ভর্তিতে অতিরিক্ত ফি বাণিজ্য বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ চাই - দৈনিকশিক্ষা

ভর্তিতে অতিরিক্ত ফি বাণিজ্য বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ চাই

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

নাগরিক জীবনে করোনা মহামারির পর নিত্যপণ্যের পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি আলোচিত সমস্যা হিসাবে আবির্ভূত সমস্যার নাম এখন ভর্তি বাণিজ্য এবং নামে-বেনামে বিভিন্ন ফি আদায়ের যন্ত্রণা।

২০১৬ সালে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) চট্টগ্রামে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তিতে সরকারি নীতিমালা উপেক্ষা করে ভর্তি বাণিজ্যে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসন ও জেলা শিক্ষা অফিসকে নিয়ে অভিযান পরিচালনা করে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ, অতিরিক্ত অর্থ ফেরতদানে সফল হলেও বছর যেতে না যেতেই পরের বছর আবার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নতুন বছরে ভর্তিতে ঘুরেফিরে সেই ভর্তি বাণিজ্য ও অতিরিক্ত ফি আদায়ের মহড়া, কেজি ও নার্সারি শ্রেণিতে ভর্তিতে লটারির নামে গোপনে লটারি দেখিয়ে পছন্দসই শিক্ষার্থী ভর্তি করা, এসএসসি ও এইচএসসিতে শ্রেণি শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট না পড়লে টেস্ট (নির্বাচনি) পরীক্ষায় অকৃতকার্য করাসহ নানাভাবে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের মহোৎসব শুরু হয়েছে। সোমবার (১৮ জানুয়ারি) যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত উপসম্পাদকীয়তে এ তথ্য জানা যায়।

উপসম্পাদকীয়তে আরও জানা যায়, করোনা মহামারির এ সময়ে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) নির্দেশনা অমান্য করে বেশিরভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বছরের শুরুতেই ছাত্রছাত্রীদের নতুন করে ভর্তি ও পুনঃভর্তি করছে। সংবাদমাধ্যমের তথ্যমতে, বেশিরভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গত বছরের জানুয়ারির সমান ফি নিচ্ছে। এমনকি কেউ কেউ ফি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

এতে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে পনেরো হাজার টাকা পর্যন্ত নিচ্ছে। করোনার কারণে গত মার্চের মাঝামাঝি থেকে বন্ধ হওয়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখনো খোলেনি। গত শিক্ষাবর্ষের অধিকাংশ সময় শিক্ষার্থীরা অনলাইন কিংবা দূরশিখন কার্যক্রমে অংশ নিয়েছে।

তার চেয়ে বড় কথা, করোনার প্রভাবে অনেক মানুষ কর্মহীন হয়েছে, অনেক পরিবারের আয় কমে গেছে, নতুন করে অন্তত ২০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। এরকম সংকটকালেও বেতন-ফি আদায়ে অভিভাবকদের ওপর চাপ প্রয়োগ করার বিষয়টি অমানবিক।

প্রশাসনিক বিধিনিষেধ থাকার পরও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বছরের শুরুতে যেভাবে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করছে, তা করোনা দুর্যোগের এ সময়ে যেন ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হিসাবে দেখা দিয়েছে।

আমরা ইতঃপূর্বেও দেখেছি, মাউশি বা শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি নির্দেশনা ওয়েবসাইটে প্রকাশ বা মিডিয়ার কাছে দিয়েই তাদের দায়িত্ব শেষ করেছে। মাঠ পর্যায়ে তাদের অনেক অফিস ও প্রশাসনিক স্তর থাকলেও কার্যত তাদের কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না-এ আশঙ্কা থেকেই যায়।

মাউশি অ্যাসাইনমেন্ট, টিফিন, পুনঃভর্তি, গ্রন্থাগার, বিজ্ঞানাগার, ম্যাগাজিন ও উন্নয়ন খাতে কোনো ফি না নেওয়ার নির্দেশনা প্রদান করেছে। আশা করা হয়েছিল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় করোনাকালে যে সাতটি খাতে অর্থ আদায় না করার কথা বলা হয়েছে; কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এ নিয়ম মানছে কিনা, তা তদারকি করা এবং না মানলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্বও মাউশিরই।

অস্বীকার করা যাবে না, করোনার প্রভাব শিক্ষা খাত, বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর তুলনামূলক বেশি পড়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠানকেই শিক্ষক-কর্মচারীর বেতন দিতে হিমশিম খেতে হয়েছে। ফলে আমরা মনে করি, করোনাকালীন সংকট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোরও অনুধাবনের কথা।

তার চেয়ে বড় কথা-এটি এমন এক ভাইরাস, যা যেমন কোনো দেশের সীমানা মানেনি, তেমনি ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে কাউকে বিচার করেনি। বৈশ্বিক এ সংকট আমরা সবাই মিলে মোকাবিলা করছি বলেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোরও সেভাবে দায়িত্বশীল ভূমিকা প্রত্যাশিত।

আমরা দেখছি, প্রায় সব খাতই করোনার প্রভাব কাটিয়ে উঠছে। বিশেষ করে অর্থনৈতিক সব কর্মকাণ্ড এখন সচল। অথচ সরকার এখনও পরিস্থিতির আলোকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না; যদিও শিক্ষাক্ষেত্রে একেবারে জরুরি সিদ্ধান্ত ও কার্যক্রম বন্ধ নেই। যেমন অটোপাশ-অ্যাসাইনমেন্টের সিদ্ধান্ত, ভর্তি প্রক্রিয়ায় লটারি, কলেজে ভর্তি, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কার্যক্রম ও প্রয়োজনীয় পরীক্ষা ইত্যাদি।

তবে গত শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থীদের যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে, এখন তা কীভাবে কাটিয়ে ওঠা যায়, সে চিন্তা করা দরকার। এর বিপরীতে একেবারে স্বাভাবিক অবস্থার মতো ভর্তির অর্থ নিয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের যেভাবে চাপে ফেলা হচ্ছে, তা কাম্য হতে পারে না। আমাদের প্রত্যাশা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো মাউশি নির্দেশিত সাতটি খাত তথা অ্যাসাইনমেন্ট, টিফিন, পুনঃভর্তি, গ্রন্থাগার, বিজ্ঞানাগার, ম্যাগাজিন ও উন্নয়ন বাবদ কোনো ফি তো নেবেই না; এর বাইরেও যেসব ফি নেওয়া হবে, তা আগের চেয়ে কমিয়ে ধরা হলে অভিভাবকরা যেমন স্বস্তিতে থাকবেন, তেমনি শিক্ষার্থীদের শিক্ষার ধারাবাহিকতা রক্ষাও নিশ্চিত হবে।

গত বছর যেহেতু সরাসরি ক্লাস হয়নি, তাই যেসব ফি অত্যাবশ্যকীয় নয় বা যা কোনো কাজে আসেনি, সেগুলো টিউশন ফির সঙ্গে সমন্বয় করতে বলেছিল মাউশি অধিদপ্তর। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তা করেছে বলে শোনা যায়নি। উল্টো বছরের শেষে গত বছরের বেতন বকেয়া থাকলে তা আদায় করেছে অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

আমরা জানি, শিক্ষা বাণিজ্য নয়; বরং সেবা হিসাবেই দেখা হয়। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত, সেবার মানসিকতা নিয়েই ফি নির্ধারণ করা। একইসঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে কেবল শিক্ষার্থী ফির ওপর নির্ভরশীল না থেকে নিজস্ব আয়ের খাতও বের করা দরকার।

ক্যাব-চট্টগ্রাম ২০১৬ সাল থেকে চট্টগ্রামে ভর্তি বাণিজ্যের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনাকালে একাধিকবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা বোর্ড ও জেলা প্রশাসনের সঙ্গে দফায় দফায় অনুষ্ঠিত মতবিনিময় করেছে। এসব সভায় বারবার স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে অভিভাবকদের সক্রিয় ও নিয়মিত মতবিনিময়ের ওপর অধিক গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে।

এ ছাড়া নিয়মিত অভিভাবক সভা আয়োজন, ভর্তি বাণিজ্য, অতিরিক্ত ফি আদায়সহ বিভিন্ন অনিয়ম রোধে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন ও কর্তৃপক্ষের নিয়মিত তদারকি ও নজরদারির কথা বলেছে। কিন্তু তা না করে ‘অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে’ এ ধরনের বক্তব্যের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সরকারি ভর্তি নীতিমালা ও নির্দেশনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে অতিরিক্ত ফি আদায়, কোচিং বাণিজ্যসহ নানা অনিয়মে জড়িত হলেও শিক্ষা প্রশাসন, মন্ত্রণালয় আজ পর্যন্ত একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণের নজির রাখতে পারেনি।

চট্টগ্রামে ২০১৭ সালে ৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে একাডেমিক স্বীকৃতি বাতিল করলে স্কুল কর্তৃপক্ষ মহামান্য হাইকোর্টে রিট আবেদন করে তা স্থগিত করে। অধিকন্তু এ প্রতিষ্ঠানগুলো দিব্যি একাডেমিক স্বীকৃতি ছাড়াও এখন নতুন নতুন বিভাগ সংযোজন ও পাঠদানের অনুমতি নিচ্ছে। এতে বোঝা যায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো অনিয়মের কারখানায় পরিণত হয়েছে।

আর সে কারণেই সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করার কথা বলে চালের আড়ত, মাছের আড়ত, রিয়েল এস্টেট, গার্মেন্ট ও অন্যান্য ব্যবসার পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে শিক্ষা ব্যবসায় নেমে পড়েছেন এক শ্রেণির ব্যবসায়ী।

আর তারা এসব শিক্ষা দোকান খুলে ভর্তিতে সরকারি নীতিমালার তোয়াক্কা না করে গলাকাটা ফি আদায়, উন্নয়ন ফি, ল্যাব ফি, টিসির নামে পুরো বছরের ফি আদায়সহ নানাভাবে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বিপুল অর্থ আদায় করছে। আবার মধ্য সাময়িক পরীক্ষায় অনুপস্থিতি জরিমানা, পরীক্ষার প্রবেশপত্র সংগ্রহ করার সময়ও বিভিন্ন ফি আদায় করছে।

গণমাধ্যমে যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম এসেছে, তারা প্রায় সবই নামিদামি ও সামর্থ্যবান; যাদের শিক্ষার্থী সংখ্যাও কম নয়। শিক্ষার্থীদের থেকে অতিরিক্ত অর্থ না নিলেও তারা চলতে পারবে। তাই পুরনো শিক্ষার্থীদের নতুন করে ভর্তি করিয়ে তাদের কাছ থেকে পুনঃভর্তি ফি নেওয়ার কোনো দরকার ছিল না।

শিক্ষা প্রশাসনের বক্তব্য কারও বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে বাস্তবে এ ব্যবস্থা নেওয়ার নজির পাওয়া যায়নি। মাঝে মাঝে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ পেলেই কিছুটা টনক নড়ে কর্তৃপক্ষের। শিক্ষা প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে দায়িত্বপ্রাপ্তরা যথাযথ ভূমিকা পালন করলে এ অবস্থার কিছুটা হলেও পরিবর্তন হতো।

যেহেতু সরকারের একটি সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা রয়েছে, সরকারের প্রতিষ্ঠানও রয়েছে সবকিছু দেখভাল করার জন্য, তাই এসব বিষয় তাদের খতিয়ে দেখা দরকার। যেসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, সেসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নিলে অন্য প্রতিষ্ঠানও এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হবে। আমরা আশা করব, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো মাউশির নির্দেশনা মেনে চলবে।

কোনো বাড়তি ফি আদায় করবে না। যেসব প্রতিষ্ঠান নির্দেশনা মানবে না, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

লেখক : এসএম নাজের হোসাইন : ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)

উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন - dainik shiksha জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো - dainik shiksha ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা - dainik shiksha তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণ ও ‘বিশ্ব বই দিবস’ - dainik shiksha স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণ ও ‘বিশ্ব বই দিবস’ শিক্ষার মান পতনে ডক্টরেট লেখা বন্ধ জার্মান পাসপোর্টে - dainik shiksha শিক্ষার মান পতনে ডক্টরেট লেখা বন্ধ জার্মান পাসপোর্টে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0076251029968262