ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের বর্তমান অধ্যক্ষ কামরুন নাহার ও অভিভাভবক ফোরামের নেতা মীর সাহাবুদ্দিন টিপুর মধ্যকার ফাঁস হওয়া ফোনালাপ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মিডিয়ায় আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। এ নিয়ে ভিকারুননিসার শিক্ষক-শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ দেশের সচেতন নাগরিকরাও বিব্রত। ভর্তিবাণিজ্যসহ নানারকম দূর্নীতি ও ষড়যন্ত্র অনেত দিন ধরেই ঐতিহ্যবাহী ভিকারুননিসা নামক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিকে বারবার বিতর্কিত করছে। পরপর কয়েকবার অধ্যক্ষ পরিবর্তন করা হয়েছে, তা সত্ত্বেও প্রতিষ্ঠানটির অস্থিরতা দূর হচ্ছে না। এর কারণ অনুসন্ধান করা জরুরি।শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির সুনাম এবং আর্থিক স্বচ্ছলতার কারণে এটিকে ঘিরে একটি সংঘবদ্ধ চক্র গড়ে উঠেছে, যারা কোনো না কোনোভাবে এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত রাখে এবং কলেজ প্রশাসনের উপর চাপ সষ্টি করে ভর্তিবাণিজ্যসহ নানা অনিয়মের মাধ্যমে অর্থ উপার্জনে তৎপর। সম্প্রতি ভর্তিবাণিজ্যে ব্যর্থ হয়ে এ চক্রটি আবার তৎপর হয়ে উঠেছে। অভিযোগের তীর অভিভাবক ফোরাম ও জিবি নামক সংগঠনটির কতিপয় সদস্যের বিরুদ্ধে, যারা নিজস্ব স্বার্থে কলেজ অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কলেজ প্রশাসনকে বেকায়দায় ফেলে তাদের ভর্তিবাণিজ্য অব্যাহত রাখতে সচেষ্ট বলে প্রতীয়মান। এসব কারণে প্রায় ৭০ বছরের পুরনো এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির অনেক অর্জনে এখন ধুলো পড়তে শুরু করেছে বলে অনেকে মনে করেন।
ভর্তিবাণিজ্য, অধ্যক্ষ, শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগ বাণিজ্য, অনিয়ম ও দুর্নীতিসহ নানা অভিযোগ আলোচিত-সমালোচিত ইদানিং এ প্রতিষ্ঠানটি। আগের গভর্নিং বডির বিরুদ্ধে ভর্তিবাণিজ্য ও অনিয়মের অভিযোগ থাকায় গভর্নিং বডি (জিবি) নির্বাচনে ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের ৬ অক্টোবর ৬ জন প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল করা হয় বলে তৎকালীন একটি পত্রিকায় রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। তাদের বিরুদ্ধে ঘুষ নিয়ে অযোগ্য প্রার্থীকে অধ্যক্ষ পদে বসানোর চেষ্টা, টাকার বিনিময়ে অতিরিক্ত সাড়ে ৪শ’ শিক্ষার্থী ভর্তি, অবৈধভাবে ১৪ জন প্রভাষক নিয়োগ, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সঙ্গে খারাপ আচরণসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। এসব তথ্যই ২০১৯খ্রিষ্টাব্দের গভর্নিং বডি নির্বাচনের প্রাক্কালে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। সে নির্বাচনে পরাজিতরা সংবাদ সম্মেলন করে অনিয়মের অভিযোগ এনে নির্বাচন বাতিল করারও দাবি জানিয়েছিলেন।
অধ্যক্ষ কামরুন নাহার একটি পত্রিকাকে নিজেই বলেছেন, ‘ক্যাম্পাসে আসার তিনদিনের মাথায় ওরা আমাকে গালিগালাজ শুরু করে। ওদের কথামত নাকি আমাকে চলতে হবে। এর আগের প্রিন্সিপালকে (অধ্যাপক ফৌজিয়া বেগম) তারা মোবাইল ছুঁড়ে মেরেছে। আমার বাসায় ঢিল মারে। আমার দরজায় লাথি মেরেছে। লাথি মেরে আমার চেয়ার ফেলে দিয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ওরা চায় (অভিভাবক ফোরাম) আমি কিছু আসন ফাঁকা রাখি যাতে তারা ভর্তিবাণিজ্য করতে পারে।... এবারের ভর্তির লটারির সময়ও তারা ১২০টি সিট খালি রেখেছে। এছাড়া কিছু শিক্ষার্থী ভর্তি হয়নি। সবমিলিয়ে প্রায় ১৫০-৬০টি সিট খালি আছে। মূলত সেগুলোতে অবৈধ ভর্তি করতে তারা আমাকে অনেক আগে থেকে চাপ দিচ্ছে। আমি তাদের কথা না শোনায় কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। মূলত ভর্তিবাণিজ্য নিয়ে পেরে না উঠে আমাকে ফাঁসানোর জন্য এ ষড়যন্ত্র করছেন জিবি সদস্য ও অভিভাভবক ফোরামের লোকজন। আমি এ প্রতিষ্ঠান বাঁচাতে চাই। এক্ষেত্রে সবার সহযোগিতা চাই। প্রতিষ্ঠানটিকে ধ্বংস করতে এটি তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা। আমি প্রতিষ্ঠানটিকে বাঁচাতে চাই। আপনারা সবাই এগিয়ে আসুন।’
অধ্যক্ষ কামরুন নাহারের বক্তব্য থেকে ওখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা করা সম্ভব। কামরুন নাহার ওখানে পদায়ন পাওয়ার পর থেকেই তাকে এসব অনিয়ম, দূর্নীতি ও ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করতে হচ্ছে। এথেকে ধারণা করা যায় , তাকে নানামুখী ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে উত্তেজিত করে পরিকল্পিতভাবে তাঁর কথা রেকর্ড করে ভাইরাল করা হয়েছে। এমনও হতে পারে এটা এডিটেড অডিও, যেটা বর্তমান অধ্যক্ষ দাবি করেছেন। যদি অডিওটি সত্যও হয় তবু বলা যায় উনি প্রকাশ্যেতো কাউকে কিছু বলেননি, ওটা দুজনের ব্যক্তিগত কথোপকথন। ফোন যিনি করেছিলেন তাকে তিনি গালি দেননি, কিংবা কোনো শিক্ষার্থী বা অভিভাবকদেরও গালি দেননি, গালি দিয়েছেন কলেজ প্রশাসনকে বেকায়দায় ফেলে স্বার্থ আদায়কারী দূর্নীতিবাজ কাউকে। তাছাড়া ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় সবসময় আমরা দাপ্তরিক বা অফিসিয়াল ভাষায় কথা বলি না। কথার ভাষা নির্ভর করে ব্যক্তিগত সম্পর্কের উপর। গালিগালাজ করার চেয়ে লুটেপুটে খাওয়া উত্তম হতো কী? এর মানে এই নয় যে আমি গালিগালাজকে সমর্থন করছি। একজন শিক্ষকের ভাষা হতে হবে অবশ্যই মার্জিত। আর প্রতিষ্ঠান প্রধান হিসেবে অধ্যক্ষের ভাষা ও আচরণ হতে হবে আরও বেশি পরিমার্জিত। অর্থাৎ অপ্রাসঙ্গিক ও অশ্লীল কোনো বাক্যই গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু একজন অধ্যক্ষ যিনি সুনামের সঙ্গে অতীতে একটি প্রতিষ্ঠানে অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করে এসেছেন, তিনি কতটা র্ধৈযহারা হলে গালিগালাজ করতে পারেন তা অবশ্যই বিবেচনাযোগ্য। সাইবার ক্রাইম আ্যাক্ট অনুযায়ী ব্যক্তিগত কথোপকথন ফাঁস করে কাউকে বিব্রত করাও একটা অপরাধ। অধ্যক্ষ কামরুন নাহারের সাথে অভিভাভবক ফোরামের নেতা মীর সাহাবুদ্দিন টিপুর মধ্যকার ফাঁস হওয়া ফোনালাপ টিপু নিজেই ফেসবুকে দিয়েছেন বলে একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের কাছে তিনি স্বীকার করেছেন গত ২৭ জুলাই। এ থেকে বোঝা যায় ঘটনাটি পূর্ব পরিকল্পিত।
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের বর্তমান অধ্যক্ষসহ পূর্ববর্তী কয়েকজন অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ আর অসন্তোষ লক্ষ্য করা যায় অভিভাবক ফোরামের কতিপয় সদস্যের মধ্যে। কিন্তু কেন? গভর্নিং বডি একটা স্বীকৃত বডি, কিন্তু অভিভাবক ফোরাম? তাদের স্থায়ী স্বীকৃতি হয় কীভাবে? কতিপয় মুখ দীর্ঘদিন যাবৎ অভিভাবক ফোরাম নামে একটি ফোরামে সক্রিয় রয়েছেন নিজেদের অবৈধ নানা স্বার্থ আদায়ে, যা গত ২২ মার্চ অধ্যক্ষ বরাবর লিখিত তাদের চিঠিতেই প্রমাণিত। একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের সংবাদে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অভিভাবক ফোরামের প্যাডে সে চিঠিটি প্রকাশিত যেখানে তারা শুন্য আসন, জিবি সদস্যদের আত্মীয় স্বজন ও ভর্তি ডিও লেটার অনুযায়ী শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য অধ্যক্ষকে চাপ সৃষ্টি করেছেন। অভিভাবক ফোরাম কি এটা করতে পারেন? কলেজের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক সিদ্দিকী নাসিরউদ্দিন ১ কোটি ৫৯ লক্ষ টাকা উত্তোলন করে তার বিল ভাউচার যথাসময়ে সমন্বয় না করায় অধ্যক্ষ কামরুন নাহার তাকে গত ১৮ এপ্রিল চিঠি পাঠিয়েছেন যা অতীতে কোনো অধ্যক্ষ করেননি। তিনি চাপের কাছে নতি স্বীকার করে কোনো শিক্ষার্থীও ভর্তি করতে রাজি হননি। এসবই ছিল দূর্নীতিবাজ চক্রের পক্ষে বর্তমান অধ্যক্ষের বিরোধিতা করার অন্যতম প্রধান কারণ।
২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ অক্টোবর একটি পত্রিকা লিখেছিল, ‘এই বিদ্যালয়ের কোন একটি দায়িত্ব পেতে মরিয়া এক শ্রেণির অভিভাবকও। বিদ্যালয়টির গভর্নিং বডির সদ্যসমাপ্ত নির্বাচন দেখে অনেকের মনেই একটি প্রশ্ন জেগেছে, এই বিদ্যালয়ের গভর্নিং বডিতে কি এমন মধু বা যাদু আছে যে এক শ্রেণির অভিভাবক ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন এবং কোটি কোটি টাকা খরচ করেছেন এ নির্বাচনে? কেউ কেউ বলছেন, যে টাকা খরচ করেছেন তার কয়েক গুণ উসুল করার সুযোগ আছে বলেই তো এত টাকা খরচ করেছেন প্রার্থীরা।’ পত্রিকায় আরও উল্লেখ করা হয়েছিল, ‘প্রচার-প্রচারণার আতিশয্য আর খরচের দিক থেকে বিচার করলে তা ছাড়িয়ে গেছে জাতীয় বা স্থানীয় সরকার নির্বাচনকেও।’ রিপোর্টে একথাও উল্লেখ করা হয়, ‘নির্বাচনকে কেন্দ্র করেও ফায়দা লুটেছে আরেকটি শ্রেণি। অভিভাবকদের অনেকেই গ্রুপ বা সিন্ডিকেট করে প্রার্থীদের সঙ্গে দেখা করেছেন। ওই গ্রুপ বা সিন্ডিকেটের যারা হোতা তারা প্রার্থীদের কাছ থেকে ভোট ‘কনফার্ম’ করার নামে নিয়েছেন বড় অংকের টাকা।’ রিপোর্টে আরও উল্লেখ করা হয় , ‘শিক্ষক নিয়োগে ২০/২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত লেনদেনের বিষয়টি ওপেন সিক্রেট। এর বাইরে প্রতিষ্ঠানের নানা অবকাঠামো নির্মাণ, সংস্কার, রং করা, কেনাকাটাসহ নানাখাতে বছরে কোটি কোটি টাকা খরচ হয় যা অনুমোদন ও নিয়ন্ত্রণ এই পরিচালনা পর্ষদ (জিবি) করে থাকে। তাই পরিচালনা পর্ষদে জায়গা করে নেয়া অর্থনৈতিক দিক থেকে খুবই লাভজনক একটি বিষয় বলে মনে করা হয়।’
সুতরাং প্রতীয়মান হয় , অভিভাবক ফোরামসহ একটি সংগঠিত শক্তি অধ্যক্ষকে তাদের পক্ষে রেখে ভর্তি বাণিজ্যসহ নানা অপকর্ম করতে তৎপর হয়। অধ্যক্ষ তাদের অপকর্ম সমর্থন না করলেই শুরু হয় অধ্যক্ষ বিরোধী তৎপরতা। অধ্যক্ষ হামিদা আলীর কঠোর পরিশ্রম ও নিয়ন্ত্রণে যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি এদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল, সে প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান অবস্থা শিক্ষা সেক্টরের বেসরকারি ব্যবস্থাপনার কাঠামোগত পরিবর্তন করার প্রয়োজনীয়তাকে আবারও সামনে এনে দিয়েছে বলে মনে করি। সুতরাং দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির হাত থেকে ঐতিহ্যবাহী এ প্রতিষ্ঠানটিকে রক্ষা করতে হলে নানা অনিয়মে জড়িতদের চিহ্নিত করে তা দৃঢ়ভাবে প্রতিরোধ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে ভর্তি বাণিজ্য ও কলেজের যাবতীয় কাজে অযাচিত হস্তক্ষেপ, শিক্ষকদের সঙ্গে অশোভন আচরণ এবং উন্নয়ন ও সংস্কার কাজে দূর্নীতিসহ গভর্নিং বডির কতিপয় সদসের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ তদন্তে গত ১৩ জুলাই তারিখে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। এ তদন্তের মাধ্যমে চিহ্নিত দূর্নীতিবাজদের স্বরুপ উন্মোচিত হোক সেটাই কাম্য।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, ঢাকা কলেজ