ব্লু-ইকোনমি ও টেকসই উন্নয়ন, প্রেক্ষিত বাংলাদেশ - দৈনিকশিক্ষা

ব্লু-ইকোনমি ও টেকসই উন্নয়ন, প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

অধ্যাপক ড. মো. লোকমান হোসেন |

পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখার নিমিত্তে সারা বিশ্বে বিংশশতক জুড়ে নানা আন্দোলন ও সম্মেলন আমাদের সামনে নিয়ে এসেছে একের পর এক পরিবেশ বান্ধব মডেল বা ধারণা। এদের মধ্যে গ্রীন ইকোনমি মডেলটি ছিল অগ্রাধিকারযোগ্য। আর গ্রীন ইকোনমি মডেলটি বর্তমানে ব্লু-ইকোনমি নামে পরিচিত, যা অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের পাশাপাশি পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় একটি কার্যকর বিকল্প মডেল হিসেবে এরই মধ্যে বিশ্ব জুড়ে শক্ত অবস্থান গড়ে তুলেছে।

২০১০ খ্রিষ্টাব্দে অধ্যাপক গুন্টার পাউলি ভবিষ্যতের অর্থনীতির রূপরেখা প্রণয়নের জন্য জাতিসংঘে আমন্ত্রিত হন। সেখানেই তিনি একটি টেকসই ও পরিবেশ বান্ধব মডেল হিসেবে ব্লু-ইকোনমির ধারণা দেন। তার ধারণা অনুযায়ী, সমুদ্র অর্থনীতিতে অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে সাধারণ মানুষের সুযোগ-সুবিধা, ভাবতে হবে পরিবেশের কথা, থাকতে হবে উদ্ভাবনী এবং গতিশীল ব্যবসায়িক চিন্তা-ভাবনা। রিওডি জেনিরিওতে টেকসই উন্নয়ন শীর্ষক জাতিসংঘ সম্মেলনে ' ব্লু-ইকোনমি' ধারণাটি প্রথম উত্থাপিত হয়। সমুদ্র অর্থনীতির সাথে টেকসই উন্নয়নের বিষয়টি  সরাসরি জড়িত। সেখানে নানা ধারণা দিয়ে বোঝানো হয়, আগামীদিনের জন্য একটি সমুদ্রভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তোলার কথা, যার উদ্দেশ্য হবে, মানুষের জীবনমান উন্নয়ন এবং সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠা। পাশাপাশি পরিবেশে ক্ষতির ঝুঁকি কমিয়ে আনা। সর্বজনস্বীকৃত আন্তর্জাতিক সংজ্ঞা অনুসারে, টেকসই উনয়ন হচ্ছে আশেপাশে থাকা সম্পদের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে বর্তমান সময়ের চাহিদা মেটানো। ফলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কখনো ঝুঁকির মুখে পড়বে না। 

২০১২ খ্রিষ্টাব্দে  জুনে রিও-ডি-জেনেরিওতে অনুষ্ঠিত ইউনাইটেড নেশনস কনফারেন্স অন সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট সম্মেলনে ব্লু-ইকোনমির সর্বপ্রথম কনসেপ্ট নোটটি উপস্থাপন করা হয় । সেখানে গ্রিন ইকোনোমি ইন ব্লু-ওয়ার্ল্ড নামে একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। তবে জাতিসংঘের উদ্যোগে ব্লু-ইকোনোমি ধারণা নিয়ে প্রথম বৃহৎ কর্মশালা ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশেই অনুষ্ঠিত হয় । কর্মশালায় সরকারের ১৯টি মন্ত্রণালয় নিয়ে ব্লু-ইকোনমি বাস্তবায়নের মহাপরিকল্পনাও নেওয়া হয় । গত দশকে নানা পরিমার্জন-পরিবর্ধনের মধ্য দিয়ে ব্লু-ইকোনমি মডেলটি আজ একটি প্রতিষ্ঠিত ধারণা।

ব্লু-ইকোনমি বা সুনীল অর্থনীতি হচ্ছে, সমুদ্র সম্পদনির্ভর অর্থনীতি। সুনীল অর্থনীতি এমন একটি বিষয় যেখানে সামুদ্রিক পরিবেশ কিংবা সমুদ্র সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে আলোচনা করা হয়। সমুদ্রের বিশাল জলরাশি ও এর তলদেশের আহরণকৃত বিভিন্ন প্রকার সম্পদ যখন দেশের অর্থনীতিতে যুক্ত হয়, তাই ব্লু-ইকোনমি। বিশ্বব্যাংকের মতে, ‘সুনীল অর্থনীতি হলো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, উন্নততর জীবিকার সংস্থান এবং সামুদ্রিক প্রতিবেশের উন্নয়ন। টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রাগুলোর মধ্যে, ১৪ নম্বর লক্ষ্যটি সমুদ্র এবং সামুদ্রিক সম্পদের টেকসই ব্যবহারের সাথে সংশ্লিষ্ট। সমুদ্র অর্থনীতি আর টেকসই উন্নয়ন একীভূত একটি ধারণা। এ দুয়ের এক থেকে অপরের বিচ্ছিন্নতা অসম্ভব। সমুদ্র অর্থনীতির প্রবক্তাদের মধ্যে অগ্রণী ভূমিকায় রয়েছে বস্তুত উন্নয়নশীল উপকূলীয় দেশ এবং দ্বীপরাষ্ট্রগুলো। বস্তুত তারাই প্রথম উপলব্ধি করেছে মানবজাতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণে মহাসমুদ্রগুলো কী অবদান রাখতে সক্ষম। 

বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ৩৫ কোটি মানুষের জীবিকা সরাসরি সমুদ্রের ওপর নির্ভরশীল। তথ্যমতে, ২০৫০ খ্রিষ্টাব্দে পৃথিবীর জনসংখ্যা হবে ৯০০ কোটি। তখন বিপুল ওই জনগোষ্ঠীর খাদ্যের জোগান দিতে সমুদ্রের মুখাপেক্ষী হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। পৃথিবীর ৪৩০ কোটিরও বেশি মানুষের শতকরা ১৫ ভাগ প্রোটিনের চাহিদা মিটায় সামুদ্রিক মাছ, উদ্ভিদ ও জীবজন্তু এবং ৩০ ভাগ গ্যাস ও জ্বালানি তেলের চাহিদা মিটায় সমুদ্রতলের গ্যাস ও তেলক্ষেত্রসমূহ। সমুদ্র ব্যবহার করে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনে বাংলাদেশের রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা। বঙ্গোপসাগরের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ২০০ নটিক্যাল মাইলের একচেটিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ ৭১০ কি.মি. সুদীর্ঘ উপকূলরেখা রয়েছে। বিশ্বের মোট মৎস্য উৎপাদনের শতকরা ১৬ ভাগ এবং বাংলাদেশের মৎস্য উৎপাদনের শতকরা ২০ভাগ আসে খোদ বঙ্গোপসাগর থেকে। আন্তর্জাতিক পর্যটকদের গড়ে শতকরা ৮১ ভাগ কক্সবাজার ভ্রমণ করে থাকেন। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকায় অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। 

বঙ্গোপসাগরের সীমানা নিয়ে মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বিরোধ চলে আসছিল দীর্ঘদিন। ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ-সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির পর বাংলাদেশের কাছে বর্তমানে ব্লু-ইকোনমির বিষয়টি বিশেষভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে। উল্লেখ্য,বাংলাদেশ যখন গভীর সমুদ্রে তেল গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করে, তখন ভারত ও মায়ানমার বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার দুই-তৃতীয়াংশ তাদের নিজেদের বলে দাবী করে। ফলে বাংলাদেশ ২০০৯-র ৮ অক্টোবর এই বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য ভারত ও মায়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা করে। অন্যদিকে আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি সমাধানেরও পথ খোলা রাখে। বাংলাদেশ ও মায়ানমারের বিরোধ সংক্রান্ত মামলাটি জার্মানীর সমুদ্র সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক বিচারিক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইবুনাল ফর দি ল অব দি সি (ইটলস) এ পাঠানো হয় এবং ভারতের সঙ্গে শালিসটি ইন্টারন্যাশনাল কোট অব জাষ্টির্স (আইসিজে)তে পাঠানো হয়। পরিশেষে আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে ২০১২ থেকে মিয়ানমারের সাথে ও ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের সাথে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি হয়। ফলে ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গ কিলোমিটার সমপরিমাণ টেরিটোরিয়াল সমুদ্র এলাকায় বাংলাদেশের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যা আয়তনে প্রায় আরেকটি বাংলাদেশের সমান। এছাড়াও বাংলাদেশের ২০০ নটিক্যাল মাইল একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল রয়েছে। আর চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানের তলদেশে সব ধরনের সম্পদের ওপর পূর্ণঅধিকার। নিঃসন্দেহে এ অর্জন আমাদের জন্য খুবই গৌরবের ও আনন্দের। 

২০৩০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে এসডিজি-১৪ সম্পর্কিত অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের জন্য বাংলাদেশ সমুদ্র এবং সামুদ্রিক সম্পদের টেকসই ব্যবহার নিশ্চিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। টেকসই সুনীল অর্থনীতি বজায় রাখার লক্ষ্যে বাংলাদেশের অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ১২টি কার্যকলাপ উল্লেখ করা হয়েছে, যেখানে অন্যান্য পরিকল্পনাগুলোর মধ্যে  অন্তর্ভুক্ত রয়েছে মৎস্য চাষ, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, মানবসম্পদ,  ট্রান্সশিপমেন্ট, পর্যটন এবং জলবায়ু পরিবর্তন। এছাড়া, বিভাগীয় মন্ত্রণালয়গুলোর সমন্বয় সাধনের জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে ব্লু-ইকোনমিক সেল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সুনীল অর্থনীতির ২৬টি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র চিহ্নিত করেছে, যার মধ্যে মৎস্য চাষ, সামুদ্রিক বাণিজ্য এবং শিপিং, জ্বালানি, পর্যটন, উপকূলীয় সুরক্ষা ব্যবস্থা, উপকূলীয় নিরাপত্তা এবং সুনীল অর্থনীতির উন্নয়নের জন্য নজরদারি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। 

সমুদ্র পৃথিবীর অন্যতম মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ এবং অন্য অনেক সম্পদের উৎস। সমুদ্র থেকেই উৎপন্ন মাছ মানুষের খাবারের চাহিদা ও অন্যান্য অর্থনৈতিক চাহিদা মেটায়, মানুষের যাতায়াত এবং পণ্য পরিবহনের মাধ্যম হিসেবে সমুদ্র ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও নানা ধরণের প্রাকৃতিক খনিজ সম্পদ যেমন-বালি, লবণ, ম্যাগনেশিয়াম, নিকেল, কোবাল্ট, গ্রাভেল, কপার ইত্যাদির আধার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। গবেষকরা বহুকাল আগে থেকেই বঙ্গোপসাগরকে বিভিন্ন ধরনের সম্পদের খনি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। বঙ্গোপসাগরের তলদেশে যে খনিজ সম্পদ রয়েছে তা পৃথিবীর আর কোনও সাগর, উপসাগরে নেই বলেও অনেকে ধারণা করছেন। আরো বহু বছর আগে মণি, মুক্তা, সোনা, রূপা, তামা, প্রবালসহ বিভিন্ন ধরনের মহামূল্যবান ধনরত্ন এখানে রয়েছে বলে ধারণা করা হতো। ভারতবর্ষের পৌরাণিকে বঙ্গোপসাগরের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘রত্নাকাগার’। 

সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হওয়ার ফলে নীল অর্থনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দুই ধরনের সম্পদ অর্জনের ক্ষমতা লাভ করেছে। একটি হলো, প্রাণিজ আর অপরটি হলো অপ্রাণিজ। প্রাণিজ সম্পদের মধ্যে রয়েছে মৎস্য সম্পদ, সামুদ্রিক প্রাণী, আগাছা লতাগুল্ম ইত্যাদি। সাগরের সীমানায় মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হলেও এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে সমুদ্রবক্ষের বিপুল পরিমাণ তেল ও গ্যাস। শুধু মাছ কিংবা খনিজ সম্পদ নয়, নিজেদের সীমানায় সাগরকে ব্যবহার করে পুরো অর্থনীতির চিত্র পাল্টে দেয়া যেতে পারে। এছাড়া নীল পানিরাশির মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে শামুক, ঝিনুক,  অক্টোপাস, হাঙ্গর ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের সামুদ্রিক প্রাণিজ সম্পদ। ২০১৭- ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশে উৎপাদিত মোট ৪৩ লাখ ৩৪ হাজার টন মাছের মধ্যে সাড়ে ছয় লাখ টন মাছ এসেছে সমুদ্র থেকে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সেভ-আওয়ার-সি' এর তথ্য অনুসারে, প্রতিবছর বঙ্গোপসাগর থেকে ৮০ লাখ টন মাছ ধরা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের জেলেরা ধরতে পারছেন মাত্র ৭ লাখ টন।  চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র বিজ্ঞান ইন্সটিটিউট এর অধ্যাপক সাইদুর রহমান চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে বলেছেন,এখানো সমুদ্র থেকে মূলত মাছ এবং চিংড়ি বেশি ধরা হয়। কারণ, খাবার হিসাবে বাংলাদেশীদের এগুলোর চাহিদাই বেশি রয়েছে। বাংলাদেশের সমুদ্র থেকে মূলত লাক্ষা, রূপচাঁদা ও কালোচাঁদা, টুনা, ম্যাকারেল, চ্যাপা, সামুদ্রিক রিটা, শাপলা পাতা মাছ, লাইট্টা, পোয়া, সুরমা, ইলিশ, ছুরি, ফাইস্যা, সামুদ্রিক বাইন ও কই মিলিয়ে প্রায় ২০টির মতো বাণিজ্যিক মাছ ধরা হয়।এসব মাছের স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা বেশি। সবমিলিয়ে বঙ্গোপসাগর থেকে খাদ্য হিসাবে ২০০  প্রজাতির মাছ ও চিংড়ি ধরে বাংলাদেশের জেলেরা। সমুদ্রে মাছ আহরণের দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান ২৫তম। বর্তমানে গড়ে ৬ লাখ টন মাছ সমুদ্র থেকে আহরণ করা হয়েছে। বাংলাদেশের জিডিপির মাত্র চার থেকে পাঁচ শতাংশ সুনীল অর্থনীতি থেকে আসে। বর্তমানে আমাদের জেলেরা ৩৫ থেকে ৪০ নটিক্যাল মাইলের মধ্য থেকে মাছ আহরণ করেন। গভীর সমুদ্র পর্যন্ত গিয়ে মাছ আহরণ করতে পারলে বাংলাদেশের মৎস্য রপ্তানিতে সৃষ্টি হবে নতুন মাইলফলক, তৈরি হবে নতুন সম্ভাবনার দিগন্ত। 

স্বল্পোন্নত দেশগুলোর অর্ধাংশের ক্ষেত্রে এটি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী প্রধান খাত। উপকূলীয় ট্যুরিজমের মধ্যে রয়েছে সৈকতভিত্তিক বিনোদন, সমুদ্রের কাছে পর্যটন কার্যক্রম এবং ইয়টিং ও মেরিনাসহ নটিকাল বোটিং। টেকসই পর্যটন শিল্প নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র্য হ্রাস করতে পারে। অতএব, বাংলাদেশ পর্যটন খাত থেকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করতে পারে, যা জিডিপি বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে। বাংলাদেশের ৭৫টি বহিঃদ্বীপ রয়েছে, যা স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে পর্যটন খাতে ব্যবহার করা সম্ভব। যথাযথ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে এসব সম্পদ ব্যবহার সম্ভব হলে বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুতউন্নয়ন সম্ভব। এখন পর্যন্ত মৎস্য পালন, জাহাজ নির্মাণ, জাহাজ ভাঙা, লবণ উৎপাদন এবং বন্দর সুবিধাসহ মাত্র কিছু সংখ্যক সুনীল অর্থনীতির ক্ষেত্র উম্মোচন করা সম্ভব হয়েছে। তাছাড়া এ সব খাতের অধিকাংশই গতানুগতিক পদ্ধতি অনুসরণ করছে। 

সামুদ্রিক সম্পদ কাজে লাগিয়ে জাহাজ নির্মাণ ও ভাঙা এবং ওষুধ শিল্পেও আরো উপকৃত হওয়া সম্ভব। ব্লু-ইকোনমির প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সমুদ্রবিজ্ঞান বিষয় চালু এবং সেখানে পর্যাপ্ত আসন সংখ্যার ব্যবস্থা করতে হবে। সামুদ্রিক সম্পদ সুষ্ঠুভাবে ব্যবহার করে অর্থনৈতিক বিকাশ সাধনের জন্য আমাদের আগে সুনির্দিষ্ট খাতগুলো যেমন- অ্যাকুয়াকালচার, পর্যটন, মেরিন বায়োটেকনোলজি, তেল-গ্যাস, সমুদ্রতলে খনি খনন ইত্যাদি চিহ্নিত করতে হবে।

অপ্রাণীজ সম্পদের মধ্যে রয়েছে খনিজ ও জ্বালানি সম্পদ। যেমন তেল, গ্যাস, চুনাপাথর ইত্যাদি। আরো রয়েছে ১৭ ধরনের খনিজ বালু। যেমন- জিরকন, রুটাইল, মোনাজাইট, ইলমেনাইট, ম্যাগনেটাইট, গ্রানেট, মোনাজাইট ইত্যাদি। এই তেজস্ক্রিয় পদার্থ পারমাণবিক বোমা তৈরিতে ও পারমাণবিক চুল্লিতে শক্তি উৎপাদক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনের তথ্যমতে, দেশের সমদ্র সৈকতের বালিতে মোট খনিজের মজুদ ৪৪ লাখ টন এবং প্রকৃত খনিজের পরিমাণ প্রায় ১৭ লাখ ৫০ হাজার টন, যা বঙ্গোপসাগরের ১৩টি স্থানে পাওয়া গেছে। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের প্রতিবেদন অনুযায়ী অগভীর সমুদ্রের তলদেশে ভ্যানাডিয়াম, প্লাটিনাম, কোবাল্ট, মলিবডেনাম, ম্যাঙ্গানিজ ক্রাস্ট, তামা, সীসা, জিঙ্ক এবং কিছু পরিমাণ সোনা ও রূপা দিয়ে গঠিত সালফাইডের অস্তিত্ব রয়েছে। ১ হাজার ৪০০ থেকে ৩ হাজার ৭০০ মিটার গভীরে এসব মূল্যবান সম্পদ রয়েছে। বঙ্গোপসাগরের প্রায় ৩০ থেকে ৮০ মিটার গভীরে সিমেন্ট শিল্পের কাঁচামাল 'ক্লে'র সন্ধান পাওয়া গেছে। ম্যাগনেশিয়ামের লবণ এয়ারক্রাফট নির্মাণে ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া সার ও নানা ধরনের রসায়ন শিল্পে পটাশিয়াম লবণ ব্যবহার করা হয়। ওষুধ তৈরিতে ব্রোমিন, ওয়াল বোর্ড নির্মাণে জিপসাম, সোডিয়াম ক্লোরাইড খাবার লবণ হিসেবে গ্রহণ করা হয়। সম্প্রতি বঙ্গোপসাগরের অগভীর ও গভীর তলদেশে মহামূল্যবান ধাতু ইউরেনিয়াম ও থোরিয়ামের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। বাংলাদেশের কাছাকাছি মিয়ানমারের সাগর ভাগেও পাওয়া গেছে বড় গ্যাসক্ষেত্র। ভূতত্ত্ববিদদের মতে, সমুদ্র সীমায়ও বড় ধরনের গ্যাসের মজুদ রয়েছে। বাংলাদেশ ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের রাষ্ট্রীয় কোম্পানি ওএনজিসির সাথে দুটি অগভীর ব্লক তেল গ্যাস অনুসন্ধানে চুক্তি করেছে। অস্ট্রেলিয়ার কোম্পানি সান্তোসের সাথে গভীর ব্লক ১১ ও দক্ষিণ কোরিয়ার পোস্কো-দাইয়ুর সাথে গভীর ব্লক থেকে ১২ এর জন্য চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। 

সমুদ্র বাণিজ্যের যে ২৬ খাত চিহ্নিত হয়েছে, তার মধ্যে তেল-গ্যাস ছাড়াও নানামুখী পর্যটন, বন্দর, জাহাজ শিল্প, সমুদ্রের নবায়নযোগ্য জ্বালানি, সমূদ্র সম্পদ ও খনিজনির্ভর নানা শিল্প রয়েছে।অথচ দেশের সমুদ্রের ব্লকগুলোতে জ্বালানি অনুসন্ধানের উদ্যোগ বছরের পর বছর ধরে স্থবির হয়ে আছে। মিয়ানমার যেখানে গ্যাস রপ্তানি করছে, সেখানে ঘাটতি সামাল দিতে আমরা গ্যাস তরল করে জাহাজ ভরে আমদানি করছি। সমুদ্র থেকে মৎস্যসম্পদ আহরণের লক্ষ্যে ব্যবস্থাপনা ও অবকাঠামো উন্নয়নে বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার কাছে অনেক দিন ধরে অর্থসহায়তা চেয়ে আসছে সরকার। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে সমুদ্রে মাছ আহরণ বাড়বে, শক্তিশালী হবে ব্লু-ইকোনমি বা সমুদ্র অর্থনীতি। সমূদ্র বিজয়ের পরপরই ব্লু-ইকোনমি সেল গঠন করা হয়। উক্ত সেলের পরিকল্পনাগুলো ছিল নিম্মরুপ- বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা বা ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ মহা-পরিকল্পনায় সমুদ্র অর্থনীতিকে অগ্রাধিকার দেয়া, সমুদ্রসীমায় খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান ও আহরণের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে 'ব্লু-ইকোনমি অথরিটি' করার জন্য সংসদীয় কমিটিতে সুপারিশ করা, নীল অর্থনীতির সম্ভাবনা কাজে লাগাতে সামুদ্রিক সম্পদের বহুমাত্রিক জরিপ সম্পন্ন করা, যত দ্রুত সম্ভব স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রণয়ন করা, বিদেশী দক্ষ সংস্থার পরামর্শ নিয়ে জরিপ কার্যক্রম দ্রুত শুরু করা এবং একই সঙ্গে নিজেদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা, সমুদ্র অর্থনীতিকে যারা সফলভাবে কাজে লাগিয়েছে যেমন-ইন্দোনেশিয়া বা অস্ট্রেলিয়ার গৃহীত পদক্ষেপগুলো পর্যালোচনা করে একটি সমূদ্র নীতিমালা প্রণয়ণ করা, যে সকল বাংলাদেশি এইখাতে গবেষণা ও কাজে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন প্রয়োজনে তাদের দেশে ফিরিয়ে আনা, সমুদ্র নির্ভর শিল্পের উনয়ন ও প্রসারে পর্যাপ্ত বাজেটও বরাদ্দ করা, সমুদ্র বিজ্ঞানের বিকাশে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ সংক্রান্ত বিভাগ খোলা ও আলাদা গবেষণাকেন্দ্র স্থাপন করা, বিদেশি বিনিয়াগকারিসহ দেশীয় শিল্পোদ্যোক্তাদের ব্লু-ইকোনোমি ঘিরে শিল্প প্রতিষ্ঠায় আকৃষ্ট ও আগ্রহী করে তোলা ইত্যাদি।

লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, নায়েম, ঢাকা

প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ - dainik shiksha প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার - dainik shiksha তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার - dainik shiksha স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন - dainik shiksha নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0050041675567627