অর্থের অভাবে সুচিকিৎসা পাচ্ছেন না রংপুর মেডিক্যালে স্টাফদের নির্যাতনের শিকার বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সেই দুই ভাই। ঘটনার দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং বিভিন্ন মাধ্যম থেকে যোগাযোগের পর মেডিক্যাল কর্তৃপক্ষ তাদের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে চাইলেও পরে সে অনুযায়ী চিকিৎসা দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ ভুক্তভোগী দুই শিক্ষার্থীর।
জানা যায়, মাথা এবং কানে গুরুতর আঘাত পান বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রিয়াজুল ইসলাম রিয়াদ। ঘটনার পর থেকে বাম কানে শুনতে পাচ্ছেন না তিনি। ডাক্তার জানিয়েছে তার কানের ম্যামব্রেন ফেটে গেছে। এই চিকিৎসা নিতে অন্তত তিন মাস সময় লেগে যেতে পারে। রংপুর মেডিক্যালের নাক, কান এবং গলা ওয়ার্ডে চিকিৎসা নেওয়ার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন বর্তমানে ভর্তি থাকা সার্জারি ওয়ার্ডের চিকিৎসকরা। তারা জানিয়েছেন, তার কানের বড় ধরনের সমস্যা হয়েছে। এটা নাক, কান, গলা বিভাগ থেকেই চিকিৎসা নিতে হবে। হয়তো কানের সার্জারিও করতে হতে পারে।
এদিকে, কিডনির দীর্ঘমেয়াদি সমস্যায় ভুগছেন রিয়াদ ও রাশেদ করীমের মা। তাকে প্রতি সপ্তাহে দুবার ডায়ালিসিস করতে হয়। এই চিকিৎসা করাতে গিয়ে নিজের সকল জমি-জমা এর মধ্যেই বন্ধক রেখেছেন তার বাবা মো. শহীদুল ইসলাম। তিনি পেশায় আগে পল্লী বিদ্যুৎ অফিসে কাজ করলেও এখন বেকার। রিয়াদের মায়ের চিকিৎসার খরচ জোগাতেই পুরো পরিবার যেখানে হিমশিম খাচ্ছিল, ঠিক সে সময়ে মায়ের চিকিৎসা করাতে এসে মেডিক্যাল স্টাফদের মারধরের শিকার হয়ে এখন বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থী দুই ভাইও মেডিক্যালে ভর্তি। মায়ের ডায়ালিসিস করতে প্রতি ছয় মাসে প্যাকেজ খরচসহ প্রায় ৫০ হাজার টাকার প্রয়োজন হয়। রিয়াদ এবং রাশেদের চিকিৎসার খরচ মেডিক্যাল কর্তৃপক্ষ দিতে চাইলেও বড় ধরনের সব টেস্ট করাতে হচ্ছে নিজেদের। মেডিক্যাল থেকে শুধু সাধারণ ওষুধ আর এক্সরে একটা করানো হয়েছে বলে জানিয়েছে রাশেদ করীম। একদিকে মায়ের চিকিৎসার খরচ অন্যদিকে নিজের চিকিৎসা- সবমিলিয়ে অনেক বড় সংকটের মধ্যে সময় পার করছে পুরো পরিবার।
ঘটনার পর থেকেই বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন করে দোষীদের শাস্তির দাবি করছে। কিন্তু তাদের চিকিৎসা কিভাবে হবে, কোথা থেকে আসবে এত টাকা- এ বিষয়ে কেউ কোনো ব্যবস্থা নেননি।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রিয়াজুল ইসলাম রিয়াদ জানান, সেদিন মারধরের পর থেকে বাম কানে শুনতে পাচ্ছি না। সারাক্ষণ কানের মধ্যে শব্দ করে। আবদ্ধ কোনো রুমে থাকতে পারছি না। মাথা ঘুরছে, এমনকি বেশি জোরে কোনো শব্দও শুনতে পাচ্ছি না। মাথায় আঘাত পাওয়া স্থান ফুলে আছে, যে কারণে মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে।
ছোট ভাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রাশেদ করিম জানান, আমার পুরো শরীরে অমানবিক নির্যাতন করেছে তারা। হাত এবং কোমরে সবচেয়ে বেশি আঘাত পেয়েছি। থেমে থেমেই পুরো শরীরে অসহ্যরকম ব্যথা হয়। তিনি বলেন, ভাই রিয়াদের কানের বিষয়টা নিয়েই তারা সবচেয়ে বেশি চিন্তিত।
দুই শিক্ষার্থীর বাবা মো. শহীদুল ইসলাম জানান, একদিকে ছেলের মা অন্যদিকে দুই ছেলে সবাই এখন মেডিক্যালে ভর্তি। কাকে রেখে ককে দেখব সেটা নিয়েই বিপাকে পড়েছি। ছেলের মায়ের চিকিৎসা করাতেই আমার বাড়ির জিনিসপত্র, সকল জমি-জমা বন্ধক রেখেছি, কিছু বিক্রিও করেছি। এখন আবার ছেলেদের এই অবস্থায় আমি দিশেহারা হয়ে গেছি। এখন এত টাকা পাব কোথায়? কিভাবে ছেলেদের চিকিৎসা করাব?
তিনি বলেন, ছেলেদের নিয়ে অনেক বড় স্বপ্ন দেখেছি। তাদের পড়াশোনার জন্য নিজের সবকিছু ঢেলে দিয়েছি। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর টিউশনি করিয়ে চলত কিন্তু করোনার কারণে এখন সেটাতেও বাধা।
ছেলেদের নির্যাতনের পর আঘাতের বিষয়ে তিনি খুব বেশি বিচলিত। তিনি বলেন, যদি ছেলের কানের বড় কোনো সমস্যা হয় তাহলে আমার স্বপ্ন মাটি হয়ে যাবে। আমি আমার ছেলেদের মারধরের বিচার চাই এবং তাদের সুচিকিৎসা যাতে নিশ্চিত হয় সেজন্য সবার কাছে সহযোগিতা কামনা করছি।
রংপুর মেডিক্যালের সার্জারি ওয়ার্ডে থাকা কর্তব্যরত চিকিৎসক জানান, রিয়াজুল ইসলাম কানে বড় ধরনের আঘাত পেয়েছেন। আমরা তাকে নাক, কান, গলা বিভাগে যেতে পরামর্শ দিয়েছি। তার এখন সেখানে গিয়ে কানের চিকিৎসা নেওয়া জরুরি।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র পরামর্শ ও নির্দেশনা দপ্তরের পরিচালক ড. মো. নুর আলম সিদ্দিক বলেন, আমি বিষয়টি শুনেছি। তাদেরকে লিখিত একটা আবেদন জানানোর কথা বলা হয়েছে। তারা জানালে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে ব্যবস্থা নিতে পারব।
প্রসঙ্গত, গত শুক্রবার (১০ জুন) সন্ধ্যা ৭টায় মায়ের চিকিৎসা নিতে রংপুর মেডিক্যালে যায় রিয়াজুল ইসলাম রিয়াদ ও রাশেদ করীম। সে সময় ভর্তি করাতে অতিরিক্ত টাকা দাবি করলে সেটার প্রতিবাদ করেন রিয়াদ। এরপর হঠাৎ তার ওপর আক্রমণ করেন মেডিক্যালের ১৫-১৬ জন স্টাফ। সে সময় তাদের দুই ভাইকে আবরুদ্ধ রুমে নিয়ে বেধড়ক মারধর করা হয়।