে পারে, তবে এটিই সম্ভবত একমাত্র উপায়, যাতে জনসাধারণের জন্য অর্থায়িত গবেষণার ফল সাধারণ মানুষের দিকে প্রবাহিত হয়।
একটি জাতীয় সহযোগিতা প্রকল্পের বিভিন্ন উপাদান বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন হতে পারে। ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করা একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ হতে পারে, যা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃত দেশীয় ও প্রবাসী বাংলাদেশী বিশেষজ্ঞ এবং মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি জাতীয় গবেষণা ও উদ্ভাবন কাউন্সিলের মাধ্যমে সর্বোচ্চ স্তরে সমন্বয় ও প্রয়োজনীয় তহবিলের মাধ্যমে পূরণ করা যেতে পারে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির নতুন নেতৃত্ব ইউজিসির মাঝে প্রস্তাবিত উচ্চশিক্ষা কমিশনের (এইচইসি) মতো একটি নতুন বিভাগ গঠনের বিষয়ে বিবেচনা করতে পারে, যা বিশেষত বিজ্ঞানভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় স্নাতকোত্তর গবেষণা ও উদ্ভাবনকে সমর্থন করবে। এছাড়া তারা প্রস্তাবিত জাতীয় গবেষণা ও উদ্ভাবন কাউন্সিল প্রতিষ্ঠায়ও উদ্যোগ নিতে পারে, যা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পর্কিত কৌশল ও নীতি বিকাশে সরকার ও ইউজিসি-এইচইসিকে সহায়তা করতে পারবে।
লেখক: মো. শরীফ হাসান: শিক্ষক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়