বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা হচ্ছে শুধু উচ্চতর ডিগ্রি নেয়ার প্রয়োজনে - দৈনিকশিক্ষা

বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা হচ্ছে শুধু উচ্চতর ডিগ্রি নেয়ার প্রয়োজনে

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

বিশ্বের খ্যাতনামা হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে গবেষণা খাতে ১.১৭ বিলিয়ন ডলার বা ১১৭ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। হার্ভার্ডের মতো যুক্তরাষ্ট্রের সেরা ১০০ বিশ্ববিদ্যালয় বছরে এক বিলিয়ন ডলার বা ১০০ কোটি টাকা এই রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আরঅ্যান্ডডি) খাতে খরচ করে। করোনা ভ্যাকসিনের মতো বড় বড় উদ্ভাবনে নেতৃত্ব দিচ্ছে অক্সফোর্ডের মতো বিশ্ববিদ্যালয়। মহামারি করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তুলনামূলক কম সময়ের মধ্যে তারা টিকা এনেছে। শনিবার (২ জানুয়ারি) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়।  প্রতিবেদনটি লিখেছেন এ এস এম সাদ।

প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, বৈশ্বিক নানা সংকট ও সমস্যার সমাধানে যখন নেতৃত্ব দিচ্ছে বিভিন্ন দেশের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, তখন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণার অবস্থা খুবই নাজুক। দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করা হচ্ছে শুধু উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়া কিংবা শিক্ষার প্রয়োজনে। এসব গবেষণার একটি উল্লেখযোগ্য অংশই জাতীয় উন্নয়নে খুব একটা অবদান রাখতে পারছে না। জাতীয় পর্যায়ে গবেষণা উৎসাহিত করার জন্য কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান না থাকা, গবেষণায় পর্যাপ্ত বরাদ্দ না দেওয়া, যা বরাদ্দ আছে তারও যথাযথ ব্যবহার না হওয়া, তদারকির ঘাটতিসহ নানা কারণে দেশে গবেষণার আকাল চলছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করছেন বাংলাদেশি চিকিৎসক তাসনিম জারা। তিনি সেখানে এভিডেন্স বেইসড মেডিসিন নিয়ে পড়ছেন। বছরের শুরু থেকেই তিনি গবেষণার সঙ্গে যুক্ত আছেন। একজন সুপারভাইজর এবং একজন কলেজ অ্যাডভাইজার তাঁকে দেওয়া হয়েছে। দুজনই তাঁকে গবেষণাসংক্রান্ত কাজে সাহায্যও করছেন। তাসনিম জারা বলেন, ‘অক্সফোর্ডে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন রকমের গবেষণার সঙ্গে যুক্ত থাকে। আমি যে কলেজের সঙ্গে যুক্ত, সেই কলেজে গবেষণার জন্য আলাদা বৃত্তির ব্যবস্থাও আছে। এ ধরনের বিভিন্ন সুবিধার কারণে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের গবেষণার মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসছে বড় বড় সমস্যার নতুন সমাধান।’  

দেশে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তথ্য বলছে, ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে ৯২টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। এগুলোর মধ্যে ১৫টি বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণায় এক টাকাও ব্যয় করেনি। সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত গবেষণা খাতে ব্যয় করেছে ২৪টি বিশ্ববিদ্যালয়। পাঁচ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করেছে ১১টি বিশ্ববিদ্যালয়। আর ১০ লাখ থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করেছে ১১টি বিশ্ববিদ্যালয়। অর্থাৎ গবেষণা খাতে ২০ লাখ টাকার বেশি ব্যয় করেনি দেশের কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ই।

ইউজিসি প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার জন্য বরাদ্দ করা টাকা বাড়ালেও তার সুফল পাচ্ছেন না বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১৬ কোটি ২৪ লাখ টাকা, ২০১৬-১৭ সালে ২৮ কোটি ৯৭ লাখ টাকা, ২০১৭-১৮ সালে ৫৪ কোটি ৬৫ লাখ টাকা, ২০১৮-১৯ সালে ৬১ কোটি ৯০ লাখ টাকা, ২০১৯-২০ সালে ৬৪ কোটি ৫৮ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে।  

শিক্ষাবিদরা বলছেন, এক বছরে ২০ লাখ টাকা গবেষণা খাতে ব্যয় করা আসলে কোনো ব্যয়ই নয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশই নামকাওয়াস্তে গবেষণা খাতে খরচ দেখিয়েছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. আব্দুল হাসিব চৌধুরী বলেন, ‘এ দেশে মাস্টার্স ও পিএইচডি ডিগ্রির ক্ষেত্রে গবেষণার গুরুত্ব আরো বেশি দেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। আমাদের দেশে স্নাতক পাস করে একজন শিক্ষার্থী চাকরিতে ঢুকে যায়। ফলে অনেক শিক্ষার্থী গবেষণা করার সুযোগ পায় না। গবেষণা করতে আর আগ্রহ প্রকাশ করে না তারা। যারা করে তারা খুব বড় বাজেট পায় না। তাই গবেষণার মানও ভালো হয় না।’ 

প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের গবেষণার জন্য বরাদ্দ করা অর্থের পরিমাণ কমেছে, খুব একটা বাড়েনি গবেষণার সংখ্যা। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট ও হিসাব পরিচালক দপ্তর থেকে জানা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরে শিক্ষকদের গবেষণায় বরাদ্দ করা অর্থের পরিমাণ কমেছে। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে গবেষণায় বরাদ্দ ছিল সাত কোটি ৫০ লাখ টাকা, গবেষণা হয়েছে ৫৬টি, কিন্তু ২০১৯-২০ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল আট কোটি টাকা, গবেষণা হয় ৫৬টি। ২০১৮-১৯ সালে বরাদ্দ ছিল সাত কোটি ৮৬ লাখ টাকা, গবেষণা হয় ৫৫টি। ২০১৭-১৮ সালে বরাদ্দ ছিল সাত কোটি ৯৫ লাখ টাকা, গবেষণা হয় ৫৫টি। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে শিক্ষকদের গবেষণার জন্য পাঁচ কোটি ৩২ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হলে গবেষণা হয় ৫৫টি। অর্থাৎ গত পাঁচ বছরে দেশের সর্বোচ্চ এই বিদ্যাপীঠে শিক্ষকদের বার্ষিক গবেষণা ৫৬টির বেশি ওঠেনি। আবার বরাদ্দ করা অর্থের পরিমাণও কমছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণায় মনোযোগ নেই। বেশির ভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান খুলে বসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও প্রশাসনও গবেষণায় গুরুত্ব দেয় না। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রকাশনাও নেই। তিনি আরো বলেন, বর্তমানে দলীয়করণের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। শিক্ষকের চাকরি পেলে আর গবেষণায় মনোযোগ দেন না তাঁরা। তাঁর মতে, সমাজের নেতৃত্ব দেওয়া উচিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া বেশির ভাগ স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ে মানসম্মত ও পর্যাপ্ত গবেষণা নেই। তবে শীর্ষপর্যায়ের কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা আরো নাজুক। শিক্ষার্থী ভর্তি করা, ক্লাস-পরীক্ষা নেওয়া আর সার্টিফিকেট দিয়েই দায় সারছে দেশের বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়। ফলে দেশে গবেষণার সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি বলে মনে করছেন গবেষকরা। আর হাতে গোনা দু-একটি বাদে বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার মান নিয়ে গবেষকদের আছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাও। 

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের (ইউল্যাব) অধ্যাপক ও রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক ড. সুমন রহমান বলেন, ‘গবেষণা খাতে কোনো কালেই খরচ ছিল না। দেশের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় আমরা টিচিং ইনস্টিটিউট হিসেবে গড়ে তুলেছি। বিদেশে গবেষণাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়, সঙ্গে ক্লাসের টিচিংও থাকে। সেসব দেশে ক্লাসে শিক্ষার্থীদের টিচিং দেওয়াও হয় গবেষণালব্ধ জ্ঞান থেকে। কিন্তু আমাদের দেশে বিদেশি বই থেকে কপি করে স্লাইড বানিয়ে পড়ানো হয়। আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করানো হয় কোচিং সেন্টারের মতো। ফলে গবেষণা গুরুত্ব পায় না।’ তিনি আরো বলেন, রাষ্ট্রকে গবেষণায় গুরুদায়িত্ব নিতে হবে, কিন্তু সরকারের কোনো রকমের রিসার্চ এজেন্সি নেই। ফলে গবেষণার জন্য ফান্ড নেই। মানসম্মত গবেষণাও নেই। ২০১৮ সালে চালু থাকা ৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ছয়টি গবেষণা খাতে কোনো ব্যয়ই করেনি। আর সর্বোচ্চ ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করেছে চারটি বিশ্ববিদ্যালয়। এমনকি ২০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো প্রকাশনাই নেই।

বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার আকাল সম্পর্কে জানতে চাইলে ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক কাজী শহিদুল্লাহ বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে ধরনের গবেষণা হয়, তার মান আরো উন্নত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। সামনে দুটি পদক্ষেপ নেওয়া হবে। গবেষণা নকল করা তথা কপি পেস্ট বন্ধ করা হবে। একজনের গবেষণা অন্যজন কপি করে দিচ্ছে। এটাকে সরাসরি চুরি বলা যায়। যারা গবেষণা করছে তাদের রিসার্চ পেপার ভালো জার্নালে প্রকাশ করার সুযোগ তৈরি করা ও ভর্তুকি দেওয়া হবে। তাহলে আশা করা যাচ্ছে গবেষণার মান আরো উন্নত হবে।’

শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0073280334472656